রাষ্ট্রীয় ঘুমে শিশুর কফিন: আকাশ ভাঙল, শিশু মরল রাষ্ট্র কোথায়? মীর আব্দুল আলীম
শৈশব গিয়েছিল স্কুলে, ফিরল কফিনে। আকাশ থেকে আগুন নেমে এলো রাজধানীর মিরপুরে। শিশুদের ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ল এক যুদ্ধ বিমান। যুদ্ধ হয়নি। ছিল না কোনো শত্রু, ছিল না কোনো ঘোষণা। শুধু এক পুরনো চীনা যুদ্ধবিমান, আর রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার ছোবল। মাইলস্টোন স্কুলের প্রাঙ্গণে যে আগুন লেগেছিল, তা শুধু ভবন নয়-ভস্ম করে দিয়েছে একটি জাতির বিবেক। পুড়ে যাওয়া বইয়ের পাতা, রক্তমাখা টিফিনবক্স আর জ্বলে যাওয়া খেলার মাঠ-এসবই এখন আমাদের শোকের চিহ্ন। কিন্তু এই শোক কেবল শোক নয়, এই শোক এক আর্তনাদ-এক জাতিগত জবাবদিহির ডাক। শিশুদের মৃত্যু হঠাৎ হয়নি। এটা এসেছে সিস্টেম নামের এক কুৎসিত দৈত্যের জিহ্বা থেকে। এখনো যদি আমরা চুপ থাকি, প্রশ্ন না তুলি-তবে পরের কফিনটা আমাদের সন্তানের জন্য তৈরি হচ্ছে। আমরা প্রস্তুত আছিতো?
এই লেখা তাঁদের জন্য, যারা বই হাতে এসেছিল ভবিষ্যৎ গড়তে, আর ফিরল কফিনে। এই কলাম সেই মায়েদের জন্য, যারা শেষবার ছেলের টিফিন বক্সে আদর রেখেছিলেন-জানতেন না সেটা হবে শেষ প্রার্থনা। এই মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, এ এক রাষ্ট্রীয় বিশ্বাসঘাতকতা। চুপ করে থাকলে কেবল ইতিহাসের পাতায় রক্তের ছাপ পড়ে, কিন্তু প্রতিবাদে গড়ে ওঠে বিবেকের ফাটল। প্রশ্ন তাই রেখেই শুরু করি-শিশুর রক্তে ভেজা স্কুলঘরে কে দেবে জবাব? যে রাষ্ট্র তার শিশুদের স্কুলে নিরাপত্তা দিতে পারে না, যে রাষ্ট্র শিশুর চোখের জল পর্যন্ত দেখতে পায় না-সে রাষ্ট্রকে আর কতদিন সহ্য করব আমরা? প্রতিটি শিশু রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ, কিন্তু যখন সেই ভবিষ্যৎ ভস্ম হয়ে যায়, তখন শুধু চোখের জল নয়, দরকার হয়ে পড়ে এক সামাজিক জাগরণ। শিশুরা প্রশ্ন তুলতে পারে না, তাদের হয়ে কথা বলা আমাদের দায়িত্ব। এই কলাম সেই দায় থেকেই রচিত। এই লেখার প্রতিটি শব্দ সেই পোড়া কণ্ঠের প্রতিধ্বনি, যে কণ্ঠ আর কোনোদিন আকাশে গান গাইবে না। এখনই না জাগলে, না প্রতিরোধ গড়লে, আগামীকাল হয়তো শিরোনামে থাকবে আমাদেরই সন্তানদের নাম।
চীনা যুদ্ধবিমান ‘ঋ-৭’ যিনি পরিচালনা করছিলেন তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির। তিনি মারা যাননি আকাশে। এটা দুর্ঘটনা নয়। এটা হত্যা। তিনি মরে গিয়েছিলেন সেই দিন, যেদিন কোটি কোটি বাজেট চুরি হয়েছিল। ৪৮ বছরের পুরনো ঋ-৭ দিয়ে ট্রেনিং! দুর্নীতির প্রতীক সেই জংধরা প্লেনই ছিল তাঁর কফিন। সিস্টেম তাঁকে বাঁচার সুযোগ দেয়নি। আজ শুধু একজন পাইলট নয়, নিচে থাকা শিক্ষার্থীরাও প্রাণ হারিয়েছে।