বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
শিরোনাম : * গাজীপুরে জমি নিয়ে বিরোধ সংঘর্ষ,আহত ৫   * কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার ২০   * রাঙ্গামাটির কল্পনা চাকমা অপহরণ: ২৮ বছর পর মামলা খারিজ করে দিয়েছে আদালত ;   * কক্সবাজারের চকোরিয়ার মাতামুহুরি নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ ২   * কর্মচারীদের বোরকা পরা ও নেকাব পরা নিষিদ্ধ করল চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ   * পঞ্চগড় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ৩৩ জন প্রার্থীর মাঝে প্রতীক বরাদ্দ   * বাণিজ্যিকভাবে আঠাবিহীন বারোমাসি কাঁঠাল চাষে লাখপতি সবুজ   * চট্টগ্রামের জেলাপ্রশাসক -পুলিশ সুপার ও সাতকানিয়ার ইউএনও-ওসিকে হাইকোর্টের ভর্ৎসনা;   * বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির কােন উন্নতি দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র!   * কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাচনে কে কোন প্রতীক পেলেন  

   প্রবন্ধ
গরম ভাতের পান্তা : আনন্দের না উপহাস
  Date : 01-05-2016

বাংলা পঞ্জিকা থেকে বিদায় নিয়েছে আরো একটি বছর। ১৪২২ বছর পেরিয়ে সবে ১৪২৩ নতুন দিনে পা রেখেছে বাংলা বর্ষ। প্রথম ও নতুন, এ যেন এক আলাদা আকর্ষন,আলাদা স্বাদ। জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে সবার মধ্যে থাকে প্রথম ও নতুনের প্রতি বাড়তি মোহ। আর তাই বছর ঘুরে যখন নতুন বছর আসে তখন নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে তাকে আমরা গ্রহন করি, স্বাগত জানাই। সুখের কথা এ বছর ১লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসি এলাকায় এক নারীর সঙ্গে পুলিশ সদস্যের সামান্য অসৌজন্য আচরণ ছাড়া তেমন কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। টিএসসি’র ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে তাৎক্ষনিকভাবে ওই নারীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করায় বিষয়টি মিমাংশা হয়ে যায়।

নতুন বছরকে আনন্দ উচ্ছাসের মধ্য দিয়ে বরণ করার মধ্যে দোষের কিছু নেই। তবে তখন-ই দৃষ্টিকটু লাগে, যখন অতিরিক্ত বা অতিরঞ্জিত কিছু করা হয়। সব দেশ সব জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, চলার পথে রয়েছে নিয়মনীতি। আমাদের দেশ ও দেশের মানুষ এর বাইরে নয়। আমাদেরও নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, রয়েছে নিয়ম কানুন। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব ১লা বৈশাখ। অর্থাৎ বাংলা বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিন। বাংলা মাস একেবারেই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ব্যবস্থাপনা। বাংলা বছর কেবল বাংলা ভাষা মানুষের বর্ষপুঞ্জি। বাংলা ছাড়াও আরবী,চায়না,ইরাণী,থাই সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভায়ায় তাদের নিজস্ব বর্ষপুঞ্জি রয়েছে। আর পৃথিবীর সবদেশের জন্য রয়েছে ইংরেজি ক্যালেন্ডার। ইংরেজি বছরকে দুভাগে বিভাক্ত করা হয়েছে একটি ক্যালেন্ডার ইয়ার অপরটি ফিন্যান্সসিয়াল ইয়ার। ইংরেজি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারি। জানুয়ারিকে ক্যালেন্ডার ইয়ার বলে অবিহিত করা হয়। ফিন্যান্সসিয়াল ইয়ারের প্রথম মাস জুলাই।

