শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
শিরোনাম : * খুলনার কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনি`র মৃত্যুতে জানিপপ চেয়ারম্যানের শোক   * কক্সবাজার জেলা পরিষদের নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আল মারুফের যোগদান   * ৮০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস, হুঁশিয়ারি সংকেত   * মাদক কারবারে ককস বাজারের সাবেক এমপি বদির দুই ভাইয়ের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে সিআইডি   * দিশেহারা সুগন্ধা দাশের পাশে দাঁড়াল চট্রগ্রামের জেলা প্রশাসন   * আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস ;   * আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস ;   * রশিদ মিয়া কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভাইস চেয়ারম্যান ;   * কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাচনে যে সকল প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেছেন;   * বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করলো মিয়ানমারের ৯ বিজিপি সদস্য  

   অধিকারের প্রতিবেদন
অধিকারের মাসিক প্রতিবেদন
  Date : 01-07-2016

দুদক কর্মকর্তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশের দাবি

গুম এবং হত্যার ব্যাপারে সরকারকে ব্যাখ্যা দিতে হবে –অধিকার

 

সংবাদ মাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারি দলের ব্যাপক অনিয়ম, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করার অভিযোগ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, বাঁশখালীর গ-ামারা এলাকাবাসীর ওপর হামলা ও হয়রানি অব্যাহত, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আইনবহির্ভূত আচরণ, গণপিটুনীতে মানুষ হত্যা অব্যাহত, সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারীর প্রতি সহিংসতা, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মে মাসের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অধিকার। এটি মুলত জুনের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে।

 

 

মানবাধিকার খবর ডেস্ক:

 

অধিকার মনে করে ‘গণতন্ত্র’ মানে নিছক  নির্বাচন নয়, রাষ্ট্র গঠনের-প্রক্রিয়া ও ভিত্তি নির্মাণের গোড়া থেকেই জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় নিশ্চিত করা জরুরি। সেটা নিশ্চিত না করে যাত্রা শুরু করলে তার কুফল জনগণকে বয়ে বেড়াতে হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার সমস্ত ক্ষেত্রে জনগণ নিজেদের ‘নাগরিক’ হিসেবে ভাবতে ও অংশগ্রহণ করতে না শিখলে সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে ‘গণতন্ত্র’ গড়ে ওঠে না। নাগরিক হিসেবে নিজেদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় এবং মানবিক চাহিদা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শাসন ব্যবস্থার নি¤œ স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত নেবার ব্যবস্থা গড়ে না উঠলে তাকে ‘গণতন্ত্র’ বলা যায় না। অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিজের অধিকার ও দায় সম্পর্কে নাগরিকদের উপলব্ধি ঘটে এবং তার মধ্যে দিয়েই অপরের অধিকার এবং নিজেদের সমষ্টিগত স্বার্থ ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। এর কোন বিকল্প নাই। জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় যে মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকারকে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সংসদের কোন আইন, বিচার বিভাগীয় কোন রায় বা নির্বাহী কোন আদেশের বলে সেই সমস্ত অধিকার রহিত করা যায় না। তাদের অলঙ্ঘনীয়তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

ব্যক্তির মর্যাদা অলঙ্ঘনীয়। প্রাণ, পরিবেশ ও জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান করা ছাড়া রাষ্ট্র নিজের ন্যায্যতা নাগরিকদের কাছে প্রমাণ করতে পারে না। বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীদের গণভিত্তিক সংগঠন অধিকার ব্যক্তির মর্যাদা সমুন্নত রাখবার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সমস্ত মানবিক ও নাগরিক অধিকার এবং দায়িত্ব রক্ষা ও পালনের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মানদ- ঐতিহাসিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে মানবেতিহাস অর্জন করেছে এবং এইসব নাগরিক ও মানবিক অধিকারের সার্বজনীনতা নানান আন্তর্জাতিক ঘোষণা, সনদ ও চুক্তির মধ্যে দিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এই কারণে অধিকার বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনকে নিছকই রাষ্ট্রের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ‘ব্যক্তি’কে রক্ষার ব্যাপার মাত্র বলে মনে করে না; বরং ব্যক্তির নাগরিক ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন ও সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বলে মনে করে। এই লক্ষ্য নিয়েই অধিকার বাংলাদেশের জনগণের নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। চরম রাষ্ট্রীয় হয়রানি ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থেকেও অধিকার ২০১৬ সালের মে মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করলো।