এই মৃত্যু নয়, এটা ব্যর্থতা। এটা দুর্নীতি। এটা বিশ্বাসঘাতকতা। এই মৃত্যুর দায় আমাদের সবার। এখনো যদি আমরা না জাগি, না প্রশ্ন করি, না প্রতিরোধ গড়ি-তবে আমরা আর মানুষ নই, আমরা ইতিহাসের নিষ্ঠুর পাঠ মাত্র। আজ যারা নিথর, কাল তাদের জায়গায় হয়তো আমাদের সন্তান। তাই, চোখের জল যথেষ্ট নয়-প্রতিবাদই হবে প্রকৃত শোক। কিন্তু এই শোককে আমরা কেবল আবেগে মুড়ে রাখতে পারি না। এই মৃত্যু কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়—এটা রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা, নিরাপত্তাহীনতা ও চিরচেনা ‘চলে যাবে’ সংস্কৃতির নির্মম পরিণতি। এই কলামে আমরা সেই ব্যর্থতাগুলোকেই একে একে উন্মোচন করার চেষ্টা করব।
এটি ছিল রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার নিষ্ঠুর পরিণতি। যুদ্ধবিমানের উড্ডয়নপথ, জরুরি প্রটোকল, নিরাপত্তার খতিয়ান-সব কিছুই যেন নেই। শিশুদের মৃত্যু হলো রাষ্ট্রের সীমাহীন গাফিলতির প্রতীক হয়ে। এই মৃত্যু আকাশ থেকে আসেনি, এটি এসেছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের নিচু নৈতিকতা থেকে। বিমান চলাচলের নিরাপত্তা, শহরের ওপর দিয়ে বিমান উড্ডয়নের অনুমতি, জরুরি পরিস্থিতিতে বিকল্প রুট ও অটোমেটিক ইজেকশন ব্যবস্থা-সব কিছুতেই ছিল গলদ। অথচ এগুলো থাকা উচিত ছিল একটি সচেতন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোতে। প্রশ্ন ওঠে, কেন এখনো আমরা ৪৮ বছর পুরনো বিমান দিয়ে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছি? কেন আধুনিকীকরণের নামে বরাদ্দের টাকা গিয়ে পড়ে অজানা খাতে? এই মৃত্যু শুধু পাইলটের নয়, নিচে থাকা নিরপরাধ শিশুদের-এটা এক সম্মিলিত ব্যর্থতার ফল, যার দায় শুধু একজন বা দুজনের নয়, পুরো ব্যবস্থার।
এ যেন মৃত্যুফাঁদ! মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কতটা অনিরাপদ! কোনো প্রকার অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই, নেই রুটিন মহড়া, নেই জরুরি সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা। স্কুল যেন স্কুল নয়, যুদ্ধক্ষেত্র! সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে অভিভাবকরা যেন এক ধরনের আত্মঘাতী ঝুঁকি নিচ্ছেন প্রতিদিন। শুধু অবকাঠামো নয়, আমাদের নীতির মধ্যেও রয়েছে মারাত্মক ফাঁকফোকর। শিক্ষার সংজ্ঞায় নিরাপত্তা নেই। শিশুদের হাতে পেনসিল আছে, দেয়ালের ওপারে লুকিয়ে আছে মৃত্যু। রাষ্ট্র কি জানে, পরবর্তী মৃত্যু কখন, কোথায়? আরও গভীর বাস্তবতা হলো—বহু স্কুল গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক ভবনে, যেখানে নেই কোনো ন্যূনতম অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, নেই কোনো রুটিন সংকেত মহড়া, এমনকি নেই কোনো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা। শিক্ষার নামে চলছে নির্মম অব্যবস্থা। স্কুল ভবনের পাশেই অবৈধ গ্যাস সংযোগ, অসংরক্ষিত বিদ্যুৎ লাইন, এবং ট্রাফিক জটের মতো বিপদগুলো ঘিরে রেখেছে শিশুদের জীবনকে। এতসব বিপদ মাথায় নিয়ে কি কোনো শিশু স্বপ্ন দেখতে পারে?
