শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
শিরোনাম : * ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’   * বাল্যবিবাহের কারণে বাড়ছে মাতৃ ও শিশু মৃত্যু: জাতীয় মানবাধিকার কমিশন   * চট্টগ্রামে আব্দুল জব্বারের বলীখেলার নতুন চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শরীফ বলী;   * ঢাকা,চাঁদপুর, নোয়াখালী ও ফেনী পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান ;   * গাজীপুরে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে অগ্নিকাণ্ড   * কক্সবাজারের টেকনাফে ধরা পড়ল ৪০০ কেজি ওজনের তলোয়ার মাছ   * মিয়ানমারের ২৮৮ সেনা ও বিজিপি সদস্যদের হস্তান্তর   * ট্রাকচাপায় সড়কে ঝড়ল অটোরিকশা চালকের প্রাণ   * ৭নং ওয়ার্ডে এনজিও সংস্থা প্রত্যাশী এর সেমিনার অনুষ্ঠিত ;   * কুড়িগ্রামে অযৌক্তিক রেলভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে মানববন্ধন  

   অধিকারের প্রতিবেদন
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদন
  Date : 02-06-2016

গুম রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার

মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন

মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা “অধিকার” ‘সংবাদ মাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা প্রদান,  রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকারিদলের ব্যাপক অনিয়ম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, আটকের পর আটককৃতদের পায়ে গুলি করার প্রবণতা,  ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করার অভিযোগ, গণপিটুনীতে মানুষ হত্যা, সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারীর প্রতি সহিংসতা ও অধিকারের কর্মকা-ে বাধা প্রদানে’র বিষয়ে কিছুটা বিলম্ভে হলেও তাদের এপ্রিল মাসের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

 

 

 

মানবাধিকার খবর ডেস্ক :

 

প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়, অধিকার মনে করে ‘গণতন্ত্র’ মানে নিছক নির্বাচন নয়, রাষ্ট্র গঠনের-প্রক্রিয়া ও ভিত্তি নির্মাণের গোড়া থেকেই জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় নিশ্চিত করা জরুরি। সেটা নিশ্চিত না করে যাত্রা শুরু করলে তার কুফল জনগণকে বয়ে বেড়াতে হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার সমস্ত ক্ষেত্রে জনগণ নিজেদের ‘নাগরিক’ হিসেবে ভাবতে ও অংশগ্রহণ করতে না শিখলে সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে ‘গণতন্ত্র’ গড়ে ওঠে না। নাগরিক হিসেবে নিজেদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় এবং মানবিক চাহিদা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শাসন ব্যবস্থার নি¤œ স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত নেবার ব্যবস্থা গড়ে না উঠলে তাকে ‘গণতন্ত্র’ বলা যায় না। অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিজের অধিকার ও দায় সম্পর্কে নাগরিকদের উপলব্ধি ঘটে এবং তার মধ্যে দিয়েই অপরের অধিকার এবং নিজেদের সমষ্টিগত স্বার্থ ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। এর কোন বিকল্প নাই। জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় যে মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকারকে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সংসদের কোন আইন, বিচার বিভাগীয় কোন রায় বা নির্বাহী কোন আদেশের বলে সেই সমস্ত অধিকার রহিত করা যায় না। তাদের অলঙ্ঘনীয়তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তির মর্যাদা অলঙ্ঘনীয়। প্রাণ, পরিবেশ ও জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান করা ছাড়া রাষ্ট্র নিজের ন্যায্যতা নাগরিকদের কাছে প্রমাণ করতে পারে না। বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীদের গণভিত্তিক সংগঠন অধিকার ব্যক্তির মর্যাদা সমুন্নত ২ রাখবার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সমস্ত মানবিক ও নাগরিক অধিকার এবং দায়িত্ব রক্ষা ও পালনের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মানদ- ঐতিহাসিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে মানবেতিহাস অর্জন করেছে এবং এইসব নাগরিক ও মানবিক অধিকারের সার্বজনীনতা নানান আন্তর্জাতিক ঘোষণা, সনদ ও চুক্তির মধ্যে দিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কারণে অধিকার বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনকে নিছকই রাষ্ট্রের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ‘ব্যক্তি’কে রক্ষার ব্যাপার মাত্র বলে মনে করে না; বরং ব্যক্তির নাগরিক ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন ও সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বলে মনে করে। এই লক্ষ্য নিয়েই অধিকার বাংলাদেশের জনগণের নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। চরম রাষ্ট্রীয় হয়রানি ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থেকেও অধিকার ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করলো।