ইংরেজি জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি,মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বরের ন্যয় বাংলা বছরের প্রথম মাস হচ্ছে, বৈশাখ এরপর জ্যোষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রাহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। আমাদের বাংলা বছরের বয়স একবারে কম নয়। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে ২টি মত চালু আছে। প্রথম মত অনুযায়ী - প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে শশাঙ্ক বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন। আধুনিক বঙ্গ, বিহার এলাকা তাঁর সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ অনুমান করা হয় যে, জুলীয় বর্ষপঞ্জীর বৃহস্পতিবার ১৮ মার্চ ৫৯৪ এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর শনিবার ২০ মার্চ ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।  দ্বিতীয় মত অনুসারে, ইসলামী শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হত। মূল হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল।  চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর  চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। একারণে চান্দ্র বৎসরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। আর বঙ্গদেশে চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এজন্য মোগল স¤্রাট আকবরের সময়ে প্রচলিত হিজরী চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রুপান্তারিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স¤্রাট আকবর ইরান থেকে আগত  বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে (২) হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রুপান্তারিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফতুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত ফার্সি বর্ষপঞ্জীর অনুকরণে[৩] ৯৯২ হিজরী  মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে স¤্রাট আকবর হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে প্রতি বছরের ১৪ এপ্রিল তারিখে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়।

বাংলা সনের ১৪২২ বছর পেরিয়ে সবে ২৩ এ পা দিয়েছি আমরা। প্রতিবার নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে উল্লেখযোগ্য শ্রেনীর মানুষ নতুন বছরকে বরণ করি। আমাদের আয়োজনে থাকে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, র‌্যালী, রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-বাড়িঘর সাজসজ্জা, মেলা, শুভেচ্ছা বিনিময়, ঘুরে বেড়ানো, নতুন পোষাক পরিধান  ও বিভিন্ন পদের খাওয়ার আয়োজন প্রভৃতি। তবে, নতুন পোষাকের প্রথা আগে ছিল না,সাম্প্রতিক সংযোজন। শহরের বিক্তবান বা অবস্থাপূর্ণ শ্রেনীর মানুষের মধ্যে বছর কয়েক ধরে এই প্রথা চালু হয়েছে। পোষাকের মধ্যে লাল-সাদা,হলুদ-সবুজ সংমিশ্রণে মেয়েদের শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, কটি, পুরুষের পায়জামা-পাঞ্জাবি, টি-সার্ট, শিশু-কিশোরের জন্য প্যান্ট,সার্ট, ফ্রক প্রভৃতি। বিক্তবানদের দেখাদেখি মধ্যবিত্ত শ্রেনীর অনেকে নতুন পোষাকের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। তবে, পোষাক নিয়ে দু’টি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে এবার। পোষাক না পেয়ে পৃথক দুই স্থানে এক কিশোর ও এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়,

 (এক) বাবার কাছে ১লা বৈশাখে নতুন পোষাকের আবদার করেছিল ১৪ বছরের কিশোরি নুপুর। দরিদ্র পিতা মেয়ের এ আবদার রক্ষা করতে পারেন নি। তাই অভিমানে আত্মহত্যা করে নুপুর। ১লা বৈশাখের  সন্ধ্যায় ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার কাজী নওয়াপাড়া গ্রামে এ হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। নুপুর কামান্না হাই স্কুলের ৭ম শ্রেনীর ছাত্রী।

(দুই) এরআগে পহেলা বৈশাখে চাহিদা মতো নতুন জামা না পেয়ে শাহীন (১৪) নামে এক স্কুল ছাত্র গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। পাবনার বেড়া উপজেলার বনগ্রাম উত্তরপাড়ায়  ১২ এপ্রিল মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।  দিনমজুর বাবা কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশুনার খরচ চালাতো পুত্রের। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নতুন পোষাকের জন্য বাবার কাছে বায়না ধরে শাহীন। বাবা অনেক কষ্টে ৫শ টাকার ব্যবস্থা করলে তাতে পুত্রের মন ভরেনি। সেই অভিমানে ঘরের আড়ার সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ঘটনা দুটি একদিকে যেমন দুঃখজনক অন্যদিকে বেদনাদায়ক।

