শুক্রবার, মে ৯, ২০২৫
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
শিরোনাম : * সাতক্ষীরায় বিজিবির অভিযানে সাড়ে ৩ লক্ষাধিক টাকার ভারতীয় মাদকসহ বিভিন্ন মালামাল জব্দ   * রাণীশংকৈল সীমান্ত থেকে ৪ বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ   * কক্সবাজারে কৃষি কার্যক্রম পরিদর্শন করলেন অতিরিক্ত সচিব   * চট্টগ্রামের আ.লীগ নেতা নুরুল আবছার চৌধুরী গ্রেপ্তার   * চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দালাল আটক   * পরীক্ষাকেন্দ্রের মাঠে চলছে বৈশাখী মেলা ১৪৪ ধারা অমান্য করে সাধারণ মানুষ মেলায় ঢুকে পড়ে   * এ মেলায় সকলের সম্পৃক্ততা নেই- এটা মনে হচ্ছে বিএনপি’র মেলা - রাণীশংকৈলে মির্জা ফয়সাল   * সর্বোৎকৃষ্ট মানের স্কিন কেয়ার ও কসমেটিকস পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখে রিমার্কের ভূয়সী প্রশংসা করলেন শিল্প সচিব   * উপকূলের শ্যামনগরে বোরোর ফলনে কৃষকের মুখে হাসি   * চিতলমারীতে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত  

   প্রচ্ছদ
এই নৃশংসতার শেষ কোথায়
  Date : 01-10-2017

॥ মানবাধিকার খবর প্রতিবেদন ॥

মায়ানমারে বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গা নির্যাতন। বিশ্ববাসীর কাছে এটা যেন অনেকটা গা সওয়া ব্যপার হয়ে দাড়িয়েছে। আইয়্যামে জাহেলিয়ার অন্ধকার যুগের নির্যাতনকেও যেন মায়ানমারের এই বৌদ্ধকর্তৃক রোহিঙ্গা মুসলিমকে হার মানিয়েছে। সাম্প্রতি ৫০দিনের রোহিঙ্গা নির্যাতনের ইতিবৃত্ত নিয়ে মানবাধিকার খবরের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হল।

ঈদুল আজহার তিন দিন আগে রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার তুলাতুলি গ্রামসহ তিনটি গ্রামের বাসিন্দারা খালের কাছে বালুর চর নামক এলাকায় জড়ো হয়। এলাকাটি ঘিরে রাখা সেনাসদস্যরা তাদের সেখানে জড়ো হতে বলেছিল। গ্রামের এক রাখাইন জনপ্রতিনিধি তাদের সেখানে যেতে বলেন। আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, কারও কোনো ক্ষতি করা হবে না। কিন্তু গ্রামবাসী সেখানে সমবেত হওয়ামাত্র সেনাসদস্যরা সেই জায়গা ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ শুরু করে। যারা গুলিতে মরেনি, তাদের জবাই করে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ড থেকে ভাগ্যচক্রে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া নারী তৈয়বা বেগম বলেছেন, ওই দিন সেখানে গ্রামের বেশির ভাগ লোককেই মেরে ফেলা হয়েছে।

তুলাতুলি গ্রামের তৈয়বা বেগমের ঠিকানা এখন কক্সবাজারের উখিয়ার থ্যাংখালী আশ্রয়কেন্দ্রে। তাঁর আপনজন আর কেউ বেঁচে নেই। ওই দিন ওই হত্যাযজ্ঞে তাঁর বাবা-মা, ভাইবোনসহ পরিবারের সাত সদস্যকে হত্যা করা হয়। সকালে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে বসা তৈয়বা বেগম নৃংস এই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন এই প্রতিবেদকের কাছে। তৈয়বা বেগমের মতো বহু নারী-পুরুষের মুখে এখন এ রকম নৃশংসতার বিবরণ।

টেকনাফের কুতুপালং, বালুখালী, থ্যাংখালীর আশ্রয়কেন্দ্রে ৮৫ জনের সঙ্গে কথা বলে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নর-নারীর নিহত হওয়ার খবর মিলেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে দেখা যায়, অনেক যুবকের মোবাইলে এসব হত্যাযজ্ঞের ছবি-ভিডিও আছে। এসব হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি মংডু থেকে শুরু করে মধ্যবর্তী গভীর অঞ্চল বুথিডং এবং সর্বদক্ষিণে রাথেডং পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায়।