 

সংবাদ মাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা প্রদান চলছে :

১. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সরকার কঠোরভাবে দমন করছে। সংবাদ মাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপসহ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা ও দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রাখার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে জেল-জরিমানার বিধান রেখে নিবর্তনমূলক জাতীয় সম্প্রচার আইনের একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে সরকারি নজরদারী বলবৎ রয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি বা তাঁদের পরিবারের সমালোচনাকারীসহ সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন কোন তথ্য প্রকাশের ফলশ্রুতিতে নিবর্তনমূলক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০০৯ ও ২০১৩) প্রয়োগ করা হচ্ছে।

 

নিবর্তনকমূলক জাতীয় সম্প্রচার আইনের খসড়া প্রকাশ

২. গত ২০ এপ্রিল জেল-জরিমানার বিধান রেখে ‘জাতীয় সম্প্রচার আইন’ এর খসড়া নামে একটি নিবর্তনমূলক আইনের খসড়া প্রকাশ করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এই ‘জাতীয় সম্প্রচার আইন’ এর বিধিবিধান বা প্রবিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদ- এবং কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- দেয়া হবে। এরপরও সম্প্রচার আইনে অপরাধ চলতে থাকলে প্রতিদিনের জন্য অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে।১ এই আইন লঙ্ঘন করে সম্প্রচার মাধ্যম পরিচালনা করলে লাইসেন্স বাতিল ছাড়াও সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা যাবে বলে উল্লেখ রয়েছে এই খসড়াতে। প্রশাসনিক আদেশ বা নির্দেশে এই জরিমানা আদায় করা যাবে। তবে প্রশাসনিক আদেশ বা নির্দেশে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি ক্ষতিপূরণ লাভের অধিকারী হবেন না। এমনকি এমন দাবি আদালত বা কর্তৃপক্ষের কাছে উত্থাপনও করা যাবে না। আইনে বলা আছে, ‘যদি কেউ এমন দাবি উত্থাপন করেন, তাহলে আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ তা সরাসরি বাতিল করতে পারবে’।

৩. অধিকার এর সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল মাসে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ৬ জন সাংবাদিক আহত এবং ১ জন হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। এই সময়ে ৪ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

 

প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেফতার ও ১০ দিনের রিমান্ড

৪. গত ১৬ এপ্রিল সকালে সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমানকে (৮২) ঢাকার ইস্কাটনের তার নিজ বাসবভন থেকে বৈশাখী টিভির সাংবাদিক পরিচয়ে গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা (ডিবি) বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করে। গোয়েন্দা পুলিশ শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তা স্বীকার করে। ২০১৫ সালের অগাষ্টে ঢাকার পল্টন থানায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা পরিকল্পনার কারণে দায়ের করা একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই দিন দুপুরে ডিবি পুলিশ শফিক রেহমানকে ঢাকা মহানগর হাকিম মাজহারুল ইসলামের আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। প্রথম ৫ দিনের রিমান্ড শেষে গত ২২ এপ্রিল শফিক রেহমানকে ঢাকা মহানগর হাকিম মাহমুদুল হাসানের আদালতে হাজির করে ডিবি পুলিশ পুনরায় সাতদিনের রিমান্ডের আবেদন করে। অন্যদিকে, শফিক রেহমানের আইনজীবীরা রিমান্ডের শুনানি পিছিয়ে দিয়ে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং তার স্ত্রী ও আইনজীবীদের সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু আদালত শফিক রেহমানের আইনজীবীদের আবেদন খারিজ করে দিয়ে পুনরায় পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গত ২০ এপ্রিল শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া রেহমান সংবাদ সম্মেলন করে শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট হিসেবে উল্লেখ করে তার মুক্তি দাবি করেন। গত ২৫ এপ্রিল তালেয়া রেহমান আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করে শফিক রেহমানকে দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়ায় তার জীবনহানি হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তালেয়া রেহমান বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ শফিক রেহমান সম্পর্কে যেভাবে একপেশে, অসত্য ও বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করছেন তাঁতে তিনি শঙ্কিত যে, এই মামলার তদন্ত কাজ সঠিকভাবে এগোবে কিনা এবং তারা ন্যায় বিচার পাবেন কিনা।

