‘নানান বরন মায়ের কোলে
নানান বরন পুত
নানান বরন মায়ের বুকে
একই বরন দুধ’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মায়ের দুধ
শিশুদের জন্য মায়ের দুধই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম, উপাদেয় ও উৎকৃষ্ট খাদ্য। এর কোন বিকল্প নেই, বা হতে পারে না। জন্মের পর থেকে শুরু করে কয়েক মাস একমাত্র খাবার হচ্ছে মায়ের দুধ। তার বাড়ন্ত দেহে যতুটুকু পুষ্টি, আমিষ, ¯েœহ, শর্করা এবং আরও অন্যান্য উপাদানের প্রয়োজন তা একমাত্র মায়ের দুধেই উপযুক্ত মাত্রায় ও বিশুদ্ধ অবস্থায়মজুদ রয়েছে। তাই মায়ের দুধই হচ্ছে শিশুর জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও আদর্শ খাবার। এর কোন বিকল্প নেই, হতে পারে না।
আমাদের দেশে বিজ্ঞাপন সমৃদ্ধ চকচকে চিনের ভিতর শিশু খাদ্য হিসেবে যেসব দুধ পাওয়া যায়, তা আসলে গরুর দুধ। গরুর দুধ থেকে মেশিনের মাধ্যমে পানি শুকিয়ে তরল দুধকে পাউডারে পরিনত করা হয়। তার পর এর সাথে যোগ করা হয় বিভিন্ন ধরণের খাবারের গুঁডো। উদ্দেশ্য এতে আরও বেশী পরিমান আমিষ, চর্বি ইত্যাদি মেশানো। এবং তারপরই বলা হয় এতে রয়েছে অনেক রকম ভিটামিন, লৌহ ইত্যাদি। আর বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় একটা তুলতুলে নাদুস নুদুস শিশু। সেই বিজ্ঞাপন দেখে আমরা ভুলে যাই মায়ের দুধের শ্রেষ্ঠত্বের কথা। অথচ একটু ভাবলেই বোঝা যাবে, সৃষ্টিকর্তা গরুর দুধ তৈরি করেছেন গরুর শিশু অর্থ্যাৎ বাছুরের জন্য। একটা মানুষের বাচ্চার সাথে গরুর বাছুরের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে বাচুর জন্ম নিয়েই দৌড় দেয়। সে বেড়ে ওঠে অনেক তাড়াতাড়ি, তার দেহ অনেক বড়। আর ঐ বাছুরের প্রয়োজন মেটাবার জন্য গরুর দুধেও আমিষ ¯েœহ, শর্করা লেীহ, ভিটামিন-ইত্যাদি মাত্রা থাকবে বাছুরের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী। অতএব ঐ দুধ কোন অবস্থাতেই মায়ের দুধের বিকল্প নয়, হতে পারে না। মায়ের দুধই শিশুর জন্য সর্বোৎকৃষ্ট, সর্বশ্রেষ্ঠ খাদ্য।
মায়ের দুধ শ্রেষ্ঠ কেন
মায়ের দুধ শিশুর জন্য তৈরি। গরু বা কৌটার দুধ শিশুর জন্য তৈরি হয়নি। তাই মায়ের দুধের বেশ কিছু বিশেষত্ব রয়েছে যা অন্য কোন দুধে থাকতে পারে না, সে কৃত্রিমউপায়ে যতই মায়ের দুধের মত করা হোক না কেন। নিচে মায়ের দুধের বিশেষত্বসমূহ সংক্ষেপে দেওয়া হলঃ
১। মায়ের দুধ সহজেই পাওয়া যায়, এ দুধ শিশুকে দেওয়ার জন্য কোন ঝামেলার দরকার হয় না। এ দুধের তাপমাত্রা সব সময়ই শিশুর খাওয়ার উপযোগী। তা ছাড়া এ দুধ সব সময়ই টাটকা এবং নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
২। মায়ের দুধপেতে হলে বাড়তি কোন খরচের দরকার হয় না। শিশু গর্ভে আসার পর এমনিতেই মাকে কিছু বাড়তি খাবার দিতে হয়। স্তনদানকালে শুধু সে পরিমানটা একটু বাড়িয়ে দিলেই চলে। এ বাড়তি খাবার বলতে যেমন দামী ডিম, দুধ, মাছ, মাংশ, মাখন, রুটি হতে পারে তেমনি ভাত, ডাল, শাক-সব্জিও হতে পারে। মোটের উপর, মা দুধের মাদ্যমে নিজের শরীর থেকে যে শক্তি হারাচ্ছেন অতিরিক্ত খাবারের মাধ্যেমে তা তার দেহে ফিরে এলেই হলো।
সুতারং দেখা যায, বোতলের দুধ এবং সেই সাথে বোতল, ব্রাশ, নিপল ইত্যাদি কেনার যে বিরাট খরচ, মায়ের দুধ দিলে তার দরকার হয় না।
৩। মায়ের দুধ খেলে শিশুরা বেশ কিছু রোগে আনুপাতিক হারে কম ভুগে থাকে যেমন-
ক) পেটের পীড়া ও পেটের অসুখ, তথা পাতলা পায়খানা। কারণ মায়ের দুধে যে ইম্যুনোগ্লব্যুলীন ও জীবানুণঅশক উপাদান রয়েছে, তারা এ সব রোগের জীবানুর হাত থেকে শিশুকে রক্ষা করে।
খ) মায়ের দুধ খেলে মিশুরা এ্যাজমা বা হাঁফানী রোগে আনুপাতিক হরে কম হয়।
গ) নবজাতককের টিট্যানী মায়ের দুধ খেলে কম হয়।
ঘ) পুষ্ঠিহীনতা। কারণ, ময়ের দুধেই আমিষ হচ্ছে শিশুর জন্য একমাত্র দরকারী আমিষ। আর পরিমান মত মজুদ থাকায় মায়ের দুধ খেলে পুষ্ঠিহীনতা দেখা দিতে পারে না।
ঙ) শিশুর বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ মায়ের দধি খেলে কমম হয়।
চ) গরুর দুধের প্রতি এলার্জি মায়ের দুধ খেলে কখনোই জন্ম নিতে পারে না।
৪। ময়ের দুধে রয়েছে নি¤œলিখিত কতগুলো আবশ্যকীয় উপাদান যা অন্য কোন দুধে নেই।
ক) এন্টিবডি বা রোগ-প্রতিরোধক আমিষ।
খ) বিশেষ এক ধরণের জীবানুনাষক কোষ।
গ) পাচক রস যা হজমে সহায়তা করে।
ঘ) কমপ্লিমেন্টস নামক দেহ-রক্ষী এক অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।
ঙ) ইন্টারফোরেন নামক জীবানু বিধ্বংসী এক আমিষ উৎপাদনকারী বিশেষ এক ধরনের কোষ।
চ) টরীন নামক এক অ্যামাইনো এসিড, যা শিশুর মস্তিস্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য দরকারী।
ছ) বিফিড ফ্যাক্টর, যা শিশুর খাদ্যনালীর ভিতর ল্যাকটোব্যাসিলাস বিফিডাস নামক এক জীবানু উৎপাদনে সহায়তা করে। এর ফলে খাদ্যনালীর রসের অম্লতা বেড়ে যায়। যা অন্য কোন রোগের জীবানুকে ধ্বংস করে এবং বংশ বিস্তারে বাধা প্রদান করে।