মঙ্গলবার, মে ১৪, ২০২৪
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
শিরোনাম : * শ্রীপুরে চেয়ারম্যান প্রার্থী জলিলের পক্ষে গণসংযোগ-প্রচার   * ট্রেনে কাটা পড়ে গাজীপুরে প্রাণ গেল জনের   * চাঁদপুরে নিষিদ্ধ জালে মাছ ধরায় ১৪ জেলে গ্রেফতার ;   * চট্টগ্রামে ৩০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি, সাবেক মন্ত্রীর ৪ ছেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা   * পা দিয়ে লিখে জিপিএ-৫ পেল সীতাকুণ্ডের মেধাবী ছাত্র রাব্বি   * চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরের টয়লেট থেকে ৭০ লাখ টাকা মূল্যের সোনা উদ্ধার;   * চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে এয়ার অ্যারাবিয়ার ফ্লাইটে ত্রুটি, শারজাহগামী ১৬৪ জন যাত্রী হোটেলে   * চট্টগ্রাম বোর্ডে এবারও শীর্ষে বন্দর নগরীর স্কুলগুলো   * চট্টগ্রাম বন্দরে মিথ্যা ঘোষণায় মোবাইল চার্জার এর পরিবর্তে ল্যাপটপ   * চিতলমারীতে বিশ “মা” দিবস পালিত  

   প্রচ্ছদ
মানুষের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনন্য দৃষ্টান্ত
  Date : 24-03-2019

ঘরে ঘরে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেয়ার ব্যতিক্রমধর্মী
আন্দোলনে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

 

“একটি দেশ ও জাতীর উন্নতির পেছনে সবচাইতে বড় শক্তি হচ্ছে শিক্ষা।
যে জাতী যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি-গোষ্ঠীর
উন্নয়ন হয়েছে কিংবা ভালো সমাজ গড়তে পেরেছে সমগ্র বিশ্বে এমন নজীর একটি
পাওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে দেখা যায় যে সমাজ শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পেরেছে
সেই সমাজের অবন্থান উন্নতির শিখরে। কেবল আর্থ-সামাজিক নয় চিন্তা-চেতনা
বা মানবিক উন্নয়নেও জ্ঞান তথা শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।”