 

তিন বছর ধরে জেলে আটক মাহমুদুর রহমান বারবার রিমান্ডে

৫. আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান (৬২) তিন বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল ডিবি পুলিশ মাহমুদুর রহমানকে আমার দেশ পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করে।৫ এরপর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানায় অভিযান চালিয়ে কম্পিউটার ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র জব্দ করে এবং রাত পৌনে ১১ টায় ছাপাখানা সিলগালা করে দেয়।৬ এর আগে ২০১০ সালের ২১ এপ্রিল ‘চেম্বার জজ মানে সরকার পক্ষের স্টে’ এই শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করায় আদালত অবমাননার একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১০ সালের ১৯ অগাস্ট মাহমুদুর রহমানকে ছয়মাসের কারাদ- দেয়। ২০১৫ সালের ১৩ অগাস্ট ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী আদালত সম্পদের হিসাব চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের নোটিশের জবাব না দেয়ার অভিযোগে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে তিন বছরের কারাদ- ও একলাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো এক মাসের কারাদ-ের রায় ঘোষণা করে। সারাদেশে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে মোট ৭২ টি মামলা দায়ের করা হয়, যার বেশির ভাগই মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা। এরপর বিভিন্ন সময়ে দায়ের করা সবগুলো মামলায় তিনি জামিন পান এবং সর্বশেষ মামলায় ১৪ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ থেকে জামিন পাওয়ার পরও অপর একটি মামলায় প্রডাকশন ওয়ারেন্ট এর আদেশ প্রত্যাহারের পর মাহমুদুর রহমানের মুক্তির ক্ষেত্রে যখন কোন বাধাই ছিল না, তখন প্রডাকশন ওয়ারেন্ট এর আদেশ জেলখানায় পাঠাতে সময়ক্ষেপণ করে এবং ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে শাহবাগ থানায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের হওয়া (মামলা নম্বর ৫০(১)/১৩) একটি মামলায় তাকে ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ দেখানো হয়। এই মামলায়ও উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান মাহামুদুর রহমান এবং তার আইনজীবী তার পক্ষে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে তার মক্কেলকে যাতে আর কোন মামলায় ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ দেখানো না হয়, সেই জন্য আদালতের নির্দেশনা চান। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এই আবেদন মঞ্জুর করে মাহামুদুর রহমানকে আর কোন মামলায় ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ না দেখানোর জন্য নির্দেশ দেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগের চেম্বার জজের কাছে আবেদন করলে চেম্বার জজ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে দেন। ফলে গত ২৭ মার্চ মাহমুদুর রহমানকে মতিঝিল থানার একটি মামলায় ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। গত ৬ এপ্রিল ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে এই মামলার শুনানীর সময় মাহমুদুর রহমানের আইনজীবীরা বলেন, যে মামলায় তাকে গ্রেফতার ও রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে তার আগে থেকেই তিনি কারাগারে বন্দি আছেন। আদালত এই মামলার শুনানীর পর মামলায় গ্রেফতার দেখানো ও তার রিমান্ডের ব্যাপারে আবেদন নাকচ করে দেয়। এরপর গত ৫ এপ্রিল কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। গত ১২ এপ্রিল এই মামলায় ঢাকার মহানগর হাকিম রিমান্ড আবেদন নাকচ করে চার কার্যদিবসে কারাফটকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন। গত ১৬ এপ্রিল সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমানকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা পরিকল্পনার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। এরপর এই মামলাতেও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গত ২২ এপ্রিল মাহমুদুর রহমানের মা অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম এক সংবাদ সম্মেলন করে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করেছেন। গত ২৫ এপ্রিল সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা পরিকল্পনার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় মাহমুদুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন ডিবির সিনিয়র সহকারী কমিশনার হাসান আরাফাত। ঢাকার মহানগর হাকিম গোলাম নবী পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গত ২৯ এপ্রিল দুপুরে মাহমুদুর রহমানকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়।

 

রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন :

৬. বাংলাদেশে রিমান্ডের সমর্থক শব্দ হলো নির্যাতন। রিমান্ডে নিয়ে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা শুধু ফৌজদারী অপরাধই নয় বরং মানবাধিকারের চরম লংঘন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা আছে “কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবেনা কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দ- দেয়া যাবে না কিংবা কারো সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না”। ২০১৩ সালে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগ এই নির্দেশনায় বলেছেন, রিমান্ড মঞ্জুরের আগে এবং রিমান্ড থেকে ফেরার পর নিম্ন আদালতকে মেডিকেল রিপোর্ট পরীক্ষা করতে হবে। অভিযুক্তকে হেফাজতে নেয়ার পর তার আত্মীয় স্বজনকে খবর দিতে হবে। আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে দিতে হবে এবং আইনজীবীর উপস্থিতিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এমন একটি ঘরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে যেখানে তাকে বাইরে থেকে দেখা যায়। কিন্তু পুলিশ ও নি¤œ আদালত হাইকোর্ট বিভাগের এই নির্দেশনাকে প্রতিনিয়ত উপেক্ষা করে চলেছে। নি¤œ আদালত রিমান্ড মঞ্জুরের আগে এবং রিমান্ড থেকে ফেরার পর মেডিকেল রিপোর্ট পরীক্ষা করছে না এবং রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ অভিযুক্তদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। ব্লগার, শিক্ষকসহ সমকামীদের অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিনের সম্পাদক হত্যা

৭. সরকার ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর হামলা অব্যাহত রাখায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যতই মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে ততই দেশে চরমপন্থার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে এবং আইন শৃংখলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়ে হত্যাসহ ভয়াবহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে। ২০১৩ সাল থেকে দেশে ব্লগার অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, বিদেশী নাগরিক, শিক্ষক, সমকামীদের অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিন এর সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকা-গুলোর কয়েকটির দায় স্বীকার করেছে একটি চরমপন্থী সংগঠন।

৮. গত ৬ এপ্রিল রাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নাজিমউদ্দিন সামাদ সান্ধ্যকালীন ক্লাশ শেষ করে তার গে-ারিয়াস্থ মেসে ফেরার পথে লক্ষীবাজারের একরামপুর মোড়ে পাঁচ-ছয়জন দুবৃর্ত্ত তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে। নাজিমের পরিবার ও বন্ধুরা বলেন, ফেসবুকের বিভিন্ন স্ট্যাটাসে নাজিম উদ্দিন জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধতা ও সরকারের সমালোচনা করে লেখালেখির কারণে তাকে খুন করা হয়েছে। এই ঘটনায় সূত্রাপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

৯. গত ২৩ এপ্রিল সকাল আনুমানিক সাড়ে ৭ টায় রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানার শালবাগান এলাকার বটতলা মোড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম সিদ্দিকী কে কুপিয়ে হত্যা করেছে অজ্ঞাত দুবৃর্ত্তরা।

১০.গত ২৫ এপ্রিল রাতে ঢাকার কলাবাগান থানাধীন উত্তর ধানমন্ডির বাসায় ঢুকে অজ্ঞাত দুবৃর্ত্তরা সমকামীদের অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘রূপবান’ এর সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে। জুলহাজ মান্নান ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন।

১১. গত ৩০ এপ্রিল দুপুর আনুমানিক ১২ টায় টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার পাকুটিয়া-সূতিকালীবাড়ি সড়কের কাছে নিখিল জোয়ার্দার (৫০) নামে এক দর্জিকে তার দোকান থেকে ডেকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে আসা তিন যুবক কুপিয়ে হত্যার পর আবার মোটরসাইকেলে করেই চলে যায়। এই ব্যাপারে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে নিখিল জোয়ার্দার হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে নিয়ে কটুক্তি করার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন।

১২.অধিকার দেশের নাগরিকদের মত প্রকাশ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ অব্যাহত থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। অধিকার মনে করে কোন নাগরিকের মতামত সরকারের বিপক্ষে গেলেই তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে গ্রেফতার বা হয়রানি করা হচ্ছে। অধিকার অবিলম্বে নিবর্তনমূলক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০০৯ ও ২০১৩) বাতিলের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে এবং প্রস্তাবিত নিবর্তনমূলক ‘জাতীয় সম্প্রচার আইন’ এর ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। অধিকার নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ব্লগার, শিক্ষক, বিদেশী নাগরিক, সমকামী অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিন এর সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের হত্যার সঙ্গে জড়িত দুর্বৃত্তদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে জনগণের স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সভাসমাবেশ করার অধিকারকে দমন করা থেকে নিবৃত্ত থাকতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।