 

সংবাদ মাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ:

১.  মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সরকার কঠোরভাবে দমন করছে। সংবাদ মাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের জন্য আইন প্রণয়ন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা ও দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রাখার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে জেল-জরিমানার বিধান রেখে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন ২০১৬ নামে নিবর্তনমূলক আরেকটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে এবং বেসরকারী সংস্থা (এনজিও)’র ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিধান রেখে বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) রেগুলেশন বিল ২০১৬ চূড়ান্ত করেছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, যা মতপ্রকাশের ও সংগঠনের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করবে। পত্রিকা বন্ধের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে প্রেস কাউন্সিল আইন (সংশোধন) এর খসড়াও চূড়ান্ত করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে সরকারি নজরদারী বলবৎ রয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি বা তাঁদের পরিবারের সমালোচনাকারীসহ সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন যে কোন তথ্য প্রকাশের ফলশ্রুতিতে নিবর্তনমূলক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০০৯ ও ২০১৩) প্রয়োগ করা হচ্ছে।

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন ২০১৬ এর খসড়া:

২.  আইন কমিশন ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন ২০১৬’ নামে নিবর্তনমূলক আরেকটি আইনের প্রস্তুতকৃত খসড়ার ওপর মতামত দিয়ে সেটি সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে। এই খসড়া আইনে বলা আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত বা প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের দলিল এবং ওই সময়ের যেকোনো ধরণের প্রকাশনার অপব্যাখ্যা বা অবমূল্যায়ন অপরাধ বলে গণ্য হবে। খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি ধরা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। প্রস্তাবিত আইনের দ্বিতীয় উপদফা বলছে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যবর্তী সময়ের ‘ঘটনাসমূহ’ অস্বীকার করা হবে অপরাধ। কিন্তু সেই ঘটনাসমূহ কী, তার কোনো ব্যাখ্যা বা আলোচনা সেই আইনে নেই। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ যেখানে শুরু হয়েছিলো ২৫ শে মার্চ মধ্যরাত থেকে সেখানে ১ লা মার্চ থেকে কেন বলা হচ্ছে তারও কোন ব্যাখ্যা নেই। এর মানে হলো, পুলিশ এবং অভিযোগকারীরা কোনটি ‘ঘটনা’ আর কোনটি ‘বিকৃতি’, তা অনুমান করে নেবে। প্রস্তাবিত এই আইনের খসড়ার ৬(১) ধারায় বলা আছে, ‘কাহাকেও প্ররোচনা দিলে বা কোনরুপ সাহায্য করিলে বা কাহারও সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইলে, অথবা এতদুদ্দেশ্যে কোনো উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা গ্রহণ করিলে, ওই ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য ধার্যকৃত দ-ের সমপরিমাণ দ-ে দ-িত হইবে’। এই আইনে যে কেউ থানায় মামলা করতে পারবেন। আইনে পাঁচ বছরের জেল ছাড়াও কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান থাকছে। এই আইনে করা মামলায় সংক্ষিপ্ত ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অভিযোগের অনুসন্ধান, তদন্ত ও বিচারের নির্দেশনা রয়েছে।

 

৩.  ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন ২০১৬ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার ক্ষেত্রে অন্তরায় ও মুক্তচিন্তার পথে বাধা হয়ে উঠবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। ১৯৭১ এর নয় মাসের প্রতিটি ঘটনার সমর্থনে দালালিক প্রমাণ নেই; যা অনেক সময় ভুক্তভোগী বা সরাসরি ঘটনায় অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে কয়েকটি রাজনৈতিক ধারার সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল; যার মধ্যে শুধুমাত্র একটিকে বেছে নেয়া হবে সরকার মনোনীত একটিমাত্র ধারাকে স্বীকৃতি দেয়া এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্য ধারাগুলোর অবদানকে অস্বীকার করা। এই সব বিষয় নিয়ে মতপ্রকাশ বা গবেষণা করতে গেলে এই আইন তার অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে এবং রাজনৈতিকভাবে তা অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করবে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সর্ম্পকিত কোনো নতুন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কোনো লেখা, মত প্রকাশ বা মন্তব্য করা অথবা নতুনভাবে কোনো বিষয়কে ব্যাখ্যা করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। এই আইনে যে কেউ মামলা করার বিধান থাকায় মামলার সংখ্যা ভবিষ্যতে কীরকম হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এই আইন পাশ হলে তা হবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ সংবিধানে চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা আছে।