সৈয়দ সফি
শিক্ষা মানুষের জন্মগত ও নাগরিক অধিকার। জন্মগতভাবে মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক অধিকার রয়েছে শিক্ষা তার অন্যতম। আর সেই অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঘরে ঘরে শিক্ষা বা জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেয়ার জন্য এক প্রকার একক প্রচেষ্টায় ব্যতিক্রমধর্মী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন দেশ বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
আলোকিত মানুষ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে চল্লিশ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। তার গঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য দেশের মানুষের চিত্তের সামগ্রিক আলোকায়ন ঘটানো। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষকে উজ্জিবিত করার পাশাপাশি শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ক’দিন আগে বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালিত হলো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র-এর ৪০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান।
একটি দেশ ও জাতীর উন্নতির পেছনে সবচাইতে বড় শক্তি হচ্ছে শিক্ষা। যে জাতী যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি-গোষ্ঠীর উন্নয়ন হয়েছে কিংবা ভালো সমাজ গড়তে পেরেছে সমগ্র বিশে^ এমন নজীর একটি পাওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে দেখা যায় যে সমাজ শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পেরেছে, সেই সমাজের অবন্থান উন্নতির শিখরে। কেবল আর্থ-সামাজিক নয় চিন্তা-চেতনা বা মানবিক উন্নয়নেও জ্ঞান তথা শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। জ্ঞান বা শিক্ষা অর্জনের জন্য পারিবারিক, সামাজিক, ভ্রমনসহ নানাবিধ উপায় রয়েছে। তবে,অন্যতম প্রধান মাধ্যম হচ্ছে পড়াশুনা করা। পড়াশুনার মধ্যদিয়েও অজানাকে জানতে পারে মানুষ। জানতে পারে হাজার বছরের ইতিহাস।
নিজেকে গড়ে তুলতে পারে শিক্ষিত, জ্ঞানী ও আলোকিত মানুষ হিসেবে। আর তাই, চল্লিশ বছর আগে বই পড়ায় উৎসাহিত করার মধ্যদিয়ে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষানুরাগী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সেদিনের সেই ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু করা আন্দোলন আজ ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এখন আর একজন ব্যক্তি নন তিনি যেন একটি জ্ঞানের ভা-ার, একটি আলোকিত প্রতিষ্ঠান। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ও শিক্ষানুরাগী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নামটি একই সূত্রে গাঁথা। দেশের সামাজিক ও জাতীয় জীবনে শ্রেনীভেদে অনেকে অনেক অবদান রেখেছেন এবং রাখছেন। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কত বড় কাজ করে যাচ্ছেন সে কথা এই মূহুর্তে অনুধাবন করতে না পারলেও এক সময় জাতিকে ঠিকই স্বরণ করতে হবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য তার জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা অপরিহার্য। কিন্তু সামর্থর অভাবে অনুন্নোত বা উন্নয়নশীল অনেক দেশের সরকারের একার পক্ষে সব কাজ করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। যে কারণে সামর্থবান ও সমাজ সচেতন মানুষদেরকেও অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হয়। আর শিক্ষার আলো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার মতো গুরু দায়িত্ব কাধেঁ নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
দিন কয়েক আগে প্রাণের প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, আমাদের একটি বড় ও গৌরবময় জাতি চাই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি চাই। সে লক্ষ্য নিয়েই বিশ^সাহিত্য কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে আলোকিত হতেই হবে।
তিনি বলেন, ‘৪০ বছর আগে আমাদের স্বপ্নের জায়গা ছিল- সারাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে আমরা আলো পৌঁছে দিতে চাই। সেই জন্য তারা যদি নিজে আসে তো খুব ভালো। আর যদি না আসে আমরা তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আলো দিয়ে আসব।
একটা কুঁড়িকে দেখে যেমন পুরো প্রস্ফূটিতফুলকে ভাবা খুবই কঠিন, তেমনি ৪০ বছর আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শুরুটা হয়েছিল, কুঁড়িটা হয়েছিল। কিন্তু এভাবে এত বড় হবে এটা ভাবিনি। তবে, আমি বিশ্বাস করি আরও বড় হবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। স্বরণীয় ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি ৪০ বছর আগে একবার লিখেছিলাম যে একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলাদেশ হবে। এটা শুনে সবাই তখন মুখ টিপে হেসেছিল। তারা ভেবেছিল আমি এতে বুঝাচ্ছি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইট-কাঠ সব বাংলাদেশ হবে। কিন্তু সেটা নয়। আমি বলতে চেয়েছিলাম- আমরা যে আজকে আলোকিত মানুষের স্বপ্ন দেখেছি, উন্নত মানুষের স্বপ্ন দেখেছি, একদিন সারা জাতিকে সেই স্বপ্ন দেখতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের একটা বড় জাতি চাই, একটা গৌরবময় জাতি চাই, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি চাই। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভবিষ্যত নেতৃত্ব প্রসঙ্গ তিনি বলেন, ভেতরেভেতরে আমরা একটা পরিচালনাকাঠামো তৈরি করেছি। এখন চেষ্টা করছি তাকে এমন একটা পরিশীলনের মধ্যে আনতে, যাতে আমি না থাকলেও কেন্দ্র তার নিজস্ব গতিতেই এগোতে পারে। এখন এটাই আমার মূল চেষ্টা। মানুষ প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনার পরে কেন্দ্র চালাবে কে? আমি হেসে উত্তর দিই, কেন, সবাই মিলে চালাবে। গোটা দেশ মিলে চালাবে। বয়সের ভারে শারিরীকভাবে কিছুটা দূর্বল হলেও মানসিক শক্তির দিক থেকে অটল রয়েছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় :
১৯৩৯ সালের ২৫ জুলাই কোলকাতার পার্ক সার্কাসে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্ম। তাঁর পৈত্রিক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়াা থানার কামারগাতি গ্রামে। পিতার নাম আযীমউদ্দিন আহমদ। পিতা ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। মাতা বেগম করিমউন্নিসা। ১৯৫৫ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশুনা শেষ পেশা হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতাকে।১৯৬১ সালে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খ-কালীন প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি কিছুকাল সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিল তিনি রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সরকারি চাকুরিজীবন শুরু করেন। সেখানে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে যোগ দেন (বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজ)। এই কলেজে তিনি দু` বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেইশ বছর। এরপর তিনি ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রনে সেখানে যোগদান করেন। আবু সায়ীদ যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শওকত ওসমান৷তিনি ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন হয়, তিনি ছিলেন তাঁর নেতৃত্বে। সাহিত্য পত্রিকা কণ্ঠস্বর সম্পাদনার মাধ্যমে সেকালের নবীন সাহিত্যযাত্রাকে তিনি নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে সংহত ও বেগবান করে রেখেছিলেন এক দশক ধরে। বাংলাদেশের টেলিভিশনের সূচনাল্লœ থেকে মনস্বী, রুচিমান ও বিনোদন-সক্ষম ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। টেলিভিশনের বিনোদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় তিনি পথিকৃত ও অন্যতম সফল ব্যক্তিত্ব। এসব ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সাহিত্যচর্চায় নিবিষ্ট। কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, নাটক, অনুবাদ, জার্নাল, জীবনীমূলক বই ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থভারও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ৫৭টি। ১৯৭৮ সালে মাত্র পনেরো জন সদস্য নিয়ে ছোট্ট আয়োজনে শুরু করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নামের পাঠচক্র। যার ব্যাপ্তি আজ সারা দেশ জুড়ে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে, একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পদক, রোটারি সিড পুরস্কার, রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার, পরিবেশ পদক, জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার, বাংলাদেশ বুক ক্লাব পুরস্কার, ডা. ইব্রাহীম স্মৃতি স্বর্ণপদক, চ্যানেল আই আনন্দ আলো পুরস্কার, মাহবুব উল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার, কাজী আজাহার আলী স্মৃতি স্বর্ণপদক ও এম এ হক ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক প্রভৃতি।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র-এর পেছনের কথা :
সময়টা ১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর । ঢাকা কলেজের পেছনে শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্রের ছোট্ট মিলনায়তনটিতে শুরু হয় পাঠচক্র। সদস্য সংখ্যা মাত্র পনেরো। ঠিক হয় প্রতি সপ্তাহে তারা প্রত্যেকে একটি নির্ধারিত বই এখান থেকে বাড়ি নিয়ে পড়ে পরের সপ্তাহের এই দিনে এখানে এসে মিলিত হবে এক তপ্ত মুখর অন্তরঙ্গ আলোচনায়। বইগুলোর ভেতর লেখকদের যে আত্মার আলো জ্বলছে তার সঙ্গে নিজেদের বহুমুখী বোধের আলো মিশিয়ে তারা জেগে উঠবে উচ্চতর মানবিক সমৃদ্ধির দিকে। পাঁচ বছর পর এই পাঠচক্রের আশাতীত সাফল্য দেখে চিন্তা এল জীবন-বোধের বিকাশে এ যখন এতটাই ফলপ্রসূ তখন কেন নয় দেশের প্রতিটি স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সবখানে এমনই ধরনের চক্র এমনি হাজার হাজার পাঠচক্রের মাতাল আনন্দে দেশের কিশোর তরুণ থেকে প্রতিটি আলোক প্রত্যাশী মানুষকে জড়িয়ে ফেলা। এভাবেই দিন যত গড়িয়েছে ততটায় এগিয়ে গেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কোনো গৎ-বাঁধা, ছক-কাটা, প্রাণহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সপ্রাণ সজীব পরিবেশ- জ্ঞান ও জীবনসংগ্রামের ভেতর দিয়ে পূর্ণতর মনুষ্যত্বে ও উন্নততর আনন্দে

