মানবাধিকার খবর প্রতিবেদন :
উপাচার্যের ক্ষমতাবলে বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষকদের সব ধরনের সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাইল ইসলাম। ১১ অক্টোবর শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টায় বুয়েট অডিটোরিয়ামে আবরার ফাহাদ স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠক শুরু হয়। এতে বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান, ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইয়াজ হোসেন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মাসুদসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনার শুরুতে ফাহাদ হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত সব আসামিকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান ভিসি। এ ঘটনায় মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ১৯ জন। ফাহাদের খুনিদের ফাঁসিসহ শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবি নিয়ে বুয়েটের ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ ব্যাচের সঙ্গে এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শর্ত অনুযায়ী, গণমাধ্যমের সামনে আলোচনা করতে রাজি না হলেও পরে উপাচার্য সাংবাদিকদের সামনে আলোচনা করতে রাজি হন। তবে তিনি বৈঠক সরাসরি সম্প্রচার না করার শর্ত জুড়ে দেন। সরেজমিনে দেখা যায়, বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেখে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের দশ দফা দাবিগুলো ছিল, খুনিদের শনাক্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, খুনিদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১১ অক্টোবরের মধ্যে আজীবন বহিষ্কার করতে হবে, আবরার হত্যা মামলার সব খরচ এবং ক্ষতিপূরণ বিশ্ববিদ্যালয়কে বহন করতে হবে, মামলা দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের অধীন স্বল্পতম সময়ে নিস্পত্তি করতে হবে, অবিলম্বে চার্জশিটের কপিসহ অফিসিয়াল নোটিশ দিতে হবে, বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে, ঘটনার পর ভিসি কেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি এবং ৩৮ ঘণ্টা পর গিয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের কাছে তার জবাব দিতে হবে, আবাসিক হলগুলোতে র্যাগের নামে এবং ভিন্নমত দমানোর নামে নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে, এ ধরনের ঘটনা প্রকাশে একটি কমন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে হবে, নিরাপত্তার জন্য সব হলের উইংয়ের দু’পাশে সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে এবং ১১ অক্টোবরের মধ্যে শেরেবাংলা হলের প্রভোস্টকে প্রত্যাহার করতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রথম দাবি নিয়ে ভিসি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। সব অভিযুক্তকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। সবকিছু প্রসিডিউরের মধ্যে হচ্ছে। যদি তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাহলে আমরা যদি কোর্টে হেরে যাই তাহলে সমস্যা। তাই এজহারভুক্ত ১৯ জনকে সাময়কি বহিষ্কার করা হলো। তা এখন থেকে কার্যকর করা হবে। বুয়েট প্রশাসনকে মামলা পর্যবেক্ষণের দাবিতে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা একমত। সরকারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সরকার আমাদের আশ্বস্ত করছেন। এ ব্যাপারে কোনো গাফিলতি করা হবে না। এ ব্যাপারে দ্রুত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা এ ব্যাপারে সরকারকে লিখিত দোবো। শুক্রবার হওয়ায় লিখিত দিতে পারিনি। চার্জশিটের অফিসিয়াল নোটিশ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চার্জশিটের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে সরকারকে জোর করতে পারবো না। তাছাড়া আইন নিজস্ব গতিতে কাজ করছে। চার্জশিট হাতে পেলে আমরা নোটিশে জানিয়ে দেবো। নির্যাতনের ঘটনা জানানোর জন্য কমন প্ল্যাটফর্মের বিষয়ে উপাচার্য জানান, আমি এ ব্যাপারে আইসিটি বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। এ সাইটের মধ্যে কি কি থাকতে হবে তা তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা করা হবে। এ প্রোগ্রামের জন্য এক সপ্তাহ সময় লাগবে। সবগুলো হলের উভয় পাশে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে।