নতুন বছরের সঙ্গে নতুন পোষাকের কোন সম্পর্ক নেই। অথচ, দিন দিন এই বিষয়টি যেন অপরিহার্য হয়ে উঠছে। বৈশাখের আগমনকালে ইদানিং পোষাক-আসাক,খাবার-দাবার ক্রয়ে ধুম পড়ে যায়। যার প্রভাব সমাজের সব শ্রেনীর মানুষের ওপর পড়ছে। বিশেষ করে অবুঝ শিশু-কিশোর মনে এর নেতীবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই, বিষয়টি নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে। পোষাক-আশাক ছাড়াও ১লা বৈশাখ উদযাপনে ইদানিং খাবার-দাবারের বিষয়টি খুব জোরে-সোরে সামনে চলে আসছে। বিশেষ করে পান্তা-ইলিশ। কখন কিভাবে ১লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ সংযোজন হলো সে কথা জানেন না কেউ। ইতিহাসের পাতা হাতড়িয়ে পান্তার সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার প্রচলন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। বরং পান্তা-ইলিশের বিষয়টি বাঁকা চোখে দেখছেন অনেকে। চোখ বাঁকা করার ব্যাপারে তাদের যুক্তি হচ্ছে নতুন বর্ষ বরণের জন্য পান্তা বা পান্তার সঙ্গে ইলিশ খেতে হবে কেন?  আসলে পান্তা বা পান্তা ভাতের ইতিহাস তো ভিন্ন। বহুকাল আগে থেকে আমাদের দেশে পান্তার প্রচলন রয়েছে। পান্তা শ্রেফ বাঙালীর খাবার হিসাবে নয়, গরীব শ্রেনী ও কৃষকের নিত্যদিনের খাবার হিসেবেই অধিক পরিচিত।

 ১লা বৈশাখের আয়োজনের সুবাদে কম বেশি সবাই আজ আমরা পান্তার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু এই প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেন না, পান্তার ইতিহাস। আগের দিনে ঘরে ঘরে ফ্রিজ ছিল না। ঘরে ঘরে তো দূরের কথা, সারা শহর জুড়ে খুঁজে বেড়ালেও ফ্রিজের খোঁজ মেলা ভার ছিল। গ্রামাঞ্চলে তো নয়-ই, এমনকি শহরের সব এলাকাতে সেসময় বিদ্যুৎ পর্যন্ত ছিল না। তাই, তখনকার সময় রাতের খাবারের পর বাড়তি ভাত যাতে পচে না যায়, নষ্ট না হয় সে জন্য পানি ঢেলে দেওয়া হতো। রাতের পানি দেওয়া ভাত সকালে বনে যেত পান্তা। স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো এই পান্তা দিয়ে সেরে ফেলতেন সকালের নাস্তা। ধনী ও বিক্তবানদের বাসা-বাড়ির পান্তা বরাদ্দ থাকতো চাকর-বাকর, জোন-মুজুরদের জন্য। পান্তার পরিমান খুব বেশি হয়ে গেলে ফকির ডেকে বিলিয়ে দেওয়া হতো। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সকালে বেলার প্রধান খাদ্য ছিল লবন,পিয়াজ ও মরিচ দিয়ে পান্তা। হয়তো মাঝে মধ্যে পান্তার সঙ্গে কিছু তরিতরকারি। প্রতিদিনসূর্য ওঠার আগেই মাঠে চলে যেতে হয় কৃষকদেরকে। তাই,ভোরের খাবারের ব্যবস্থা রাতেই করে রাখাতে পান্তার প্রচলন হয়তো’বা।

 চল্লিশ-পঞ্চাশ কিংবা তারও আগেকার মানুষের কাছে পান্তা ছিল নিতান্ত গরীবের খাবার। কোন-বিক্তবান বা ধনীক শ্রেনীর খাদ্য তালিকায় পান্তার স্থান ছিল না। কালে-ভদ্রে শখের বসে যদি কেউ খেয়ে থাকেন,তা’কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আর পান্তার সঙ্গে ইলিশ! না, আদও এ জাতীয় কোনো সম্পর্ক ছিল না। রাতের বাসী তরি-তরকারি, মরিচ-পিয়াজ, খেজুরের গুড়,আখের গুড় ইত্যাদী দিয়ে পান্তা খাওয়া হতো। অঞ্চল ভেদে শখের বসে কেউ কেউ শুকনা মরিচ পোড়া, চিংড়ি ও অন্যান্য ভর্তা,আচার দিয়ে পান্তা খেতেন। অর্থাৎ সামর্থবানদের কাছে পান্তা হচ্ছে শখের খাবার আর গরীব ও কৃষকের জন্য অপরিহার্য। তাই, পান্তার সঙ্গে ১লা বৈশাখ,কোন উৎসব কিংবা জাতিসত্বার সম্পর্ক নেই। পান্তা নিতান্ত অতি সাদামাঠা ও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাবার। অথচ, সাম্প্রতিককালে পান্তা নিয়ে অতিমাত্রায় মাতামাতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পান্তাকে বাঙালীর খাবার অবিহিত করে বাংলা বর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে প্রধান খাদ্য তালিকায় স্থান দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সকাল বেলায় গরম ভাত রান্না করে তাতে পানি ঢেলে কৃত্রিম উপায়ে তৈরী করা হচ্ছে পান্তা। আর বছরে একদিন সেই পান্তা খেয়ে নিজেকে খাঁটি বাঙালী মনে করেন অনেকে। তাই, স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতেই পারে কৃত্রিম উপায়ে তৈরী গরম ভাতের পান্তা, আনন্দের না উপহাস ? কেননা,যেখানে লবন-মরিচ দিয়ে একমুঠো পান্তা অনেকের জন্য জীবন ধারণের অবলম্বন, সেখানে ঘটাকরে গরমভাতের পান্তা খেয়ে উল্লেসিত হওয়ার সুযোগ কতোটুকু!