জেগে ওঠার এক অবারিত পৃথিবী। এক কথায়, যাঁরা সংস্কৃতিবান, কার্যকর, ঋদ্ধ মানুষ- যাঁরা অনুসন্ধিৎসু, সৌন্দর্যপ্রবণ, সত্যান্বেষী, যাঁরা জ্ঞানার্থী, সক্রিয়, সৃজনশীল ও মানবকল্যাণে সংশপ্তক- `বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র` তাঁদের পদপাতে, মানসবাণিজ্যে, বন্ধুতায়, উষ্ণতায় সচকিত একটি অঙ্গন। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা শুরু হলেও আজ সারাদেশে, এমনকি দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে এর কর্মকা-। বহুধা বিস্তৃত এই কর্মকা-ের নানা আঙ্গিক সময়ে সময়ে বদলেছে। এখানকার অর্থযোগের চেহারা পাল্টেছে। ব্যবস্থাপনার মান পরিবর্তিত হয়েছে। প্রযুক্তি আর পেশাদারিত্বে পরিবর্তন এসেছে। বহু পুরনো মানুষকে কেন্দ্র ছেড়েছে, অনেক নতুন মানুষ এখানে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্বপ্ন আরও বড় হয়েছে। জনভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র্র। বই পাঠের মধ্য দিয়ে হৃদয়ের আলোকায়ন ঘটিয়ে উন্নততর জীবনসন্ধানী একদল মানুষ তৈরি হবে, তারাই বদলে দেবে বাংলাদেশ, এই লক্ষ্যে ৪০ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন, নিদ্রাহীন কর্মে জাগ্রত আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তার মতো করে। দুরুহ যন্ত্রণাজাত একটি অলীক ভাবনাকে বাস্তব রুপ দিতে যে শ্রম, নিষ্ঠা অধ্যবসায়, কষ্টস্বীকার করা লাগে, তা অব্যাহত রেখেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অগণন কর্মী, সুহৃদ, শুভানুধ্যায়ী, স্বেচ্ছাসেবী, আত্ম্যোাৎসর্গিত প্রাণ। আর এই জাগ্রত-উৎসাহী-প্রাণবান-স্বপ্নস্পর্ধিত দলের নেতা হিসেবে এখনও সমানতালে এগিয়ে চলেছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
ব্রত-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য :
অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আত্মদানের ভিতর দিয়ে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। আজ তার নির্মাণের পর্ব। এই নির্মাণকে অর্থময় করার জন্যে আজ দেশে চাই অনেক সম্পন্ন মানুষ, সেইসব মানুষ যারা উচ্চ-মূল্যবোধসম্পন্ন, আলোকিত, উদার, শক্তিমান ও কার্যকর- যারা জাতীয়-জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে শক্তিমান নেতৃত্ব দিয়ে এই জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে পারবে। তাদের আজ পেতে হবে আমাদের বিপুল সংখ্যায়-সারা দেশে, সবখানে। এককে-দশকে নয়, সহ¯্র,ে লক্ষে। আর কেবল সংখ্যায় পেলেই চলবে না- তাদের পেতে হবে একত্রিত ও সমবেত আয়োজনে। তাদের গ্রথিত করতে হবে শক্তিশালী সংঘবদ্ধতায়, উত্থান ঘটাতে হবে জাতীয়

