পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিল আরো একটি বছর। ইংরেজি ২০১৮ সাল-এর পরিসমাপ্তি শেষে পা রেখেছে নতুন বছর ২০১৯ সালে-এ। স্বাগত ইংরেজি নববর্ষ ২০১৯। সাধারণভাবে বাংলাদেশে তিনটি সন প্রচলিত রয়েছে। হিজরি, বাংলা এবং ইংরেজি এই তিনটে সনের নববর্ষ আসে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। হিজরি নববর্ষ আসে জিলহজ মাসের সূর্য অস্ত গেলে ১ মহররমের চাঁদ উদয়ের মাধ্যমে, বাংলা নববর্ষ সূচিত হয় পহেলা বৈশাখের সূর্য উদিত হবার মধ্য দিয়ে আর ইংরেজি নববর্ষ সূচিত হয় ৩১ ডিসেম্বর রাত বারোটায় শীতের কুয়াশা ঘেরা চাদর মুড়ি দিয়ে। হিজরি নববর্ষ ও বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের মানুষকে যেমন ব্যাপক জানান দিয়ে আসে তেমন জানান দিয়ে না আসলেও শহরাঞ্চলে কিছুটা উৎসবের মধ্যদিয়ে স্বাগত জানানো হয় ইংরেজি নতুন বছরকে। এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক যোগাযোগ ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে একে অন্যের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় চলে আসছে। নতুন বছর মানেই পুরনোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলা। আশা আর স্বপ্নপূরণে প্রত্যয়ী হওয়া। অনেক কারণেই তাই, ২০১৮ সাল ছিল আলোচিত-সমালোচিত। ২০১৮ সালের একেবারে শেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়াও বিদায়ী বছর জুড়ে রয়েছে অনেক ঘটনা। রাজনৈতিক যোগ-বিয়োগ, রহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি সফলতাও এসেছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে। এর মধ্যে অন্যতম হল নিন্ম থেকে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্লাবে পদার্পণ এবং প্রবৃদ্ধির হার বাড়া ও তা ধরে রাখতে পারা। এর বাইরে নারী ক্ষমতায়নের কিছু সূচকে অনন্য অবস্থান,নারীর অগ্রযাত্রা, বিশেষত নারী ক্রিকেটে এশিয়া চ্যাম্পিয়ন, মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপসহ আরও কিছু আন্তর্জাতিক সাফল্য এসেছে। তবে, বছরের শেষে এসে নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত ১৮ জনের প্রাণহানি, তরুণদের একাধিক ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন ন্যক্কারজনকভাবে দমন উল্লেখযোগ্য। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের অভিযোগ থেকেও বের হওয়া যায়নি ২০১৮ সালে। এর বাইরে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অনিয়ম ও ঋণখেলাপির বিষয়টি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিদায়ী বছর ছিল মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক উত্তেজনায় ভরপুর। সিরিয়া ও ইয়েমেন যুদ্ধের পাশাপাশি বাড়তি উত্তেজনা জুগিয়েছে তুরস্কে সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকা-। বিষয়টি নিয়ে সৌদি আরব ও এর প্রভাবশালী যুবরাজ বছরের শেষপ্রান্তে ছিলেন আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে। তারপরও পুরনো বছরের ভুলভ্রান্তি ভুলে আরও এগিয়ে যেতে হবে আমাদেরকে। সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও উন্নত স্বদেশের প্রত্যাশায় দলমত নির্বিশেষে সকল বিভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে দেশবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। নতুন বছর আসুক নতুন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে। মানবাধিকার খবর-এর দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা লেখক-পাঠক, এজেন্ট, বিজ্ঞাপনদাতা,উপদেষ্টা পরিষদসহ শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি নতুন বছরের শুভেচ্ছা রইল।
বছরের একবারে শেষ প্রান্তে এসে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইসির ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সবকয়টি দল এবারের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে আওয়ামী লীগসহ ৫টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ২৭২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। জোটের প্রধান শরীক দল আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৬০টি আসনে ও বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে বিএনপিসহ ৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ২৮২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বাকী আসনগুলো ছেড়ে দেয় তাদের শরীকদের জন্য। ভোটের দিন বিক্ষিপ্ত সংঘাত ও সহিংসতায় ১৮ জনের প্রাণহানীর ঘটনা ছাড়া একপ্রকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় এই নির্বাচন। একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে গাইবান্ধা ৩ আসনে ভোট হয়নি। এই নির্বাচনে ২৯৯ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন পেয়ে বিশাল জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। বিপুল ভোটে এই রেকর্ড জয়ে টানা তৃতীয়বারের (হ্যাটট্রিক) মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন জোটটি। এই জয়ের ফলে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং নির্বাচনী প্রচারণায় দলের নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি মহাজোটের বড় ব্যবধানে জয়ী হওয়ার নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা এই জোট ইতিহাস সৃষ্টিকারী জয় পেলেও তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবি হয়েছে। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র চালুর পর এবারই প্রথম বিএনপি সবচেয়ে কম আসন পেয়েছে। দলটির বেশ কয়েকজন প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই বিশাল জয়ে “মানবাধিকার খবর” পরিবারের পক্ষ থেকে নির্বাচিত সবার প্রতি রইল আন্তরিক অভিনন্দন। নতুন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা দেশে ন্যায় বিচার ও সর্বত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুখী-সমৃদ্ধ সত্যিকার সোনার বাংলা উপহার দেবেন জাতীকে।
বিদায় বছরে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি, আর সেই বিষয়টি হচ্ছে, মানবাধিকার। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো ছিল এ কথা নিশ্চিত কওে বলা যাবে না। কারণ বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, গোপনে আটক রাখার গুরুতর অভিযোগসহ নানাবিধ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের অন্যতম মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এক প্রতিবেদনে বলেছে চলতি ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে বিচারবর্হির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন ৪২২ জন। এর মধ্যে ক্রসফায়ারে ৪১৫ জন, গুলিতে ২ জন এবং নির্যাতনে ৫ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া এই সময়ের মধ্যে গুমের শিকার হয়েছেন ৭১ জন এবং কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৫৭ জনের বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডবি¬উ) ২০১৮ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলছে আইন প্রয়োগকারীসংস্থাগুলো রাজনৈতিক বিরোধী ও সন্দেহভাজন জঙ্গিদের লক্ষ্য করে তৎপরতা অব্যাহত রাখায় অসংখ্য বাংলাদেশি গুমের শিকার হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীগুলো মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন অব্যাহত রেখেছে তারা জবাবদিহির বাইরে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অপর মানবাধিকার সংগঠন টম লান্টোস হিউম্যান রাইটস কমিশন (টিএলএইচআরসি) বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করে ২০১৮ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ২০০ জনেরও বেশি লোককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, নারী-শিশু বিশেষ করে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় বরাবরই বৈষম্যের মুখে রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে হিন্দুদের জমি অবৈধ দখল, তাদের মন্দির ও বাড়িঘরও ধ্বংস করা হয়েছে, যা বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে। ১৮ বছরের কম বয়সী ৫২ শতাংশ মেয়ের অমতে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় মানব পাচার, শিশু শ্রম ও শিশু অধিকারের বিষয়গুলো মোকাবেলা করার জন্য কার্যকর সুরক্ষা কৌশল বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।