ছেলেটির নাম ইমন(ছদ্মনাম)। একাদশ শ্রেণীর ছাত্র সে। ভাল পড়াশুনা করার জন্য গ্রাম থেকে ঢাকায় পাঠানো হয় তাকে। তার বাবা একজন সাধারণ কৃষক। প্রতি মাসে মাসে ছেলেকে পড়াশুনার জন্য টাকা পাঠানো হয় বাড়ি থেকে। অভাবের সংসার এর পরেও ছেলের দাবি অনুয়ায়ী পড়াশুনার খরচসহ একটি দামি ফোনও কিনে দেয়া হয় তাকে। মা-বাবা জানে তাদের সন্তান ঢাকাতে ভাল পড়াশুনা করছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নরূপ। তাদের সন্তান পড়াশুনা করার বদলে মোবাইল ফোনে পরিচয়ের মাধ্যমে অন্য ধর্মের একটি মেয়ের সাথে গভীর প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। এখানে শুধু প্রেম করেই ক্ষান্ত নয়। সে মেয়েটিকে কোর্টের মাধ্যমে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়েছে। অথচ কিছুই জানেনা তার অভিভাবকেরা। একমাত্র সন্তানের এ ঘটনা জানতে পেরে তার মা-বাবা এখন পাগল প্রায়। এমন ঘটনা যেন এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।
বাগেরহাটের চিতলমারীতে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে এমন অসংখ্য মোবাইল প্রেমের ঘটনা এলাকায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। নাড়া দিয়েছে অভিভাবক মহলে। তাদের সন্তানরা পড়াশুনার বদলে কোন পথে যাচ্ছে এমনই প্রশ্ন এখন অনেকের।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, মোবাইল ফোনে প্রেমের ভয়ঙ্কর নানা কাহিনী। এতে দারুন ভাবে বিপথে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে তারা এক শ্রেনীর তরুণ-তরুণীরা। উপজেলার সাবোখালী গ্রামের এক কলেজছাত্রী সর্ম্পকে জানা যায়, সে মোবাইলে এক যুবকের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। এর পর ঐ যুবক এক পর্যায় তার সাথে প্রতারণা করলে মেয়েটি বিয়ের দাবিতে ওই প্রেমিক বাড়িতে অবস্থান নেন। তাকে ওই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলে তার মা পূনরায় এক প্রতিবেশি যুবককে কিছু টাকা দিয়ে তার মেয়েকে প্রেমিকের বাড়িতে রেখে আসার জন্য পাঠিয়ে দেন। এ সুযোগে প্রতিবেশি যুবক ওই মেয়েটিকে তার প্রেমিকের বাড়িতে পৌঁছে দেবার কথা বলে একটি নির্জন ঘরে তাকে আটকে রেখে বন্ধুদের নিয়ে সম্ভ্রমহানির চেষ্টা চালায়। পরে পুলিশ খবর পেয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করেছে। মেয়েটি ঘরে ফিরে লোক লজ্জার ভয়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে গত ৪-৫ দিন আগে আত্মহত্যার চেষ্টা চালালে অন্যরা টের পেয়ে তাকে উদ্ধার করেছে। বর্তমানে সে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।
এছাড়া উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামের ঝুমা নামে এক স্কুল ছাত্রী মোবাইলে প্রেম করে এখন বিপাকে পড়েছে। ঝুমার পরিবার ও প্রতিবেশিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫-৬ মাস আগে একই উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামের দেবেন মন্ডলের পুত্র তারাশংকরের সাথে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সন্তোষপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী ঝুমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পর থেকে তাদের মধ্যে চলে মন দেয়া-নেয়া । অল্প দিনের মধ্যে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তারা। এ অবস্থায় তারাশংকরের পরিবার বিষয়টি জানতে পেরে এ কাজে বাঁধ সাধে। কোন ভাবে বিষয়টি তারা মেনে নিতে রাজি নয়। এমন পরিস্থিতে গত চার-পাঁচ দিন আগে ঝুমা তারাশংকরের সাথে দেখা করতে বাড়ি থেকে বের হয়। এদিন সে আর বাড়িতে ফিরে না আসায় পরিবারের লোকজন খোঁজ নেন। পরে জানা যায়, ঝুমা ও তারাশংকর থানায় আছে। তাদের চলাফেরা সন্দেহ জনক হওয়ায় এলাকাবাসি তাদের থানায় সোপর্দ করেছে। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় ব্যাপক জানাজানি হলে ঝুমার পরিবার থেকে তারাশংকরের পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু তার পরিবার এ বিয়ে কোন ভাবেই মেনে নিতে রাজি নয়। এ পরিস্থিতে থানা থেকে বেরিয়ে ঝুমাকে রেখে তারাশংকর বর্তমানে গা ঢাকা দিয়েছে। লোকলজ্জার ভয়ে ঝুমা আর বাড়িতে ফিরে যেতে পারছে না। বিযের দাবিতে সে এখন এলাককার জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। আর এ দাবি আদায়ের জন্য গত তিনদিন ধরে অনশন করছে সে।
এ বিষয়ে অভিভাবক শ্রেণীর রবিউল ইসলাম খান জানান, আজকাল মোবাইল ফোন অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীর হতে দেখা যায়। তারা পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। দেখা যায় রাত জেগে ফোনে কথা বলে নতুবা ফেসবুক দেখে। তারা মুল্যবান সময় নষ্ট করে বিপথ গামী হচ্ছে।
চিতলমারী সদর বাজারের হাসিনা বেগম মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শৈলেন্দ্র নাথ বাড়ৈ জানান, পড়াশুনার পেছনে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল ফোন। এর সঠিক ব্যবহার না করে ছাত্র-ছাত্রীরা খারাপ দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিষয়টি চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণে আনা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তবে ক্লাসে মোবাইল আনতে নিষেধ করা হয়েছে ছাত্রীদের।
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও মো. আনোয়ার পারভেজ জানান, অপরিণত বয়সে শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল পৌঁছে যাওয়ায় অনেকেই এর অপব্যবহার করছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সের যুবক-যুবতী ও শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফেসবুক ও অন্যান্য উপায়ে সম্পর্ক গড়ছে। এ সম্পর্কের পরিণতি সম্পর্কে তাদের জানা নেই। এ ছাড়া রাত জেগে পড়াশুনা বাদ দিয়ে মোবাইলের মাধ্যমে বিভিন্ন খারাপ ছবি দেখে বিপথে যাবার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছ।
বিশেষ প্রতিনিধি, বাগেরহাট থেকে