শক্তি হিসেবে। জাতীয় জীবনে উচ্চায়ত চৈতন্য ও আলোকের পদপাত আজ ঘটাতেই হবে আমাদের যদি একটি বড় দেশ আর বড় জাতি গড়ার কথা আমরা ভাবি। ক্ষুদ্র মানুষ আর বড় জাতি একসঙ্গে হতে পারে না। কিন্তু একটি জাতির বৈষয়িক প্রবৃদ্ধির মতো তার চিত্তের সমৃদ্ধি রাতারাতি ঘটানোর কোনো পথ নেই। আত্মিক বিকাশের গতি চিরকাল মন্থর দীর্ঘমেয়াদি ও রহস্যময়। মানবজীবনের চেতন-অবচেতনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও অসংখ্য ছায়াঢাকা অনুষঙ্গের অন্ধকার পথে তার যাত্রা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আজকের স্বপ্ন, চেষ্টা ও আয়োজনের পথ ধরে আগামীতে যদি দেশের সবখানে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রদীপের মতো উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত, আলোকিত সন্তানেরা জন্ম নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে, তবে, অনেক পরে, একদিন, ওইসব মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, উদার ও প্রগতিশীল মানুষের উৎকর্ষম-িত বেদনাবান হৃদয়, নিজ-নিজ কর্মজীবনের বিচিত্র উদ্যোগ ও নির্মাণের ভেতর দিয়ে যে-দেশ ও জাতিকে রচনা করবে তা সমৃদ্ধতর হবে বলেই আশা। সারা দেশের সবখানে পর্যাপ্ত সংখ্যায় এইসব আলোকিত, কার্যকর ও উচ্চমূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করা, জাতীয় শক্তি হিশেবে তাদের সংঘবদ্ধ ও সমুন্নত করা এবং এরই পাশাপাশি দেশের মানুষের চিত্তের সামগ্রিক আলোকায়ন ঘটানো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য।
চল্লিশ বছর পূর্তিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বর্ণাঢ্য আয়োজন :
বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পালন করল ৪০ বছর পূর্তি। হাজারো আমন্ত্রিত অতিথি, বর্ণিল সাজসজ্জা, র‌্যালি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। ঢাকার বাংলামটরে অবস্থিত কেন্দ্রটির প্রধান কার্যালয়। বিকালে দেখা যায়, প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে কার্যালয় আঙিনা পর্যন্ত দুপাশের দেয়ালে রংবেরংয়ের ক্যানভাস। আঙিনায় রঙিন আলপনা। ভবনের ভেতরে-বাইরেও রঙিন সাজ। আগতদের বেশিরভাগ দেশীয় পোশাকে সেজেছেন। মেয়েদের খোঁপায় ফুল, পরনে লাল হলুদ শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি। হাত ভর্তি চুড়ি, গলায় মালা, কপালে বড় টিপ। ছেলেদের পরনে পাঞ্জাবি-পায়জামা। সকালে শাহবাগ থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র্র। যা বাংলামটরস্থ প্রধান কার্যালয়ে এসে শেষ হয়।

