ইলিয়াস সাগর তালুকদার
রাত তখন ৩ টা হঠাৎ করে একটি ফোন। ফোনটি ধরা হল না। আবারও ফোন, দ্বিতীয়বারে ফোনটি ধরার সাথে সাথে মহিলা কণ্ঠের কান্নার শব্দ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেই চলছেন আমি মনে হয় আর বাচব না। আমাকে কারা যেন এসিড মেরে পুড়িয়ে দিয়েছে। কথাগুলো মানবাধিকার খবরকে বলছিলেন এসিড সন্ত্রাসের শিকার শিলা মল্লিক(৩৩)।
রাজৈর উপজেলার আড়–য়াকান্দি গ্রামে গত ২৭ ডিসেম্বর রাত পৌনে ১২টার দিকে গৃহবধূ শিলা রাণী মল্লিকের (৩২) ওপর সন্ত্রাসীরা এসিড নিক্ষেপ করেছে। এতে শিলা রাণী মল্লিকের বাম হাতসহ শরীরের কিছু অংশ এসিডে পুড়ে গেছে। শিলা মল্লিক এসিড সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার পর পরই ঐদিন রাতে বিষয়টি মানবাধিকার খবরকে জানায়। মানবাধিকার খবরের পক্ষ থেকে তাৎক্ষনিক রাজৈর থানা প্রশাসনকে অবগত করে। পরে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর সকালে শিলা মল্লিককে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, শীলা মল্লিক মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানাধীন আড়–য়াকান্দি গ্রামের ভূপেন্দ্রনাথ মল্লিকের স্ত্রী।
২০১০ সালের জানুয়ারী মাসে ভূপেন্দ্রনাথের পিতা অর্থাৎ শিলা মল্লিকের শশুর কমলাকান্ত মল্লিক পরলোকগমন করেন। পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে ভূপেন্দ্রনাথ মল্লিকের সাথে তার ভাইদের বিরোধ ছিল। এই বিরোধকে কেন্দ্র করে ২০১০ সালের ১৫ আগষ্ট ভূপেন্দ্রর ৩ ভাইসহ ১০/১২ জন সন্ত্রাসী রড, চাপাতি ও রামদা নিয়ে ভূপেন্দ্রর উপর হামলা চালায়। এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও পিটিয়ে মারাত্বক ভাবে যখম করে। সন্ত্রাসিরা তাকে মাথাসহ সারা শরীরে অর্ধশত ছুরিকাঘাত করে। ভূপেন্দ্রনাথের স্ত্রী শীলা মল্লিক বাদী হয়ে ৩ ভাই সহ কয়েকজনকে আসামী করে থানায় মামলা দায়ের করেন। থানায় মামলা করায় আসামীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
শীলা মল্লিককে তারা বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করে। শীলা মল্লিক সুবিচারের আশায় ৫ অক্টোবর ২০১০ তারিখে সরদার তমিজউদ্দিনের কাছে যান। তমিজউদ্দিন কোন সন্ত্রাসী দলের কোনো লিডার বা ক্যাডার নন। তিনি মাদারীপুর জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। সন্ত্রাসিরা অনেক কিছু করে। তারা ছিচকে ছিনতাই থেকে শুরু করে অর্থের জন্য মানুষকেও হত্যা করে। কিন্তু একজন পুলিশ সুপার সংশ্লিষ্ট জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখার স্বার্থে ভিকটিমকে আইনী সহায়তা প্রদানে যথাযথ ব্যবস্থা করবেন এটাই স্বাভাবিক। এস পি তমিজউদ্দিন শীলা মল্লিকের পরিচয় পেয়ে অগ্নিমূর্তি ধারন করেন। শীলা মল্লিককে তিনি মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। শীলা মল্লিক মামলা প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানালে এসপি তার চুল ধরে চড় থাপ্পর দেন। মামলাটি মিথ্যা ও বানোয়াট এই মর্মে একটি লিখিত বক্তব্য দিতে এসপি শীলা মল্লিককে বলেন। শীলা মল্লিক মিথ্যা লিখিত বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি প্রদান করেন। অস্বীকৃতির কথা শুনে এসপির মাথায় রক্ত চড়াও হয়। তিনি শীলা মল্লিককে লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করেন। একপর্যায়ে শীলামল্লিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফেরার পর এসপি তাকে সতর্ক করে দেন যদি এ ঘটনার জানাজানি হয় তবে তার স্বামীকে হত্যা করা হবে। আর সে ঘটনার কোন সাক্ষী থাকবে না। শীলা মল্লিক কোন চোর, ডাকাত বা কোনো অপরাধী নন। তাহলে কোন অপরাধে শীলা মল্লিককে ঘরের দরজা বন্ধ করে লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটানো হল? তাকে পিটিয়ে পিঠে, হাতে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতবিক্ষত করা হলো। একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন পদস্থ কর্মকর্র্তা কতৃক এমন নৃশংস কর্মকান্ড যেন আদিম যুগের বর্বরতাকেও হার মানায়।