আর শোক নয়, চাই রাষ্ট্রীয় জবাবদিহি! শোক দিবস পালনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-এই শোকের ফল কী? যদি কোনো দায় নির্ধারিত না হয়, কোনো প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতে আনা না হয়, তবে শোক কেবলই আবেগ। শিশুদের মৃত্যু কেবল দুঃখজনক নয়, এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। কাজেই চাই কাঠামোগত ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে সুরক্ষিত, প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত হবে সত্যিকার। শোককে প্রতিবাদে রূপান্তর করতে না পারলে, এই শিশুরা কেবল স্মৃতি হবে। আমরা কি শুধু মোমবাতি জ্বালিয়ে দায় শেষ করব? নাকি এই মুহূর্ত থেকেই দাবি তুলব—“প্রত্যেক শিশুর জন্য নিরাপদ স্কুল চাই”? আমরা কি কেবল ক্ষণিকের শোক দেখিয়ে রাষ্ট্রকে রেহাই দেব? নাকি এবার হিসাব চাইব—কোন বিভাগ ব্যর্থ, কোন কর্মকর্তা ঘুমাচ্ছিলেন, কার গাফিলতিতে এই প্রাণ হারাল? রাষ্ট্র যদি জবাব না দেয়, তবে জনতার রাস্তাই একমাত্র জবাবদিহির পথ। সময় এসেছে শোককে বদলে দেওয়ার, প্রতিরোধে রূপান্তর করার।
শিশুদের কথা কে বলবে? শিশুরা তো ভোট দেয় না, তাই তাদের নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। কিন্তু তাদের কণ্ঠ, তাদের চাহিদা, তাদের নিরাপত্তা-সবই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এক শিশুর মৃত্যুও একটি জাতির ব্যর্থতা। আজ যারা নিথর হয়ে গেল, তারা তো কিছু চাইতে পারেনি-তাদের হয়ে কথা বলার দায়িত্ব আমাদের। এখন যদি আমরা না বলি, তাহলে আগামী প্রজন্মও বিশ্বাস হারাবে এই রাষ্ট্র, এই সমাজ, এমনকি আমাদের ওপরও। শিশুদের কথা বলুন, তাদের পক্ষ নিন-কারণ তারা কথা বলার সুযোগ না পেয়েই চলে যাচ্ছে। এভাবে আর চলে যেদে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্র তার শিশুদের স্কুলেও নিরাপত্তা দিতে পারে না, তাহলে সে রাষ্ট্র কাদের জন্য? একটি যুদ্ধবিমান, একটি প্রশিক্ষণ প্লেন-অথচ বিধ্বস্ত হলো একটি স্কুলের উপর! শিশুদের চিৎকার, কাঁচা মাংসের গন্ধ, বইয়ের পাশে রক্ত... এ কেমন অব্যবস্থা? কেমন ‘প্রশিক্ষণ’? বিমান উড়ছে, কিন্তু রুটপথ জানা নেই। স্কুল আছে, কিন্তু নিরাপত্তা নেই। জীবন আছে, কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে তার দাম নেই। রাষ্ট্র তোদের বাঁচতে দেয়নি। রাষ্ট্র তোদের নাম রাখবে না কোনো স্মারকে- কারণ তোরা ক্ষমতাধর কারও ছিলি না। তারা ছিলি কেবল নাম না-জানা একটা ভবিষ্যৎ। ধিক রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা! ধিক এই পরিকল্পনাহীনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অমানবিক প্রশিক্ষণ-নীতি! আমরা আর চুপ থাকব না। আমরা শুধু শোক প্রকাশ করব না- প্রতিবাদ করব। এই রাষ্ট্রকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। শিশুরা আকাশ চেয়েছিল, আগুনে পুড়ল! প্রশ্ন থাকবেই: কেন নিরাপত্তাহীন আকাশে উড়ছিল যুদ্ধবিমান, আর কেন তার ধাক্কা খেল একদল নিষ্পাপ শিশু?
যাদের ঘরে নিথর শিশু, তাদের শোক কে বোঝে? সেই সব মায়েরা আজ আর কিছুতেই ঘুমাতে পারেন না। চোখ বন্ধ করলেই সন্তানের পোড়া মুখ, বিকৃত শরীর, দগ্ধ মুখের চিৎকার—সব দৃশ্য ফিরে আসে দুঃস্বপ্নের মতো। এক মা বারবার একই কথা বলেন, ও সকালে শুধু বলেছিল, ‘মা, একটু লেট হলে রাগ করো না’। ও যে আর ফিরবে না, আমি জানতাম না।” সেই মা এখন নির্বাক, চোখের ভাষায় আর্তি—এতো নিষ্ঠুর হতে পারে কি এই পৃথিবী? যাদের ঘরে নিথর শিশু পড়ে আছে, তাদের ব্যথা বুঝে না সমাজ, না রাষ্ট্র। একদিন পত্রিকার হেডলাইন ছিল, পরদিনই আমরা চলে গেছি অন্য শিরোনামে। কিন্তু এই মা-বাবাদের জন্য জীবন থেমে গেছে সেই মুহূর্তেই। এই শোক কখনো মুছে যাবে না, কারণ হারানোর বেদনা চিরস্থায়ী। আমরা যদি না শুনি তাদের কান্না, না বুঝি তাদের নিঃশব্দ আর্তি—তাহলে আমরা আসলে আর মানুষ নই। আজ যদি আমরা শিশুদের জন্য আওয়াজ তুলতে না পারি, তবে এই রাষ্ট্র, এই সমাজ—সবকিছুর ওপর থেকে মানুষের আস্থা উঠে যাবে। শিশুরা নিরাপদ নয় এমন রাষ্ট্র কেবলই এক বিভ্রম, এক ভয়াবহ আত্মপ্রতারণা। এখনই সময় প্রশ্ন তোলার-“রাষ্ট্র কার জন্য?”