 

রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, জাল ভোট প্রদান ও কেন্দ্র দখল অব্যাহত

রাজনৈতিক সহিংসতা:

১৩.অধিকার এর প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ২৯ জন নিহত ও ১৩৭৯ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় ২৪ জন নিহত ও ১১৯৩ জন আহত হয়েছেন। এই মাসে আওয়ামী লীগের ৪৮টি এবং বিএনপি’র ২ টি অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ১১ জন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। একই সময়ে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আওয়ামী লীগের ৪৫৬ জন এবং বিএনপি’র ২৭ জন আহত হয়েছেন বলেও জানা গেছে।

১৪. রাজনৈতিক সহিংসতা অব্যাহত আছেই। দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরো সহিংসতা তীব্র আকার ধারন করেছে এবং তা দেশের গ্রামঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া সারাদেশে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসংখ্য অন্তর্দলীয় কোন্দলের ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অন্যায় স্বার্থ হাসিলকে কেন্দ্র করে এইসব কোন্দলের ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা গেছে। এছাড়া বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা করা হচ্ছে। বেশিরভাগ ঘটনায় সরকারিদলের নেতাকর্মীদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি। এই রকম অনেকগুলো ঘটনার মধ্যে দুটি ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো:

১৫. গত ১১ এপ্রিল ঢাকার শিক্ষা ভবনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমানের সমর্থকদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মহসিন হল শাখা আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল রানা মিঠুর সমর্থকদের মধ্যে ৪৪ কোটি টাকার টেন্ডারের দখল নিয়ে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের ঘটনায় ১০ জন আহত হয়।

১৬. গত ১১ এপ্রিল রাত আনুমানিক সাড়ে দশটায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সহসভাপতি ইব্রাহীম খলিল বিপ্লব পরীক্ষার নোট সংগ্রহ করতে ক্যাম্পাসে গেলে তার ওপর হামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের মানব বিষয়ক উপ-সম্পাদক ফিরোজুর রহমান সবুজ, সহসম্পাদক মেহেদী হাসান রোমানসহ কয়েকজন নেতাকর্মী। লোহার পাইপ ও রড দিয়ে পিটিয়ে ইব্রাহীম খলিল বিপ্লবের ডান হাত ও ডান পা ভেঙ্গে দেয় তারা। ইব্রাহীম খলিলকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে।

 

তিন ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনী সহিংসতায় ৬৪ জন নিহত

১৭.ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পরই নির্বাচনী সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করে; যা মনোয়ন পত্র জমা দেয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনী সহিংসতায় মোট ৬৪ জন নিহত ও অন্ততপক্ষে ৩১১২ জন আহত হয়েছেন। তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের সহিংসতায় মোট ২০ জন নিহত এবং অন্ততপক্ষে ৭৮৪ জন আহত হয়েছেন।

১৮.গত ১১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন ছয়টি ধাপে মোট ৪২৭৫টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করে। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন হত্যা, সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়া, জাল ভোট দেয়া, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর হামলার মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন ও সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলো ছিল বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে কলংকিত নির্বাচন। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের ঘটনা অন্ততপক্ষে তিনগুন বেড়েছে এবং এর জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের দায়ী করেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। তারা জানিয়েছে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আট হাজার দুই শত এর বেশি ব্যক্তি, পরিবার এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ২৩ এপ্রিল তৃতীয় ধাপে ৬১৪টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের কেন্দ্র দখল, প্রকাশ্যে জাল ভোট দেয়া ও হামলার মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে ঘুরিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে নিচে মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।