র‌্যালির নেতৃত্ব দেন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। এ ছাড়াও ছিলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, লোকসঙ্গীত গবেষক মোস্তফা জামান আব্বাসী, টিআইবির চেয়ারম্যান ড. ইফতেখারুজ্জামান, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, আইএফআইসি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ট্রাাস্টি এম শাহ আলম সরোয়ার প্রমুখ। র‌্যালি শেষে দিনব্যাপী চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কণ্ঠশিল্পী কিরণ চন্দ্র রায়, প্রিয়াংকা গোপ, চন্দনা মজুমদারসহ প্রায় ৫০ জনেরও বেশি শিল্পী মাতিয়ে রাখেন মঞ্চ। গানের ফাঁকে ফাঁকে চলে গৌড়িয়, মনিপুরী, কত্থকসহ বিভিন্ন ধরনের নাচ। ফাঁকে ফাঁকে চলে আলোচনাও। উৎসবে প্রায় ৩০ হাজার অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদের আপ্যায়নের জন্য বাঙালিয়ানা ধাঁচে পরিবেশন করা হয় দেশিয় সব খাবার। আকর্ষণীয় বাঁশের ঝুঁড়িতে করে অতিথিদের হাতে তুলে দেয়া হয় পাটিসাপটা, তেলের পিঠা, সিঙ্গারা, কদমা, খই, চিড়ার মোয়া, নিমকপাড়া, মুরালি, নকুলদানা, দানাদার, গজা, জিলিপিসহ আরও কিছু খাবার। অনুষ্ঠানে সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আমরা পাইনি আমাদের ছেলে- মেয়েরা পেয়েছে। আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সদস্য ছিল। ও বর্তমানে প্রবাসী। দেশে আসলে অন্তত একবার হলেও ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আসে। প্রবাসে থাকলেও ওর সাহিত্যজ্ঞান এবং সংস্কৃতি প্রীতি ওর ভালবাসা তৈরি করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আলোকিত মানুষ গড়ার যে উদ্যোগ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার নিয়েছিলেন তা দেশ গড়ার প্রত্যয়ে অত্যন্ত দূরদর্শী একটি ভূমিকা ছিল। আজ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আমাদের কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ তরুণীদের সুন্দর মন গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ার বলেন, প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং আমার স্ত্রী সহপাঠী ছিলেন। আমরা তখন আলোচনা করতাম যে, কী করা যায়। তখন ছিল পাকিস্তান আমল। বাংলা সংস্কৃতির বিকাশকে তখন নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার প্রচেষ্টা চলছিল।
এর মধ্যে আমি আর্ট কলেজে পড়তে গেলাম। জয়নুল আবেদিন সাহেব আমাকে বলেছিলেন, তুমি কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে পাস করেই চলে এসো। আমি যখন এলাম তখন দেখলাম এখানে যারা ছাত্র তারা শুধুই চুপচাপ করে ছবি আঁকে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কিংবা সংস্কৃতির সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি ওদেরকে বললাম- শুধু ছবি আঁকলেই তো হবে না, তোমাকে দেখতে হবে, জানতে হবে অনেক কিছু। তবেই তোমার মন প্রস্ফুটিত হবে এবং তোমার ভাবনা প্রসারিত হবে। আর্ট মানে তো শুধু ছবি আঁকাকেই বুঝায় না, এর সঙ্গে সাহিত্য, দর্শন, চলচ্চিত্র বহুকিছু আছে। এসব কিছু নিয়েই আমাদের সংস্কৃতি গঠিত। আমি আর্ট কলেজে প্রথম বসস্ত উৎসব করলাম, এরপরে একটি নাটক করলাম ডাকঘর। এরপর টেলিভিশনে আমার সায়ীদের সঙ্গে দেখা। সায়ীদ যখন টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করে তখন ওর বাসায় টেলিভিশন কেনার মতো অবস্থা ছিল না। তিনি বলেন, মানুষের উপকার করব, এই চিন্তা নয়, আমি উপকৃত হব, এই চিন্তা থেকে কাজ করলেই হয়। দায়বদ্ধতা নয়, কাজ করার আনন্দ নিয়ে কাজ করতে হবে। আমিই আমার উপকার করব। ভাল লাগা, এটা করতে ভাল লাগে তাই করছি। সায়ীদ যেটা করেছে। এখানে প্রগাঢ় একটা অনুভূতি কাজ করছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আরো অনেক দূর এগিয়ে যাক এই কামনা করি।ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এমন একটা প্রতিষ্ঠান যেটার কোনো তুলনা নাই। এখন সারা পৃথিবীর সব থেকে বড় সমস্যা হল কেউ বই পড়ে না।
আমাদের দেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এককভাবে এই কাজই করে যাচ্ছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যে ৪০ বছর পূর্তি হয়ে গেল, আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না। মনে হয়, যেন এই তো সেদিন।