 

বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)’র ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিধান রেখে বিল চূড়ান্ত:

৪.  গত ১৮ মে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)’র ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিধান রেখে বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) রেগুলেশন বিল ২০১৬ চূড়ান্ত করেছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এই বিলে কোন এনজিও বা এনজিওর কর্মকর্তা সংবিধান বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিরূপ বা অশোভন কোন মন্তব্য করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে। সংসদ, বিচার বিভাগ, আইন কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও এ্যাটর্নি জেনারেল সম্পর্কে বিরূপ বা অশোভন মন্তব্য করা হয়েছে এই মর্মে সরকারের কাছে প্রতীয়মান হলে এই প্রস্তাবিত বিল অনুযায়ী এনজিও’র নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত করা যাবে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২ জুন ‘বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন ২০১৪’-এর খসড়া আইনকে অনুমোদন দেয় মন্ত্রীসভা। যা আবারো যাচাই-বাছাই করে বিল আকারে এটি প্রস্তুত করা হয়েছে।

 

৫.  অধিকার মনে করে, এই বিলটি আইন হিসেবে পাশ হলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরো সঙ্কুচিত হবে এবং বেসরকারী সংস্থাগুলোকে আরো ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হবে। এই বিলটি আইন হিসেবে কার্যকরী হলে মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর কণ্ঠরোধ করা হবে এবং তাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলার পরিবেশ তৈরি হবে বলে অধিকার আশঙ্কা করছে।

 

পত্রিকা বন্ধের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে প্রেস কাউন্সিল আইন (সংশোধন) ২০১৬ এর খসড়া চূড়ান্ত:

৬.  প্রেস কাউন্সিলের রায় বা আদেশ অমান্য করলে কোনো সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থার প্রকাশনা সর্বোচ্চ তিন দিন বন্ধ অথবা পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান রেখে প্রেস কাউন্সিল আইন (সংশোধন) ২০১৬ এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে প্রেস কাউন্সিল। সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার নতুন নতুন সব আইন তৈরী করছে বলে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। এর আগে জেল-জরিমানার বিধান রেখে নিবর্তনমূলক ‘জাতীয় সম্প্রচার আইন’ ২০১৬ এর খসড়া প্রকাশ করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এই ‘জাতীয় সম্প্রচার আইন’ এর বিধিবিধান বা প্রবিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদ- এবং কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- দেয়া যাবে।

 

র‌্যাবের নজরদারীতে সোশ্যাল মিডিয়া:

৭.  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নজরদারী করার জন্য র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এর জন্য ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ‘¯œ্যাপট্রেন্ডস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে একটি সফটওয়্যার আনা হয়েছে। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, গুগল প্লাস, ইউটিউব ও ওয়ার্ডপ্রেসসহ সব ধরনের ব্লগের তথ্য র‌্যাব সংগ্রহ করতে পারবে এবং যে সব পোস্ট সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষে ‘ক্ষতিকর’ মনে করা হবে সেসব পোস্টের সূত্র ধরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে সরকার।

 

৮.  তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০০৯ এবং ২০১৩) এখনো বলবৎ আছে। ফেসবুকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবার এর বিরুদ্ধে লেখার জন্য নিবর্তনমূলক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০০৯ এবং ২০১৩) ব্যবহার করে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৭ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

 

সাংবাদিকদের ওপর হামলা:

৯.  অধিকার এর সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী মে মাসে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ৬ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন।

১০. অধিকার দেশের নাগরিকদের মত প্রকাশ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ অব্যাহত থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। অধিকার মনে করে কোন নাগরিকের মতামত সরকারের বিপক্ষে গেলেই তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে গ্রেফতার বা হয়রানি করা হচ্ছে। অধিকার জেলে আটক প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমান, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত স¤পাদক মাহমুদুর রহমান এবং বিএফইউজের সভাপতি শওকত মাহমুদ এর অবিলম্বে মুক্তি দাবি করছে। অধিকার অবিলম্বে নিবর্তনমূলক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০০৯ ও ২০১৩) বাতিলের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে এবং প্রস্তাবিত নিবর্তনমূলক ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন’ ‘জাতীয় সম্প্রচার আইন’, প্রেস কাউন্সিল আইন এবং বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) রেগুলেশন বিল ২০১৬ এর ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াকে নজরদারীর মধ্যে আনার ব্যাপারে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আরো সঙ্কুচিত করবে বলে অধিকার আশংকা প্রকাশ করছে।

