আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে ৩১ জুলাই রাত ৮টার দিকে কুড়িগ্রামের ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি হন ফুলবাবু দাস নামে এক তরুণ। ভর্তির পর থেকে তাঁর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। একপর্যায়ে মুখ দিয়ে রক্ত বের হলে চিকিৎসক বা নার্সের খোঁজ করেও তাদের পাওয়া যায়নি। রাত ১১টার দিকে মারা যায় ফুলবাবু।
ফুলবাবু দাস (১৮) উলিপুর উপজেলার ধামশ্রেণী ইউনিয়নের পূর্ব নাওড়া গ্রামের সুখচরণ দাসের ছেলে। তাঁকে হাসপাতালে এনেছিলেন পল্লিচিকিৎসক বাদল সরকার। তিনি জানান, ফুলবাবুর কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ছিল। শ্বাসকষ্টও ছিল তীব্র। এক ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও চিকিৎসক বা নার্স তাঁকে দেখতে আসেননি। বার বার অক্সিজেনের জন্য ডেকেও তাদের সাড়া মেলেনি।
হাসপাতালে অন্য এক রোগীর সঙ্গে আসা সবুজ কুমার বলেন, ‘ফুলবাবুর নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। আমি তাঁকে বিছানায় শুইয়ে দিই। তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। অক্সিজেনের জন্য বার বার নার্সদের ডাকা হয়। আধাঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কেউ আসেননি। ততক্ষণে ফুলবাবু মারা গেছেন। এরপর একজন এসে ইসিজি করতে বলে স্যালাইন পুশ করেন। এতে আমি হতভম্ব হয়ে যাই।’
ডিউটিতে থাকা সিনিয়র স্টাফ নার্স কোহিনুর খাতুন বলেন, ‘হাসপাতালে লোকবল সংকট। আমরা এক মুহূর্তও বসে থাকি না। সেদিন একশরও বেশি রোগী ছিল। তাদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তাই প্রেসক্রিপশনে কোন চিকিৎসকের স্বাক্ষর ছিল দেখিনি।’
ওই রাতে হাসপাতালের একটি কক্ষে শুয়ে ছিলেন দায়িত্বরত চিকিৎসক আব্দুল হান্নান। তাঁর সঙ্গে কথা হলে বলেন, ‘আমি রাত সাড়ে ৯টায় এসেছি। আগে যিনি ডিউটিতে ছিলেন তিনি বলতে পারবেন।’ রোগী রাত সাড়ে ১০টায় মারা গেছেন আর আপনি জানেন না! এর উত্তরে বলেন, ‘আমাকে কেউ না জানালে কীভাবে জানব?’
এ সময় আবাসিক মেডিকেল অফিসারের (আরএমও) সঙ্গে কথা বলতে তাঁর কক্ষে যান এ প্রতিবেদক। আরএমওর নাম ফলকে ডা. কামাল আহমেদের নাম থাকলেও দায়িত্ব পালন করছেন ডা. নাজমুল ইসলাম–এমনই জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী। কথা হলে নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘তিন-চার দিন হলো দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। এর বেশি কিছু জানতে হলে তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা বলুন।’
গত জুলাই মাসে এক সপ্তাহের ব্যবধানে জরুরি বিভাগে চিকিৎসায় অবহেলায় ফুলবাবুসহ দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। সেবা না পেয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। গত ২৪ জুলাই রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালনের কথা ছিল চিকিৎসক কালিপদ প্রসাদ সরকারের। ছুটি না নিয়ে তিনি জেলার বাইরে ছিলেন। ডিএমএফ (ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি) শিক্ষার্থী মো. রুবেল তাঁর হয়ে সেবা দেন।
ওই রাতে সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের মিলপাড়া এলাকার মো. জামাল বাদশাহ (৫৫) নামে শ্বাসকষ্টের রোগী মারা যান। এরপর সেই ডিএমএফ শিক্ষার্থীকে খোঁজা হলে ভয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলায় চিকিৎসক কালিপদ প্রসাদ সরকারকে বরিশালে বদলি করা হয়। সর্বশেষ তথ্যমতে তিনি এখনও সেখানে যোগদান করেননি। ঢাকায় ব্যস্ত আছেন।