এমন অসংখ্য ৪০ বছর পূর্ণ করুক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, এটাই চাই। আমি যদি দেখি, কোনও ছেলে বা মেয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যায়, তবে ওর সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা হয়। এমন অসংখ্য ভালো ছেলেমেয়ে তৈরি করুক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। উৎসব উপলক্ষে চারুশিল্পী মিলন রায়ের নেতৃত্বে একঝাঁক স্বেচ্ছাসেবী শিল্পী মাসব্যাপী কেন্দ্রকে সাজিয়ে তোলে মনোমুগ্ধকর রুপে। দেয়াল পেইন্টিং, ক্যানভাস, আলপনায় বর্ণিল করে তোলা হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। প্রবেশদ্বারে নির্মাণ করা হয় চমৎকার একটি তোরণ। এছাড়া কেন্দ্রের পুরাতন বিল্ডিংয়ের রেপ্লিকাসহ নানান রকম কারুশিল্পে সাজিয়ে তোলে উৎসব স্থল। এতে ব্যবহার করা হয় কাগজের ফুল, পমপম বল, মাটির হাড়ি, মটকি, মঙ্গল প্রদীপসহ লোকজ সব উপকরণ। সন্ধ্যার পর ঝলমলে আলোকসজ্জায় দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে কেন্দ্র।



  
  সর্বশেষ
শ্রীপুরে চেয়ারম্যান প্রার্থী জলিলের পক্ষে গণসংযোগ-প্রচার
ট্রেনে কাটা পড়ে গাজীপুরে প্রাণ গেল জনের
চাঁদপুরে নিষিদ্ধ জালে মাছ ধরায় ১৪ জেলে গ্রেফতার ;
চট্টগ্রামে ৩০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি, সাবেক মন্ত্রীর ৪ ছেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

Md Reaz Uddin Editor & Publisher
Editorial Office
Kabbokosh Bhabon, Level-5, Suite#18, Kawran Bazar, Dhaka-1215.
E-mail:manabadhikarkhabar11@gmail.com
Tel:+88-02-41010307
Mobile: +8801978882223 Fax: +88-02-41010308