 

রাজনৈতিক সহিংসতা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারিদলের ব্যাপক অনিয়ম অব্যাহত

 

রাজনৈতিক সহিংসতা:

১১.  অধিকার এর প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মে মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৫১ জন নিহত ও ১৫৬৯ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় ৪৫ জন নিহত ও ১৪৮৫ জন আহত হয়েছেন। এই মাসে আওয়ামী লীগের ৩৪টি এবং বিএনপি’র ৫টি অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৬ জন ও বিএনপি’র অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৩ জন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। একই সময়ে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আওয়ামী লীগের ৪৮৪ জন এবং বিএনপি’র ৪৮ জন আহত হয়েছেন বলেও জানা গেছে।

১২.  রাজনৈতিক সহিংসতা অব্যাহত আছেই। দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা আরো তীব্র আকার ধারন করেছে এবং তা দেশের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ না থেকে প্রতারণামূলক ও বিতর্কিত নির্বাচন করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার চেষ্টার কারণে ক্ষমতাসীনদলের নেতাকর্মীরা একরকম বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে এবং সারাদেশে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে তা ফুটে উঠেছে। তারা বিরোধীদলের নেতাকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ জনগণের ওপর হামলা করছে এবং নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন অন্যায় স্বার্থ হাসিলকে কেন্দ্র করে অসংখ্য অন্তর্দলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছে। এই কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। এইসব বেশিরভাগ ঘটনায় সরকারিদলের নেতাকর্মীদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি।

১৩. গত ৬ মে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান স্থল বন্দর পরিদর্শন ও একটি সমাবেশে যোগ দেয়ার জন্য ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলায় যাচ্ছিলেন। এই সময় মন্ত্রীকে অর্ভ্যথনা জানাতে পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এইচএম রাকিব হায়দার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা ফেনী-পরশুরাম সড়কের ধনিকু-া এলাকায় অপেক্ষা করছিলেন। মন্ত্রী ঘটনাস্থলে আসার কিছুক্ষণ আগে ওই জায়গাতেই স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে মন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খায়রুল বাসার মজুমদার তপন ও তার সমর্থকরাও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এইচএম রাকিব হায়দার ওই স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খায়রুল বাসার মজুমদার তপনকে ‘সম্মান’ না করার কারণে তপন ও তার সমর্থকরা রাকিব হায়দারের ওপর হামলা করে তাকে শারীরিকভাবে জখম করে। রাকিব হায়দারকে তখন পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। ইউএনও’র ওপর হামলার ঘটনায় ওই দিন বিকেলেই তার গাড়ি চালক আবুল কাশেম বাদি হয়ে জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো ১০-১২ জনকে আসামী করে পরশুরাম থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ওই মামলায় এজাহার নামীয় আসামী পরশুরাম পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও উপজেলা শ্রমিক লীগের আহাবায়ক আবদুল মান্নান, স্থানীয় যুবলীগ নেতা মহিউদ্দিন পারভেজ, ফারুক আহমদ, মো.  মহিউদ্দিন, আবু তৈয়ব মাসুদকে গ্রেপ্তার করেছে। গত ১১ মে ফেনীর দ্রুত বিচার আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালতে মামলার অন্যতম অভিযুক্ত জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি খাইরুল বাশার মজুমদার তপন, চিথলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন আতœসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে বিচারক অভিযুক্তদের জামিন নামঞ্জুর করে তাদের জেল হাজতে পাঠান।

 

প্রথম থেকে পঞ্চম ধাপ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনী সহিংসতায় ১১৫ জন নিহত:

১৪. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পরই নির্বাচনী সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করে; যা মনোয়নপত্র জমা দেয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। অধিকারের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রথম থেকে পঞ্চম ধাপের নির্বাচনী সহিংসতায় মোট ১১৫ জন নিহত ও অন্ততপক্ষে ৪৯৫৩ জন আহত হয়েছেন।