১৯. মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের নির্বাচন সংঘর্ষ, কেন্দ্র দখল ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীকোল ইউনিয়নের বারইপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থীর সমর্থরা জোরপূর্বক কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল দিয়ে বাক্সে ঢুকায়। দুইটি ব্যালট বই ছিনতাই হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঐ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা। ফলে এই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। একই ইউনিয়নের পূর্ব-শ্রীকোল ভোট কেন্দ্রের সামনে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী-সমর্থক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রায় এক ঘন্টা ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০টি ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বাকি ৫টি ইউনিয়ন কলমা, খিদিরপাড়া, বেজগাঁও, কনকসার ও হলদিয়া ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের আগের দিন ২২ এপ্রিল রাতে বেজগাঁও ইউনিয়নে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মাঈনুল ইসলাম ভূঁইয়ার বাড়িতে হামলা করে ভাংচুর করা হয় এবং তার কর্মী-সমর্থকদের পিটিয়ে আহত করা হয়। মাঈনুল ইসলামের বাড়ি থেকে উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহানকে আটক করা হয়। এরপর পুলিশ এলাকায় দুবৃর্ত্তদের ধরার জন্য অভিযানের নামে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে হানা দেয়। এতে বিএনপি সমর্থক ভোটার এবং নেতাকর্মীরা আতংকিত হয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আমির হোসেন তালুকদারের কর্মী সমর্থকরা এলাকায় মহড়া দেয় এবং বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারে। খিদিরপুর ইউনিয়নের বাসুদিয়া নেসারিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যে ৮৭০টি ভোট কাস্ট হয়। কলমা ইউনিয়নের ফলাপাকড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট ৭৮৫টি ভোটের মধ্যে বেলা ১১টার মধ্যে কাস্ট হয় ৪৫০টি ভোট। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার সরাইল উপজেলার চুন্টা ইউনিয়নের এসি একাডেমী কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে পাঁচটি বুথে জোর করে ঢুকে জাল ভোট দেয়া হয়। এই সময় ছবি তুলতে গেলে দুবৃর্ত্তদের হামলায় এটিএন নিউজের পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরো প্রধান পীযূষ কান্তি আচার্য, ফটো সাংবাদিক সুমন রায় ও হাসান জাবেদ আহত হন।

২০. বর্তমান সরকারের সময়ে নির্বাচন ব্যবস্থায় যে ধরনের দুর্বৃত্তায়ন ঘটানো হয়েছে তাতে সম্পূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং জনগণ তাঁদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে থাকাকালীন ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সময়ে তাদের নেতৃত্বাধীন জোট ও জনগণের আন্দোলনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজিত হয়। অথচ ২০১১ সালে কোন রকম গণভোট ছাড়াই এবং বিভিন্ন মহলের ব্যাপক প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয় এবং দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার বিধান বলবৎ করা হয়। এরফলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের বর্জন সত্ত্বেও অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই শুরু হয় নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বৃত্তায়ন। এরপর থেকে অনুষ্ঠিত সবগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, সহিংসতা এবং ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। স্বাধীনভাবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। অথচ নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে এবং তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হয়েছে বলে কমিশনের কর্মকর্তারা দাবি করছেন।

 

শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে পুলিশী বাধা

২১. কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনু হত্যাসহ দেশজুড়ে অব্যাহত গুম-খুন-ধর্ষণ ও বিচারহীনতার প্রতিবাদে সারাদেশে প্রগতিশীল ছাত্র জোট ও সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যে গত ২৫ এপ্রিল অর্ধেক দিন দেশব্যাপী হরতাল ডাকে। হরতালের সময় বরিশালে প্রগতিশীল ছাত্র জোট অশ্বিনী কুমার হল চত্বরে সমাবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয় এবং একপর্যায়ে ব্যানার ছিনিয়ে নিয়ে লাঠিচার্জ করে। এতে ১৫ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রংপুর শহরের লালবাগ এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের কর্মীরা প্রগতিশীল ছাত্র জোটের পাঁচ নেতা-কর্মীকে পিটিয়ে আহত করে। হরতালের সমর্থক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করলে তাঁদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এতে ১০ জন আহত হন। পুলিশ ১২ জন শিক্ষার্থীকে আটক করে আশুলিয়া থানায় নিয়ে যায়। হরতালের পর তাঁদের মুক্তি দেয় পুলিশ।

২২. অধিকার মনে করে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছিয়েছে, তাতে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভীন্নমতাবলম্বীদের নির্মমভাবে দমনের কাজে ব্যবহার করছে। এছাড়া সরকারিদলের সমর্থক দুর্বৃত্তরা প্রাণঘাতি অস্ত্র নিয়ে ও বিভিন্ন সময়ে পুলিশের সঙ্গে থেকে এবং তাদের সহযোগিতায় বিরোধীদল ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করায় বহু নিরীহ মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অধিকার মনে করে, মানবিক ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।

 

বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-

২৩. বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- অব্যাহতভাবেই চলছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- অব্যাহত থাকায় দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। অধিকার এর প্রাপ্ত তথ্য মতে এপ্রিল মাসে ১১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