কেবল পাঁচটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামেই সাত’শ এর বেশি মানুষকে মেরে ফেলার কথা জানা গেছে রোহিঙ্গাদের কাছে। তা ছাড়া তুলাতুলি গ্রামের ১৫টি পরিবারের একজন সদস্যও বেঁচে নেই বলে দাবি করছে তারা। তিনটি রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রের অন্তত সাতজন নারীর সন্ধান মিলেছে, যাঁরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাঁদের তিনজন বর্তমানে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অন্যরা আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। স্বজন হারানো রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, অনেক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত প্রতিটি গ্রামেই।

নুরুল আমিন আছেন উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়কেন্দ্রে। তিনিও মংডুর তুলাতুলি গ্রামের বাসিন্দা। স্ত্রী, তিন সন্তানসহ সাতজন হারিয়ে এখন আশ্রয়কেন্দ্রে এক প্রতিবেশীর সঙ্গে বাস করছেন। নুরুল আমিন বলছিলেন, তিনি দেখেছেন সেনাপোশাক পরা একদল লোক গ্রামের মানুষকে গুলি করে, জবাই করে এবং ধর্ষণের পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। নাফ নদীর এক পারে কক্সবাজারের টেকনাফ, অন্য পারে রাখাইনের মংডু শহর। এই নদীর পাঁচটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে বাংলাদেশের টেকনাফে প্রবেশ করছে। এগুলো হলো টেকনাফের নাইট্যংপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, হারিয়াখালী ও ঘোলারচর।

এ ছাড়া উখিয়ার পালংখালীর আঞ্জুমান পাড়া, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে। চার দিনে রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাখাইনে যখন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, তখন দলে দলে এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে। তৈয়বা ও নুরুল আমিনের মতো মিয়ানমারের মংডুর তুলাতুলি, দিয়েলতলি, হোয়াইকং, গারতিবিল, বলিবাজার, বড়চরা, নাড়িরবিল, টমবাজার, খুল্লুং, হাসুরতা, রাজারবিল, জীবনখালিসহ অন্তত ১৬টি গ্রাম এবং বুথিডংয়ের নাতিডং, খুন্দু প্রাং, দক্ষিণ ফাতিয়া, চৌ পরাংসহ আটটি গ্রামের মোট ৮৫ জন স্বজনহারা রোহিঙ্গা নর-নারীর সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। এর মধ্যে কেবল মংডুর তুলাতুলির বালুরচর নামক জায়গায় তিনটি গ্রামের পাঁচ’শ এর বেশি মানুষকে এবং বুথিডং ছোট শহর নাতিডং ও চৌ পরাং গ্রামে ২০০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। একটি গ্রামের সাতটি পরিবারের একজন সদস্য ছাড়া বাকি সবাইকে মেরে ফেলেছে বলে তাদের স্বজনেরা দাবি করেছেন।

গুলিবিদ্ধ ও ধর্ষণের শিকার ১২ জন নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারীদের পুরুষদের থেকে আলাদা করে তাঁদের ঘরে আটক রাখা হয়। তুলাতুলি গ্রামের বাসিন্দা আলমাস খাতুনের গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। থ্যাংখালী আশ্রয়কেন্দ্রে আলমাস এই প্রতিবেদককে বলেন, সেদিন গ্রাম ঘিরে ফেলার পর সেনাসদস্যরা নারীদের আলাদা করে ঘরে ঢোকায়। ধর্ষণের পর তালাবদ্ধ করে আগুন দিয়ে পরে হত্যা করা হয়। ধর্ষণের শিকার মংডুর একজন রোহিঙ্গা নারী বলছিলেন, তাঁকেসহ চারজন নারীকে সেনারা ধর্ষণ করে। এরপর তাঁর সঙ্গের সব নারীকে হত্যা করা হলেও তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তাঁকে সাতজন সেনা ধর্ষণ করে বলে তিনি জানান। ধর্ষণের শিকার আরেকজন নারী বলছিলেন, তাঁকে তিনজন সেনাসদস্য ধর্ষণ করে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর বাসিন্দারা বলছেন, ধর্ষণের শিকার বহু নারী লোকলজ্জার ভয়ে মুখ খুলছেন না। কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি গ্রামেই নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