বাংলাদেশে ট্র্যাজেডির ইতিহাস দীর্ঘ-তাজরীন থেকে চকবাজার, নারায়ণগঞ্জ থেকে মাইলস্টোন। কিন্তু কয়টায় বিচার হয়েছে? কয়টি পরিবার পেয়েছে ন্যায়বিচার? বিচারহীনতা যেন এই দেশের নতুন নিয়ম। এই সংস্কৃতিই বারবার অপরাধীদের সাহসী করে তোলে। শিশুদের মৃত্যুর দায় কেউ নেয় না—না ভবনের মালিক, না প্রশাসন, না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদি এবারও বিচার না হয়, তবে নিশ্চিত জানবেন, আগামী মৃত্যুর জন্যও আমরা প্রস্তুত করছি মঞ্চ। বিচার চাইলে যারা বলে “ঘোলা পানিতে মাছ ধরছো”-তাদেরই চোখের সামনে তৈরি হয় নতুন শবদেহ।
কি আশ্চর্য ব্যাপার! এত বড় এক শিশুমৃত্যু, অথচ কেউ পদত্যাগ করলো না! কেউ দায়িত্ব নিলো না! বরং ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত অনেকেই। আমাদের দেশে কীভাবে যেন প্রতিটি ঘটনা চাপা পড়ে যায় ‘তদন্ত চলছে’-এর আড়ালে। প্রশ্ন হলো, এত মৃত্যু দেখেও যারা দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না—তারা কীভাবে নীতিনির্ধারক হন? একজন শিক্ষামন্ত্রী, একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টা, একজন সিটি করপোরেশনের প্রধান—তারা কীভাবে ঘুমান? এই নৈঃশব্দ্য যেন এক নিষ্ঠুর অভ্যস্ততা, যেখানে রাষ্ট্র শুধু দেখেও না দেখার ভান করে।
রাষ্ট্রীয় অপরাধের দায় এড়ানো চলবে না! প্রতিটি শিশুর মৃত্যু শুধুই একটি ট্র্যাজেডি নয়—তা একেকটি রাজনৈতিক অপরাধ। কারণ রাষ্ট্র যখন জানে, যুদ্ধবিমান চলছে পুরনো কাঠামোয়, জানে, স্কুল ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, জানে, অভিভাবকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন—তবুও কিছু করে না, তখন সে অপরাধের অংশীদার হয়ে যায়। এসব মৃত্যু হলে আমাদের বলা হয় “দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা”, কিন্তু ভুলে যাই—যে দুর্ঘটনা বারবার ঘটে, তা আর দুর্ঘটনা নয়, তা একটি প্যাটার্ন। সেই প্যাটার্নের নাম অব্যবস্থা, দায় এড়ানোর সংস্কৃতি, এবং ‘ভুল হতেই পারে’ ধাঁচের আমলাতান্ত্রিক উদাসীনতা। তাই রাষ্ট্র যদি নিজের ভেতরে তল্লাশি না চালায়, তদন্তে নিরপেক্ষতা না আনে, দোষীদের নাম প্রকাশ না করে—তাহলে জনগণের মধ্যে বিশ্বাস ফিরে আসবে না। এ বিশ্বাসহীনতা একদিন বিস্ফোরণ ঘটায়, ক্ষোভ জমে যায় এমন উচ্চতায়, যেখানে শিশুর কান্নাও আর কানে ঢোকে না কারো।
শিশুর মৃত্যু রাজনৈতিক নীরবতা ভাঙে। এই মৃত্যু শুধু স্কুলের দেয়াল ভেঙে দেয়নি, ভেঙে দিয়েছে আমাদের নিস্পৃহতার দেয়ালও। রাজনীতিকরা যেভাবে চুপ থেকেছেন—তা আরেকটি জাতীয় লজ্জা। সংসদে এক মিনিট নীরবতা, কিছু শোকবার্তা, আর কিছু বিলাপ—এই কি আমাদের শিশুদের জন্য যোগ্য সম্মান? এ ঘটনায় তো কোনো কমিটি পর্যন্ত হয়নি সংসদে। কই, কোথায় সেই শিশুবান্ধব রাজনীতি? তারা কি কেবল বক্তৃতার জন্য? কেবল বাণী পাঠিয়ে দায় শেষ? শিশুদের মৃত্যু নিয়ে যদি রাষ্ট্রনায়করা রাজনীতির বাইরে এসে কিছু বলেন না, ব্যবস্থা না নেন, তাহলে জনগণের চোখে তাঁরা আর নায়ক থাকবেন না। আজ যদি শিশুদের মৃত্যুতে কোনও দল এক প্ল্যাটফর্মে না আসে, তবে কবে আসবে? যখন সব শেষ?