২৭ জুলাই রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক আব্দুল হান্নানকে পাওয়া যায়নি। মো. সিয়াম নামের একজন ডিএমএফ শিক্ষার্থী ৫০০ টাকার বিনিময়ে সেদিন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেন। এ সময় কথা হয় চিকিৎসা নিতে আসা জুয়েল রানার সঙ্গে। আক্ষেপ করে বলেন, ‘রাত সাড়ে ১০টার দিকে পায়ের সমস্যা নিয়ে এসেছি। ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও চিকিৎসকের দেখা পাইনি। ডিএমএফের এক শিক্ষার্থী ওষুধ লিখে দিয়েছেন। তিনি রোগ সম্পর্কে কিছুই জানতে চাইলেন না।’
৩০ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে জরুরি বিভাগে কোনো চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। ওই রাতে অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে এসেছিলেন মামুন রশিদ। চিকিৎসা দেন ডিএমএফ শিক্ষার্থী। মামুন জানান, ডিএমএফ শিক্ষার্থী বাচ্চার মাকে দায়সারা কিছু প্রশ্ন করে বিদায় দিয়েছেন। ভালো করে বাচ্চাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি।’
জুলাই মাসের দুই মৃত্যুর রেশ না কাটতেই গত ৮ আগস্ট রাতে কমিরন নেসা নামে এক শ্বাসকষ্টের রোগী মারা যান। স্বজন রুবেল মিয়া বলেন, ‘সাড়ে ৮টার দিকে নানিকে হাসপাতালে আনি। কোনো এমবিবিএস চিকিৎসক ছিলেন না। নানির শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তাঁকে অক্সিজেন না দিয়ে একজন ডিএমএফ ছাত্র ইসিজি করে ভর্তি করিয়ে নেন। কেবিনে নিয়ে যেতে লিফটে ওঠানোর পর নানি মারা যান।’
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগী ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা হয় ঘুমান না হয় জেলার বাইরে থাকেন। রাতে ৫০০ টাকার বিনিময়ে ডিএমএফের শিক্ষার্থীরা সেবা দেন। এমবিবিএস চিকিৎসক না থাকায় রাতে জরুরি বিভাগে সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না রোগী।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১১ জুলাইয়ের পর কোন চিকিৎসক কখন কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেই রোস্টারও করে দেয়নি। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসারের (আরএমও) দায়িত্ব দুই দিন পর পর পরিবর্তন করা হচ্ছে। রোস্টার হালনাগাদ না করায় চিকিৎসকরা নিজেদের মতো করে রাতে দায়িত্ব পালন করছেন।
১০ আগস্টও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, আরএমও কক্ষে ডা. কামাল আহমেদের নাম ফলক থাকলেও দায়িত্ব পালন করছেন ডা. নাজমুল ইসলাম নামের আরেকজন। সেদিন বিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি হার্টের রোগী। গতকাল থেকে তিন বার টিকিট করেছি। এমবিবিএস ডাক্তার দেখাতে পারিনি। সব ডিএমএফের ছাত্ররা চিকিৎসা দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে বাইরে বেশি টাকা দিয়ে চিকিৎসক দেখাতে হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক ইচ্ছেমতো হাসপাতাল চালাচ্ছেন। তিনি হাসপাতালে সময় না দিয়ে বেশির ভাগ সময় ব্যক্তিগত খামারে থাকেন। আমরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে সুবিধাজনক সময়ে ডিউটি করছি। আরএমও এক-দু’দিন পর পর পরিবর্তন করা হয়।’
এ বিষয়ে বর্তমানে হাসপাতালটির আরএমও ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘রোগীর মৃত্যুর বিষয়ে আমরা কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে। প্রতিবেদনে দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাকি বিষয়গুলো নিয়ে তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে তত্ত্বাবধায়ক ডা. শহিদুল্লাহ লিংকনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কয়েক দিন হাসপাতালে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মোবাইল ফোনে একাধিক কল দিলেও রিসিভ করেননি। খুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।