স্বজন হারানো প্রায় সব রোহিঙ্গার বিবরণ মেলালে দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডের আগে সেনাপোশাকে আসা লোকজন প্রথমে গ্রামগুলো ঘিরে ফেলে। পরে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করে। অন্তত ২০ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ বলেছেন, গুলিতে না মারা গেলে ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। তরুণীদের বাছাই করে আলাদা ঘরে আটক রাখা হয়। এরপর তাঁদের কাউকে কাউকে ধর্ষণের পর ঘর তালাবদ্ধ করে দিয়ে সেখানে আগুন ধরিয়ে হত্যা করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গুলিবিদ্ধ লাশগুলো গর্ত খুঁড়ে সেখানে পুঁতে রাখা হয়।

মংডুর নৌকার মাঝি হামিদ হোসেন নিজে একটি খাল থেকে ১৫টি শিশুর লাশ তুলেছেন বলে দাবি করেন। থ্যাংখালী আশ্রয়কেন্দ্রে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। উখিয়ার চবুল্লাকাটার নতুন আশ্রয়কেন্দ্রে আরেক রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রর্থী হামিদুল্লøাহ জানান, তিনি নিজে ১৪ জনের লাশ দাফন করে এসেছেন। স্বজন হারানোর পর অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এমন একজন নারী নূর বেগম। তিনি মংডুর লংডুওয়াইং গ্রামের বাসিন্দা। তাঁকে দেখা যায় উখিয়ার পালংখালী রাস্তার মোড়ে বলে চলেছেন, তাঁর স্বামীকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। নূর বেগমের মতো স্বজন হারানো জহির আহম্মেদেরও একই অবস্থা। তিনি চুপচাপ থাকেন। কথা তেমন বলেন না। এখন আছেন বালুখালী আশ্রয়কেন্দ্রে। রোহিঙ্গা শরণার্থী কেন্দ্রগুলোয় যাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, প্রিয়জনদের এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিতে গিয়ে তাঁরা হাউমাউ করে কেঁদেছেন। এমন অন্তত ১৫ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের খোঁজ মিলেছে, যাঁদের স্বামী বা স্ত্রী মারা গেছেন। আছে তাঁদের সন্তান। পাঁচটি শিশুকে পাওয়া গেল, যাদের বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই।

তুলাতুলি গ্রামের আরেক বাসিন্দা হাজেরা খাতুনের দাদা, দাদি, বাবা-মাসহ পরিবারের ১১ জন সদস্যকে সেনাসদস্যরা হত্যা করেছে। হাজেরা এখন থাকছেন থ্যাংখালী আশ্রয়কেন্দ্রে। তাঁর দাদা আহম্মেদ হোসেন এলাকায় মৌলভি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁকে জবাই করে হত্যা করা হয়। রাখাইনের রাশিদং এলাকার বাসিন্দা এনায়েত উল্লøাহ কুতুপালং আশ্রয়কেন্দ্রেবসে হঠাৎ করে ঈদের দুই দিন আগে তাঁদের গ্রাম ঘিরে ফেলে সেনাসদস্যরা। তাঁদের গ্রামের মাওলানা সৈয়দ আলমকে ধরে সঙ্গে সঙ্গে ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করে তারা। মিয়ানমারের মংডু ও বুথিডং টাউনশিপের ছয়টি গ্রামে ঈদের তিন দিন আগে গণহত্যা সংঘটিত হয়। নিহত এসব রোহিঙ্গা মংডুর তুলাতুলি, দিয়েলতলি ও হোয়াইকং এবং বুথিডংয়ের নাতি ডং ও চৌ পরাং গ্রামের বাসিন্দা।