১৫. ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রতারণামূলক ও বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন ও সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলো ছিল বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে কলংকিত নির্বাচন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন ছয়টি ধাপে মোট ৪২৭৫টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করে। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং এই নির্বাচনে হত্যা, সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়া, জাল ভোট দেয়া, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর হামলার ঘটনাগুলোর মাধ্যমে সরকার মনোনীত দলীয় প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের ঘটনা অন্ততপক্ষে তিনগুন বেড়েছে এবং এর জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের দায়ী করেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ।

গত ৭ মে চতুর্থ ধাপে ৭০৩টি১০ ইউনিয়ন পরিষদের, ২৫ মে নয়টি পৌরসভায় এবং ২৮ মে পঞ্চম ধাপে ৭৩৩ টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে এবং ২৫ মে অনুষ্ঠিত নয়টি পৌরসভার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের কেন্দ্র দখল, প্রকাশ্যে জাল ভোট দেয়া ও হামলার মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে ঘুরিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে নিচে মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।

 

চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন:

১৬.  রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার আউচপাড়া ইউনিয়নের হাটগাঙ্গোপাড়া বাজারে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সরদার জান মোহাম্মদ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শহীদুজ্জামান শহীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে সিদ্দিকুর রহমান নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার পাড়াতলী ইউনিয়নের মধ্যনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর আনুমানিক আড়াইটায় জাল ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রফিকুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাকির হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে হোসেন আলী নামে এক ব্যক্তি নিহত ও ৩০ ব্যক্তি আহত হন। মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরের রামপাল ইউনিয়নের কাজী কসবা কাজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মিল্কীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের সমর্থক ও পুলিশের মধ্যে সহিসংতায় পুলিশের এসআই রবিউলসহ ১০ জন আহত হন। পুলিশ জানিয়েছে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা ওই দু’টি ভোট কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সহিসংতায় জড়িয়ে পড়ে। একই ইউনিয়নের পানাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঘুড়ি প্রতীকের মেম্বার পদ প্রার্থী আসাদুজ্জামানকে কুপিয়ে জখম করে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়নের কালডাঙ্গা দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে দুপুর আনুমানিক দু’টায় ভোট চলাকালে তালা প্রতীকের মেম্বার পদ প্রার্থী গিয়াসউদ্দিনের সমর্থকদের সঙ্গে অপর মেম্বার পদ প্রার্থী টিউবওয়েল প্রতীকের আলমের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রথমে রাবার বুলেট ব্যবহার করে এবং পরে গুলি চালায়। এই সময় গুলিতে ঘটনাস্থলে মাছখুরিয়া গ্রামের এইচ এস সি পরীক্ষার্থী মাহবুব হোসেন নিহত হন এবং আরো চারজন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের মোমিনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্র দখলকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আমিনুল ইসলাম আমিন ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ওমর আলীর সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে উভয় পক্ষই লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে। এই সময় হেদায়েত হোসেন নামে একজন গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হন।১৭ ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের অলি নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুর্বৃত্তরা হামলা চালালে পুলিশ বাধা দেয়। এই সময় দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া শর্টগানের ছররা গুলিতে মোহাম্মদ ইয়াছিন নামে পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়া ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার মহামায়া ইউনিয়নের উত্তর সতর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুই ইউপি সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কাজী রাসেল, রফিকুল ইসলাম, বাবলু, মুসা মিয়া, আরাফাত, কবির মাস্টারসহ ৬ জন গুলিবিদ্ধ হন। ভোট শুরুর আগে শুভপুর ইউনিয়নের জগন্নাথ সোনাপুর কেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই ইউপি মেম্বার পদ প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ইউপি মেম্বার পদ প্রার্থী শাহজাহান, তার স্ত্রী হোসনে আরা বেগম, শাহাদাত হোসেন, জয়নাল আবদীন, আমান উল্লাহসহ ৪ জন গুলিবিদ্ধ হন। ছাগলনাইয়ার ঘোপাল ইউনিয়নের নিজকুঞ্জরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী আজিজুল হককে সরকার দলীয় সমর্থকরা পিটিয়ে আহত করে।

ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার হরিশংকরপুর ইউনিয়নের পানামি সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়, হরিশংকরপুর, সিতারামপুর কেন্দ্রে নৌকা প্রতীক ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ছিল না। হরিনাকুন্ডু উপজেলার শিতলী মান্দারতলা, ভাতুড়িয়া, কাপাশহাটিয়া, ঘোড়দা কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের নানাভাবে ভয় দেখানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। ভোটারদের পথে পথে বাধা দেয়ার ঘটনাও ঘটে। রঘুনাথপুর ইউনিয়নের ভবিতপুর কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এই কেন্দ্রে এক মহিলা ভোটার তার ভোট দিতে এসে তা দিতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। নিত্যানন্দপুর, পোড়াহাটি ও আড়–য়াকান্দি কেন্দ্রে ব্যাপক হারে জাল ভোট দিতে দেখা গেছে। চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার চিকনদন্ডী ইউপির নন্দিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে সকাল আনুমানিক ১০. ৩০ টায় এলাকার ২০/৩০ জন যুবক প্রকাশ্যে গুলি ছুঁড়ে ভোটারদের ছত্রভঙ্গ করে ভোটকেন্দ্র দখল করে নিয়ে পুলিশের সহায়তায় জালভোট দিতে থাকে। একই উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের চারিয়া ভোটকেন্দ্রে প্রভাব বিস্তারের সময় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আমিন রনি ও হাটহাজারী উপজেলা আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আরেফুর রহমানকে পিস্তলসহ আটক করেন। একই উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সকাল আনুমানিক ১১. ০০ টায় কোন ভোটার ছিল না। আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগ এই কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেয় । সকাল আনুমানিক ১০ . ০০ টা থেকে ১১ . ০০ টা পর্যন্ত ফতেপুর লতিফ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষের কারণে ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার সুভাষ চন্দ্র জানান, দুবৃর্ত্তরা হামলা চালিয়ে ব্যালট পেপার ও সিল ছিনতাইয়ের কারণে ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল।

 

৯টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত:

১৭. গত ২৫ মে নরসিংদী জেলার ঘোড়াশাল ও রায়পুরা, লক্ষীপুর জেলার সদর, ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার কসবা, নোয়াখালী জেলার সদর ও সেনবাগ, ফেনী জেলার ছাগালনাইয়া, কক্সবাজার জেলার টেকনাফ এবং খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়সহ মোট ৯টি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট দেয়া ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। লক্ষীপুর পৌরসভার অধিকাংশ কেন্দ্রে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী রেজাউল করিম লিটনের কোনো এজেন্ট পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবু তাহেরের সমর্থকরা তাঁদের বের করে দিয়ে জাল ভোট দেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া পৌরসভায় সকালে ভোট গ্রহণের শুরুতেই বহিরাগতরা অধিকাংশ কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারে। আতংক ছড়াতে ভোর থেকেই ভোট কেন্দ্রের আশে পাশে হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ১০টি কেন্দ্রে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ আলমগীরের কোনো এজেন্টকে ঢুকতে দেয়নি সরকার সমর্থকরা। ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার কসবা পৌরসভায় কসবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকে প্রকাশ্যে সিল মারার অভিযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া কসবা বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে কযেকজন ভোটার অভিযোগ করেন, পোলিং অফিসার শুধু কাউন্সিলারের ব্যালট পেপার দিয়েছেন। মেয়র পদের ব্যালট পেপারে আগে থেকেই ক্ষমতাসীনদলের মনোনীত প্রার্থীর প্রতীকে সিল মারা ছিল।২১ কসবা সরকারি বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে পুলিশ সদস্যদের সামনেই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকরা প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারে। এই কেন্দ্রে সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়।

 

পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন:

১৮. ব্যাপক সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, ভোট ডাকাতি ও বর্জনের মধ্যে দিয়ে গত ২৮ মে ৫ম ধাপে ৭৩৩ টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনকালীন সহিংসতায় ২ জন প্রার্থীসহ অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৬’শ। এছাড়া ভোটগ্রহণকালীন সময়ে ৪৫ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন। নির্বাচন বর্জনকারীদের মধ্যে ৩৮ জন বিএনপি, ২ জন আওয়ামী লীগ, ৪ জন স্বতন্ত্র ও ১ জন জাসদ সমর্থিত প্রার্থী রয়েছেন। ব্যাপক অনিয়ম, ভোটকারচুপি ও সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ও সেনবাগ উপজেলায়। এইসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন বেগমগঞ্জ উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৫টি ইউনিয়নের ৫৬টি কেন্দ্রে এবং সেনবাগ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ২৬টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করে। এছাড়া সহিংসতায় নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ ইউনিয়নের দারুল উলুম ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে সংঘর্ষ চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তাড়া খেয়ে সৈয়দ আহাম্মদ (৫৫) মাথা ও পেটে আঘাত পান এবং হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান। একই উপজেলার জীরতলী ইউনিয়নের কেবি উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলিতে শাকিল আহমেদ (১৭) নামের এক পথচারি নিহত হন। কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ।