মিডিয়া চতুর্থ স্তম্ভ না ক্ষণস্থায়ী শোকদূত? মিডিয়া হয়ত প্রথম দুদিন সরব থাকে—লাইভ কাভারেজ, রিপোর্টারদের কণ্ঠে কাঁপা কাঁপা গলা। কিন্তু তারপর? ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়। এরপর অন্য কোনো সেলিব্রিটি স্ক্যান্ডাল বা রাজনীতির তর্জা এসে ঢেকে দেয় শিশুর পোড়া চামড়ার গন্ধ। এটাই কি গণমাধ্যমের ভূমিকা? নিউজরুমগুলোতে কি সত্যিই শিশুদের মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ থাকে? নাকি ‘ট্রেন্ড’ শেষ হলেই রিপোর্টার বদল? মিডিয়াকে জানতে হবে—এই ঘটনা শুধু সংবাদ নয়, এই ট্র্যাজেডি ইতিহাসের অংশ। সাংবাদিকতা কেবল খবর পরিবেশন নয়, দায়িত্বশীলতার নামও বটে।
জনতার আন্দোলনই একমাত্র ভাষা: যতক্ষণ না পর্যন্ত জনতা রাস্তায় নামছে, ততক্ষণ এই রাষ্ট্র নড়বে না। শিশুর মৃত্যুতে যদি আমরা শুধু ফেসবুক স্ট্যাটাস দিই, তাহলে দায় আমাদেরও। একটি নয়, দশটি নয়—এই দেশে শত শত শিশুর মৃত্যু ঘটেছে অব্যবস্থাপনায়। এবার সময় এসেছে—“নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন চাই”, “দুর্নীতিমুক্ত জরুরি ব্যবস্থা চাই”, “পুরনো যুদ্ধবিমান বাতিল চাই”—এসব দাবিতে সারাদেশ কাঁপানোর। আজ যারা স্কুলে, কাল তারা রাষ্ট্র চালাবে। কিন্তু যদি আজ তাদের নিশ্চিন্তে ক্লাসে বসতে না দেওয়া যায়, তাহলে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র কোথায়?
উপসংহার: তারা বই হাতে স্কুলে এসেছিল, ক্লাসে বসতে, খেলতে, ভবিষ্যতের গল্প শুনতে। কেউ ডাক্তার হতে চেয়েছিল, কেউ শিক্ষক, কেউ হয়তো কেবল খেলার ছলে বড় হতে চেয়েছিল। কিন্তু ফিরে গেলো না আর। কাঁধে বই নয়, উঠলো কফিন। টিফিন বক্সে রাখা খাবার শুকিয়ে গেল—খুলে দেখারও সময় হলো না। মা টিফিনে আদর রেখেছিল, সেই আদরও অভিশাপে রূপ নিল।
এই কলাম লিখতে লিখতে কাঁপছে আঙুল, ঝাপসা হয়ে আসছে পর্দা। কারণ ওরা তো আমার-আপনার ঘরের শিশুই। আপন ঘরের হাসি, স্বপ্ন, অবুঝ জেদ। যারা চিৎকার করতে পারেনি, যারা জানতে পারেনি কেমন মৃত্যু তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল—তাদের হত্যাকারী আসলে আমাদের নিষ্ক্রিয়তা, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘুম। শুধু প্রশ্ন রেখে যেতে চাই রাষ্ট্রের দরজায়-এই মৃত্যুর ভার কে নেবে? আর কতটা নিস্তরঙ্গ শিরোনাম হলে কানে পৌঁছবে শাসকের? আর কত শিশুর প্রাণ গেলে আপনার ঘুম ভাঙবে? না হয় ধরে নেব, আমরা এক নিস্প্রাণ প্রজাতি-যাদের চোখে জল আছে, কিন্তু হৃদয়ে দাহ নেই।
-লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।