প্রাণে বেঁচে আসা গুলিবিদ্ধ জহুরাম বুথিডংয়ের চৌ পরাং গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর হাতে ও পিঠে গুলি লাগে। থ্যাংখালীর আশ্রয়কেন্দ্রের এই রোহিঙ্গা নারী বলছিলেন, সেদিন সেনাপোশাকে আসা লোকজন গ্রাম ঘিরে ফেলে গুলি ছুড়তে থাকে। এলোপাতাড়ি গুলিতে গ্রামের অনেক লোক নিহত হয়েছে। কাউকে গুলি করে, আগুনে পুড়িয়ে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। চৌপরাং গ্রামের মরিয়ম বিবি এখন আছেন বালুখালী আশ্রয়কেন্দ্রে। রাতে তিনি বলছিলেন, তাঁর স্বামী শাহ আলম স্থানীয় একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। শাহ আলমকে জবাই করে আর ছেলে শাহজাহানকে ঈদের তিন দিন আগে গুলি হত্যা করা হয়। তুলতুলি গ্রামের প্রাণে বেঁচে যাওয়া সাবেক একজন চেয়ারম্যানসহ গ্রমের অন্তত ৩০ জন বাসিন্দা এখন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। তাঁদের ভাষ্য, তিনটি গ্রামে এমন ১৫টি পরিবার আছে, যাদের একজনও বেঁচে নেই। আর ২০টি পরিবারের একজন বা দুজন সদস্য ছাড়া বাকি সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। ৭০ বছরের বৃদ্ধ জহির হোসেনের ১৬ সদস্যের পরিবারে তিনি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। তিনি এখন বালুখালী আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। একই আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা গুলিবিদ্ধ যুবক আয়াসের আট সদস্যের পরিবারে তিনি ছাড়া আর সবাই সেদিন মারা গেছে। কিশোর রফিকও আছে বালুখালী আশ্রয়েকেন্দ্রে। সে ছাড়া পরিবারের নয় সদস্যের সবাই মারা গেছে। থ্যাংখালীর আশ্রয়েকেন্দ্রে থাকা শিশু শফিউল্লøাহ ও রফিকুল্লøাহ ছাড়া তাদের বাবা-মা সহ আট সদস্যের সবাই সেদিন নিহত হন। বালুখালী আশ্রয়েকেন্দে নুরাক্তিম বেগমের আট সদস্যের পরিবারের সব সদস্যকে সেদিন সেনাপোশাকে আসা লোকজন খুন করেছে। বালুখালী আশ্রয়েকেন্দে থাকা তুলাতুলির সাবেক চেয়ারম্যান রহমতউল্লøাহ বলছিলেন, ২৫ আগস্ট তাঁদের গ্রামের খুব কাছের একটি তল্লাশিচৌকিতে হামলা চালানো হয়।

এর এক দিন পর গ্রামে আসে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তাদের সঙ্গে আসেন বর্তমান চেয়ারম্যান অং ক চিন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা চলে যাওয়ার পর তিনি তাঁকেসহ গ্রামবাসীকে কথা দেন, তাঁদের গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে না। ঘরে আগুন দেবে না সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ কথা বলে তিনি সেদিন চলে যান। এর দুই দিন পর তিনি আবার আসেন গ্রামে। তুলাতুলি, দিয়েলতলি ও হোয়াইকংয়ের সব বয়সী নারী-পুরুষকে চরপাড়া নামক স্থানে জড়ো হতে বলেন। এরপর সেদিন সবাই ভোরবেলা সেখানে জড়ো হয়। এরপর চেয়ারম্যান অং ক চিন এক হাজারের বেশি সেনাসদস্যকে নিয়ে সেখানে হাজির হন। এরপর শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। তুলাতুলি গ্রামের মোহাম্মদ আমিনের (৪০) স্ত্রী আরাফা বেগমসহ পরিবারের সাত সদস্যকে হত্যা করা হয়। একই গ্রামের ফজল আহম্মেদসহ (৫৫) তাঁর পরিবারের ছয় সদস্য, মোঃ রফিকের (৪০) পরিবারের চার সদস্য, খায়রুল আমিনের (৪২) আট সদস্য, নুর হোসেন (৬০), আহসান আলম (৫০), কামাল হোসেনসহ (৫০) ১২ পরিবারের সবাইকে সেদিন খুন করা হয়। একইভাবে মিয়ানমারের বুথিডংয়ের নাতিডং গ্রামের ২০০-এর বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়।