ভোট গ্রহণের দিন বেলা আনুমানিক ৩. ০০ টায় নাগেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের বাইরে এই ঘটনা ঘটে।২৮ জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের খুটারচর এবতেদায়ি মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শাকিরুজ্জামান রাখাল ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শাহজাহান মিয়ার সমর্থক ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এই সময় পুলিশ গুলি চালালে আব্দুল মাজেদ (১৪), জিয়াউর রহমান জিয়া (৩০), নুর ইসলাম (৬০) ও আলতাফ (৩২) নিহত হন।  অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন পরিষদের সবকটিতেই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। মোগড়াপাড়া ইউনিয়নের মোগড়াপাড়া হাই স্কুল ভোটকেন্দ্রে পরাজিত মেম্বার পদ প্রার্থী প্রায় শতাধিক ব্যালট পেপার ছিঁড়ে ফেললে সেখানে সংঘর্ষ হয়। একই ইউনিয়নের কাবিলগঞ্জ ভোটকেন্দ্রে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুজনের নেতৃত্বে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা হয়। এই সময় পুলিশ ৫ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। নোয়াগাঁও ইউনিয়নের লক্ষীবরদী এলাকায় দুইপক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় ইদ্রিস আলী (৭৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। ভোট গ্রহণের দিন সকাল আনুমানিক ১১. ৩০ টায় দুদঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে মেম্বার পদ প্রার্থীর ১শ পাতার একটি ব্যালট বই ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।৩০ বেলা আনুমানিক ১২. ০০ টায় চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার আশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের আসাদ আলী মাজার ভোটকেন্দ্রে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে বাবুল শীল (৫৭) নিহত হন। বেলা আনুমানিক ১. ০০ টায় বড় উঠান ইউনিয়নের শাহমিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের পাশে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী দিদারুল আলম ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল মান্নানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে হয়। এই সময় ওই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার পদ প্রার্থী মোহাম্মদ ইয়াসিন (৪১) ও রিক্সা চালক নুরুল ইসলাম (৫০) ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হওয়ার পর মোহাম্মদ ইয়াসিন ঘটনাস্থলেই এবং নুরুল ইসলাম হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান।

 

১৯.  বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচন ব্যবস্থায় যে ধরনের দুর্বৃত্তায়ন ঘটানো হয়েছে তাতে সম্পূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে। ফলে জনগণ তাঁদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে থাকাকালীন ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সময়ে তাদের নেতৃত্বাধীন জোট ও জনগণের আন্দোলনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজিত হয়। অথচ ২০১১ সালে কোন রকম গণভোট ছাড়াই এবং বিরোধীদলসহ বিভিন্ন মহলের ব্যাপক প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী যুক্ত করার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয় এবং দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার বিধান বলবৎ করা হয়। এরফলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি’র প্রতারণামূলক ও বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের বর্জন সত্ত্বেও অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই শুরু হয় নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বৃত্তায়ন। এরপর থেকে অনুষ্ঠিত সবগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতি, অনিয়ম ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এই দুবৃত্তায়নের ফলে দেশে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন?

  
  সর্বশেষ
খুলনার কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনি`র মৃত্যুতে জানিপপ চেয়ারম্যানের শোক
কক্সবাজার জেলা পরিষদের নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আল মারুফের যোগদান
৮০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস, হুঁশিয়ারি সংকেত
মাদক কারবারে ককস বাজারের সাবেক এমপি বদির দুই ভাইয়ের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে সিআইডি

Md Reaz Uddin Editor & Publisher
Editorial Office
Kabbokosh Bhabon, Level-5, Suite#18, Kawran Bazar, Dhaka-1215.
E-mail:manabadhikarkhabar11@gmail.com
Tel:+88-02-41010307
Mobile: +8801978882223 Fax: +88-02-41010308