গরীব ও কৃষকের সেই পান্তার সঙ্গে আবার যুক্ত করা হয়েছে ইলিশ, একাধিক পদের ভর্তা,চাটনি আরো কতো কিছু। পান্তার সঙ্গে ইলিশ যুক্ত করা হয়েছে, কেবল তা’নয় এই ইলিশ নিয়ে রীতিমতো বাড়াবাড়ি’র চরম পর্যায় এসে ঠেকেছে। রাজধানীসহ শহরাঞ্চলের এক শেনীর মানুষ ১লা বৈশাখে পান্তার সঙ্গে ইলিশ অপরিহার্য করে তুলেছেন। ভাবখানা এমন, পান্তার সঙ্গে ইলিশ না হলে এই দিন’টা যেন বৃথা। তাদের এই ধরণের মনোভাব ইলিশ সম্পদ ও সমাজের ওপর চরমভাবে নেতীবাচক প্রভাব ফেলছে। মার্চ-এপ্রিলে সাধারণত ইলিশ থাকে অনেক ছোট বা জাটকা অবস্থায়। এই সময় ধরা হলে ইলিশ সম্পদ কমে আসে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা বর্ষবরণে ইলিশের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেওয়ায় অধিক মুনাফার লোভে জেলেদের মৎস্য আহরণে আগ্রহ বেড়ে গেছে। ইলিশ বিক্রির ক্ষেত্রে অবাক করার কা- ঘটেছে এবার। মাওয়ায় পদ্মাপাড়ে ২১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে মাত্র একটি ইলিশ। ১লা বৈশাখের দুদিন আগে ১২ এপ্রিল দুই কেজি ৯০০ গ্রাম ওজনের এ ইলিশটি ক্রয় করেন ঢাকার এক ব্যবসায়ী। এছাড়াও এর দুদিন আগে মাওয়ার এক আড়তে আড়াই কেজি ওজনেরএকটি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৭ হাজার টাকায়। আর মাঝারি আকৃতির একেকটি ইলিশ বিক্রি হয় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকায়। তবে, একদিকে ঝাটকা নিধন অন্যদিকে লাগামহীন ইলিশের মূল্য মানুষের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

বিলম্বে হলেও সরকারও বিষয়টি অনুধাবন করেছেন। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও চট্রগ্রামসহ অনেক জেলা প্রশাসন এবার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে খাদ্য তালিকা থেকে ইলিশ বাদ দেন। এমনকি ১লা বৈশাখের দু’দিন আগে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ইলিশ না খাওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ইলিশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। মানুষজন সচেতন হলে আগামীতে ১লা বৈশাখে ইলিশ মোহ আরো কেটে যাবে বলে আশা করা যায়। এমনকি ১লা বৈশাখে পান্তার যে ভুত চেপে বসেছে তাকে মাথা থেকে ঝেঁড়ে     ফেলা উচিত। কেননা,ওই একদিন কেন ঘটা করে পান্তা খেতে হবে। পান্তা তো আমরা সারা বছর জুড়ে খেতে পারি। আমাদের তো বহু পদের খাবার রয়েছে। রয়েছে, নানান জাতীয় পিঠা,ফলমূল, দৈ-মিষ্টি। বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে সেসব খাবারের ব্যবস্থা রাখা যায়।