এ ছাড়া মংডুর গারতিবিল, বলিবাজার, বড়চরা, নাড়িরবিল, টমবাজার, খুল্লুং, হাসুরতা, রাজারবিল, জীবনখালি গ্রামে এবং বুথিডংয়ের খুন্দু প্রাং, দক্ষিণ ফাতিয়া গ্রামে ৩০০-এর বেশি নিরীহ রোহিঙ্গা খুন হয়। নিহত এসব পরিবারের স্বজনেরা আছে আশ্রয়েকেন্দে। সেনাসদস্যরাই নির্যাতনের পেছনে স্বজন হারানো এসব প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রোহিঙ্গাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে যারা অংশ নিয়েছে, তাদের প্রায় সবাই ছিল সেনাপোশাক পরা। মিয়ানমারের মংডুর তুলাতুলি গ্রামের বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বললেন, তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া সবাই সেনাপোশাকে ছিল। রাখাইন রাজ্যের বুথিডংয়ের চৌ পরাং গ্রামের বাসিন্দা রাবেয়া বেগমের স্বামী ইদ্রিসকে মেরে ফেলা হয়। কক্সবাজারের উখিয়ার থ্যাংখালী রোহিঙ্গা আশ্রয়েকেন্দ্রে থাকা রাবেয়া বেগম বলেন, গ্রাম ঘিরে ফেলে সেনাসদস্যরা। তারা নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। তারা তাঁর স্বামীকে হত্যা করে। মংডুর লংদুম গ্রমের বিলকিস বেগমের মেয়ে মোহসিনাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। তিনি বলছিলেন, তাঁর গ্রামের অন্তত ১২ জন নারীকে ধর্ষণের পর ঘরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া খুন হওয়া বেশির ভাগ রোহিঙ্গা শিশুকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করে খুন করে সেনাসদস্যরা। রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন মাস ধরে কোনো রোহিঙ্গা তার গ্রামের এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যেতে পারেনি। সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরতে হতো। সীমান্তের তল্লাশিচৌকিতে হামলার পর গণহারে হত্যা করা হবে, তা তাদের ধারণাতেই ছিল না। নাতিডং গ্রামের সচেতন রোহিঙ্গা নাগরিক মোহাম্মদ ইসমাইলের সঙ্গে কথা হয় টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এলাকার রাস্তায়। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় তাঁর গ্রামের দুজন খুন হয়।

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রধানসহ বহিঃবিশ্বে জনমত গঠন করে চলেছেন। যার ফলে শেখ হাসিনাকে মাদার অব হিউম্যানিটি ঘোষণা করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২৩ অক্টোবর মিয়ানমার সফরের উদ্যেগ গ্রহন করেছেন। বিশ্ব ব্যাংক ইতিমধ্যে শর্তসাপেক্ষে ঋণ প্রধানের কথা ঘোষণা করেছেন।

অপর দিকে মিয়ানমারের সেনা প্রধান এখনও বলে চলেছেন- রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরীক নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সবধরনের মানবতা লঙ্ঘনকারী মিয়ানমারকে রুখবে কে?



  
  সর্বশেষ
চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়েতে কুকুর-শিয়ালের উৎপাত, ঝুঁকিতে বিমান অবতরণ-উড্ডয়ন
সাতক্ষীরায় বিজিবির অভিযানে সাড়ে ৩ লক্ষাধিক টাকার ভারতীয় মাদকসহ বিভিন্ন মালামাল জব্দ
রাণীশংকৈল সীমান্ত থেকে ৪ বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ
কক্সবাজারে কৃষি কার্যক্রম পরিদর্শন করলেন অতিরিক্ত সচিব

Md Reaz Uddin Editor & Publisher
Editorial Office
Kabbokosh Bhabon, Level-5, Suite#18, Kawran Bazar, Dhaka-1215.
E-mail:manabadhikarkhabar11@gmail.com
Tel:+88-02-41010307
Mobile: +8801978882223 Fax: +88-02-41010308