পুলিশ সুপারের এমন বর্বরোচিত কর্মকান্ডের বিচারের দাবিতে দেশজুরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গত ২৮ অক্টোবর ২০১০ তারিখে মাদারীপুর হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও হিউম্যান বাংলাদেশ মাইনরিটির প্রতিনিধির জেলা প্রষাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিতে গেলে মাদারীপুর আইনজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পিপি অ্যাডভোকেট সুজিত চ্যাটার্জি বাধা দেয়। ফলে স্বারকলিপি দিতে পারেনি। স্বারকলিপি না দেওয়ার জন্য এসপির পক্ষ থেকে চাপ অব্যাহত থাকে। কিন্ত স্বারকলিপি দেয়ার সিন্ধান্তে মানবাধিকার কর্মিদের অটল থাকতে দেখে সুজিত চ্যাটার্জি তা কেড়ে নেয়। বিষয়টি কেন্দ্রিয় কমিটিকে জানানো হলে কেন্দ্রিয় কমিটি তাৎক্ষনিক সংবাদ সম্মেলন করে এবং স্বারকলিপি কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। কেন্দ্রিয় কমিটির পক্ষ থেকে সে স্বারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সংস্থা গ্লোবাল হিউম্যান রাইটসের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের অবজারভার এডভোকেট রবীন্দ্রঘোষ সহ সংগঠনের অপর দু’ সদস্য মাদারীপুরে যান এবং ঘটনার সরেজমিন তদন্ত করেন। এডভোকেট রবীন্দ্রঘোষ শিলা মল্লিককে পুলিশ সুপারের মুখোমুখি করেন। শীলা মল্লিক এস পির সামনে রবীন্দ্র ঘোষের উপস্থিতিতে এস পি কর্তৃক তার উপর বর্বরোচিত নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। গ্লোবাল হিউম্যান রাইটসের সহযোগিতায় ৪ জানুয়ারি ২০১১, শীলা মল্লিক উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরি ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মাদারীপুরের তৎকালীন এসপি সরদার তমিজউদ্দীন আহমেদ ও রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মশিউর রহমানকে ১৩ জানুয়ারী ২০১১ হাইকের্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। মাদারীপুরের এসপি ও রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আদালতে হাজির হলে বিজ্ঞ বিচারপতি এ.এইচ.এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ভিকটিম শীলা মল্লিক ও তার স্বামী ভূপেন্দ্রনাথ মল্লিকের উপস্থিতিতে এসপিকে তীব্র ভাষায় ভৎর্সনা করেন এবং সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত আদালতে দাড় করিয়ে রাখেন। পরে এসপির হয়ে আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তার আইনজীবি। বিজ্ঞ আদালত ক্ষমা না মঞ্জুর করে শুনানী অব্যাহত রাখেন। আর এরই মধ্য দিয়ে ভিকটিম শীলা মল্লিকের সংসারে ন্যায়ের আলোকরশ্মী পড়তে শুরু করলেও শত্রুরা তার পিছু ছাড়েনি। বর্তমানে শিলা মল্লিক মিরপুরে এসিড সার্ভাইব ফাউন্ডেশনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।
এসিডের শিকার শিলা রাণী মলি¬ক মানবাধিকার খবরকে বলেন, জমিজমা নিয়ে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আমার দেবর প্রণব মলি¬ক, ধন্য মলি¬ক, উত্তম মলি¬ক ও তাদের স্ত্রীরা মিলে ২৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টায় দিকে আমি পিঠা বানানোর সময় সিরিঞ্জ দিয়ে এসিড নিক্ষেপ করে তারা পালিয়ে যায়। আমি এ অপরাধের বিচার চাই। অপরদিকে অভিযুক্ত দেবর প্রণব মলি¬ক জানায়, জমিজমা-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মাদারীপুর জজকোর্টে একটি মামলা আছে। সেই মামলা ঠেকানোর জন্য শিলা মল্লিক এসিড শিকারের নাটক করেছে। সে নিজের গায়ে এসিড দিয়ে আমাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।
এ ঘটনা সম্পর্কে রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, থানায় মামলা হয়েছে। এখনও আসামীদের কেউ গ্রেফতার হয়ানি। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন অবস্থায় রয়েছে।