 

মৃত্যুর ধরণ

ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার/বন্দুকযুদ্ধঃ

২৪. নিহত ১১ জনের মধ্যে ৭ জনই ‘ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার/বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৩ জন পুলিশের হাতে এবং ৪ জন র‌্যাবের হাতে নিহত হয়েছেন।

 

গুলিতে নিহত:

২৫. এইসময়ে ৪ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

 

নিহতদের পরিচয় ঃ

২৬. নিহত ১১ জনের মধ্যে ১ জন বিএনপি’র কর্মী, ১ জন গণবাহিনীর সদস্য, ৪ জন কৃষক এবং ৫ জন কথিত অপরাধী বলে জানা গেছে।

২৭. চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার গ-ামারা এলাকায় বৃহৎ কয়লা বিদুৎ স্থাপনের জন্য এস আলম গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এই প্রকল্পের জন্য ভুমি অধিগ্রহণ নিয়ে শুরু থেকেই এলাকাবাসীর সঙ্গে এস আলম গ্রুপের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। এলাকাবাসী প্রকল্পের নামে সাধারণ মানুষকে নানাভাবে প্রতারিত করার কারণে দারুনভাবে ক্ষুদ্ধ ছিল। এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে প্রকল্পের লোকজনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গত ২ এপ্রিল এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ভাই শহীদুল আলম প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গেলে এলাকাবাসী তাদের গাড়ী বহরে হামলা করে। এই ঘটনায় বাঁশখালী থানায় মামলা দায়ের করা হলে পুলিশ হামলাকারী সন্দেহে সাত জন স্থানীয় বাসিন্দাকে গ্রেফতার করে। তাঁদের মুক্তির দাবিতে গত ৪ এপ্রিল এলাকাবাসী ‘বসতভিটা রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে গ-ামারা এলাকায় সমাবেশের আয়োজন করে। অন্যদিকে একই জায়গায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের অনুসারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল আলম কয়লা ভিত্তিক বিদুৎ প্রকল্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে এক সমাবেশের আহ্বান করে। পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডাকায় স্থানীয় প্রশাসন ঐ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু এলাকাবাসী ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে সমাবেশ করতে চাইলে পুলিশ ও তাদের সঙ্গে থাকা দুর্বত্তরা এলাকাবাসীর ওপর গুলি ছোঁড়ে। এতে শতাধিক লোক গুলিবিদ্ধ হয়। এরমধ্যে গ-াগ্রাম এলাকার মরতুজা আলী (৫২) ও তার ভাই আংকুর আলী, জাকের আহমেদ (৩৫) ও জহির উদ্দিন গুলিতে নিহত হন। ২৪ এই ঘটনায় বাঁশখালী থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ এবং অপর দুইটি মামলা দায়ের করেছেন নিহতদের স্বজনরা। পুলিশের দায়ের করা মামলায় গ-ামারা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত আলীসহ ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতনামা ৩ হাজার ২০০ জনকেও আসামি করা হয়েছে।

 

আটকের পর আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আটককৃতদের পায়ে গুলি করার প্রবণতা

২৮. অধিকার এর প্রাপ্ত তথ্য মতে এপ্রিল মাসে ৩ জনকে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আটকের পর পায়ে গুলি করেছে বলে জানা গেছে।

২৯. সরকার বিরোধী বিক্ষোভ দমন করার নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কর্তৃক আটককৃতদের পায়ে গুলি করার একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেজনক। এই প্রবণতাটি ২০১১ সাল থেকে শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষও এই পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। এইক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়মুক্তি ভোগ করছে।

৩০. যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার দিকদেনা গ্রামের ইস?

  
  সর্বশেষ
ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
বাল্যবিবাহের কারণে বাড়ছে মাতৃ ও শিশু মৃত্যু: জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
চট্টগ্রামে আব্দুল জব্বারের বলীখেলার নতুন চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শরীফ বলী;
ঢাকা,চাঁদপুর, নোয়াখালী ও ফেনী পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান ;

Md Reaz Uddin Editor & Publisher
Editorial Office
Kabbokosh Bhabon, Level-5, Suite#18, Kawran Bazar, Dhaka-1215.
E-mail:manabadhikarkhabar11@gmail.com
Tel:+88-02-41010307
Mobile: +8801978882223 Fax: +88-02-41010308