উল্লেখ্য, ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর হাতে নির্দয় পিটুনির শিকার হয়ে মারা যান তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭ ব্যাচ) ছাত্র আবরার ফাহাদ। এ ঘটনায় নিহতের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্ত করতে ডিবিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পরদিন থেকে ১০ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে। এ মামলায় দু’দিনে ১৮ আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরমধ্যে ১৩ জনকে ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আটকরা হলেন- বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান রাসেল, সহ-সভাপতি মুহতামিম ফুয়াদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, উপ-সমাজকল্যাণ সম্পাদক ইফতি মোশারফ সকাল, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিওন, গ্রন্থনা ও গবেষণা সম্পাদক ইশতিয়াক মুন্না, মুনতাসির আল জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, মুজাহিদুর রহমান ও মেহেদী হাসান রবিন, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শামসুল আরেফিন রাফাত (২১), ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. মনিরুজ্জামান মনির (২১) ও একই ব্যাচের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মো. আকাশ হোসেন (২১)। তবে এ ঘটনায়
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান রাসেল, যুগ্ম-সম্পাদক মুহতাসিম ফুয়াদ, সাংগাঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক সেফায়েতুল ইসলাম জিওন, সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির, উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপদফতর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, ছাত্রলীগ সদস্য মুনতাসির আল জেমি, মুজাহিদুর রহমান ও এহতেমামুল রহমান রাব্বিকে বহিষ্কার করেছে।
জাতিসংঘের বিচার দাবি :
ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতার জেরে ছাত্রলীগের হাতে নির্মমভাবে নিহত বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো।
০৯ অক্টোবর ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ-ডিকাব আয়োজিত ডিকাব টক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো এ দাবি জানান।
রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-বিস মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ডিকাব টক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো বলেন, বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকা-ে আমরা ব্যথিত। এই হত্যাকা-ের আমরা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। এ বিষয়ে জাতিসংঘ থেকে একটি বিবৃতিও দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত হতবাক :
২০১৯-১০-১০
ঢাকা: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ নিহতের ঘটনায় সমবেদনা জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। ১০ অক্টোবর দূতাবাসের এক বার্তায় সমবেদনা জানান তিনি। বার্তায় মিলার বলেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যাকা-ের ঘটনায় আমি হতবাক ও মর্মাহত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেকোনো গণতন্ত্রের মৌলিক অধিকার। এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি তোলা সকল কণ্ঠস্বরের সঙ্গে আমরা একাত্ম ও তার পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি। ৬ অক্টোবর দিনগত রাতে বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) ছাত্র ফাহাদকে মারধর করে হত্যা করা হয়।
বিস্মিত ও মর্মাহত যুক্তরাজ্য :
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় বিস্মিত ও মর্মাহত বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য।
যুক্তরাজ্য হাইকমিশনের এক বার্তায় বলা হয়, বুয়েটে ঘটে যাওয়া ঘটনায় আমরা বিস্মিত ও মর্মাহত। যুক্তরাজ্য বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রসঙ্গে নিঃশর্তভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ফাহাদ। এর জের ধরে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। পরে তার লাশ সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়। এ ঘটনায় আবরারের বাবা ১৯ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। ।
মর্মাহত সুইজারল্যান্ড :
মানবজমিন ডেস্ক । ১২ অক্টোবর ২০১৯, শনিবার । সর্বশেষ আপডেট: ৯:০৮
বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছে বাংলাদেশস্থ সুইজারল্যান্ডের দূতাবাস। ৯ অক্টোবর তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পাতায় তারা এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। এতে তারা লিখেছে, বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র আবরার ফাহাদের বেদনাদায়ক মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত। বিবৃতিতে বলা হয়, সুইজারল্যান্ড বিশ্বের প্রতিটি মানুষের বাক স্বাধীনতা ও অধিকারের পক্ষে রয়েছে। আবরার হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবিও তুলেছে সুইজারল্যান্ড দূতাবাস। বলা হয়েছে,যারা মানবাধিকারের মৌলিক বিষয়গুলো লঙ্ঘন করে তাদেরকে আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।