 নতুন অঙ্গীকার নিয়ে নতুন বছরকে বরণে নানান আয়োজন, আনন্দ, উচ্ছাস, উৎসব হতে-ই পারে। তবে, সেই আনন্দ উচ্ছাস,উৎসব প্রকাশে যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, অতিরিক্ত-অতিরঞ্জিত কিছু করা হয়, তখন উৎসব তার নিজস্ব কৃষ্টি বা সভ্যতা হারিয়ে ফেলে। যা’ কোন ক্রমেই কাম্য হতে পারে না। আমাদের ফেলে আসা সাম্প্রতিক বছরগুলোর  অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়। সে অভিজ্ঞতার কথা নাই’বা উল্লেখ করলাম। দিন যত যাচ্ছে, এই দিনটিকে আমরা যেন কঠিন থেকে কঠিনতর করে ফেলছি, সার্বজনীন এই উৎসবকে বিশেষ শ্রেনীর মধ্যে কুক্ষিগত করছি, শহর ভিত্তিক করে ফেলছি বাংলা বর্ষবরণ। বদলে ফেলছি খাদ্য তালিকা।

মহান স্বাধীনতা পূর্ব আমাদের কিশোর কাল থেকে দেখে আসা বাংলা নববর্ষ পালনের মধ্যে এখনকার পালনে ফারাক যেন দিন দিন বাড়ছে। আগের দিনে ১লা বৈশাখে আনন্দ’র পাশাপাশি অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল খুব বেশি। সারা বছরের বাকি-বকেয়া বা ঋণ-কর্জ পরিশোধের চুড়ান্তদিন হিসেবে বিবেচিত ১লা বৈশাখ। দোকান, আড়ৎদারি এই জাতীয় ব্যবসায়ীরা হালখাতা নামের আয়োজন করেন। খুবই সীমিত আকারে এই আয়োজন এখনও বহাল আছে। হালখাতা হচ্ছে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খুলেন। এজন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্বরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিষ্ঠিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ অনুযায়ী পুরোনো দেনা শোধ করে দেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হয়। হিসাবের খাতা হাল নাগাদ করা থেকে “হালখাতা”-র উদ্ভব। শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট বড় মাঝারি যেকোনো দোকানেই এটি পালন করা হয়।

আগের দিনে হালখাতা মানে ১লা বৈশাখের আলাদা আনন্দ। পাড়া-মহল্লা,হাট-বাজার সর্বত্র একটা সাজসাজ রবরব পড়ে যেত দোকান-পাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে। দেবদারু পাতা-কলাগাছ দিয়ে তৈরী গেট, রঙিন কাগজের তিন কোনার পতাকা, বেলুন দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো, লাল সালু ও সামিয়ানা টাঙিয়ে মিষ্টি,লুচি ইত্যাদি খাওয়ার জন্য বসবার ব্যবস্থা আলাদা বৈচিত্র আনতো উক্ত স্থানে। সকাল থেকে রাত অবদি খদ্দের এবং ব্যবসায়ীর মধ্যে চলতো দেনা-পাওনার হিসাব নিকাশ। সেই সঙ্গে মিষ্টিমুখ। মিষ্টিমুখ যে কেবলমাত্র খদ্দেরকে করাতেন তা’কিন্তু নয়। পরিচিত-অপরিচিত, বন্ধু-বান্ধব,আত্বীয়-স্বজন যিনিই যেতেন তাকে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো।  বর্তমানে হালখাতার আয়োজন সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। রাজধানীর মধ্যে পুরাতন ঢাকার কিছু প্রতিষ্ঠান, ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলের কোথাও কোথাও সীমিত আকারে হালখাতার ঐতিহ্য ধরে রাখা হয়েছে।

  সৈয়দ সফি

- লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক,



  
  সর্বশেষ
গাজীপুরে জমি নিয়ে বিরোধ সংঘর্ষ,আহত ৫
কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার ২০
রাঙ্গামাটির কল্পনা চাকমা অপহরণ: ২৮ বছর পর মামলা খারিজ করে দিয়েছে আদালত ;
কক্সবাজারের চকোরিয়ার মাতামুহুরি নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ ২

Md Reaz Uddin Editor & Publisher
Editorial Office
Kabbokosh Bhabon, Level-5, Suite#18, Kawran Bazar, Dhaka-1215.
E-mail:manabadhikarkhabar11@gmail.com
Tel:+88-02-41010307
Mobile: +8801978882223 Fax: +88-02-41010308