পড়াশুনা নিয়ে এখন খুব ব্যস্ত সময় কাটছে ওয়ারিশা আক্তার রিফাতের। তবে সে বলছে, এই ব্যস্ততা তাকে ক্লান্তির বদলে আনন্দ স্বস্থি দেয়। সে পড়াশুনার পাশাপাশি ঢাকায় একটি কোম্পানিতে চাকরিও করছে। রিফাত বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পেশায় পড়াশুনারত বলে গত ২০ ডিসেম্বর মানবাধিকার খবরকে জানান।
আমাদের সমাজে চলমান নানা ব্যাধির মধ্যে বাল্য বিবাহ অন্যতম একটি সামাজিক ব্যাধি। বাল্য বিবাহের কুফল সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্দ্রে রন্দ্রে আমরা ভোগ করছি। যার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা দিচ্ছে নানান ধরনের অসামাজিক, মানসিক, শারিরীক সমস্যা। সচেতনতার অভাবে ছেলে মেয়ে উভয় পক্ষের অভিভাবক মহল ও সমাজপতি দের ভুল সিদ্ধান্তে অপরিনত বয়সে অহরহ ঘটছে বাল্য বিবাহ নামক এ দুর্ঘটনা। বাল্য বিবাহের পর পরিনিত বয়সে ছেলে-মেয়েরা যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে, তখন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় বিচ্ছেদের। এ বিচ্ছেদে হয়তো উভয়ের জীবনকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারিরীক, মানসিক ভাবে উন্নতি করতে সাহায্য করে। সমাজে আমরা এ ধরনের ঘটনা অহরহ দেখে আসছি। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে বাল্য বিবাহ থেকে মুক্ত হয়ে কঠিন সংগ্রাম ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। এ ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সমাজ পরিবর্তনের মননশীল চ্যালেঞ্জিং ছেলে মেয়েরা। বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়ার মাধ্যমে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে বাংলাদেশের একদল কিশোরী তারা ছুটে যাচ্ছে দেশের নানান প্রান্তে।
যা ঘটেছিলো সেদিন
পঞ্চগড় জেলার ওয়ারিশা আক্তার রিফাত ( ১৬ ) বাল্য বিবাহের শিকরের একজন। গত ২১-শে এপ্রিল মানবাধিকার খবরের সহযোগিতায় উভয় পক্ষের সম্মতিতে ওয়ারিশা আক্তার রিফাত নিজের সাহসীকতায় বাল্যবিবাহ থেকে মুক্ত হলেন। এ সময় উভয় পক্ষের অবিভাবক মহলের সাথে রিফাতের বর্তমান স্বামী সোহাগ ( ২৫ ) উপস্থিত ছিলেন। পঞ্চগড়ের পানিহারা গ্রামের মেয়ে রিফাত এস এস সি পাশ ও মেধাবী ছাত্রী। ২০১৫ সালে তার বাবা ওয়াহেদুল ইসলাম মারা যান। তারপর থেকে মা নাজমুন নাহার শামিমা সংসারের হাল ধরেন। অভাবের মধ্য দিয়ে তাদের সংসার চলতে থাকে। রিফাতরা এক ভাই দুই বোন। ২০১৬ সালের ১০ ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় পরিবারের পছন্দের বিয়েতে রাজি না হওয়া সত্বেও তাকে তার পরিবার জোর পূর্বক বিবাহ করিয়ে দেয়, একই জেলার বোদা থানার শাহাজাহান আলীর ছেলে সোহাগ আব্দুল্লাহ এর সাথে। যা ছিল সম্পূর্ণ অন্যায়, অমানবিক। কিন্তু উভয় পক্ষের অভিভাবকের কথা ছিল ভিন্ন তারা বলেছেন রিফাতের অনুমতিক্রমেই এই বিবাহ হয়। যার অসংখ্য প্রমান রয়েছে। স্বামীর বিরুদ্ধে রিফাতের অভিযোগ গুলির মধ্য রয়েছে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সবকিছু চাপিয়ে দেয়া, এখনই সন্তান ধারন ও পড়াশোনা করতে না দেয়া। মেয়েটি বিয়ের ২/৩ মাস পর এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে উত্তীর্ণ হয়। রিফাতের ভাষ্য মতে বিবাহের পর তাকে যৌতুকের দাবিতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছিল। জোর পূর্বকভাবে তার অনিচ্ছা থাকা সত্বেও শারীরিক মেলামেশা করত। যা সম্পূর্ণ অন্যায় ও বাল্য বিবাহ আইনের পরিপন্থি। বিষয়টি মানবোধিকার খবরের কাছে অভিযোগ আকারে এলে তদন্ত সাপেক্ষে গুরুত্বের সাথে আমলে নেয় মানবাধিকার খবর। এই অনুসন্ধানের ভিত্তিতেই দু-পক্ষই যোগাযোগ করে মানবাধিকার খবরের মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়ে। গত ২৪-ই এপ্রিল বিকালে উভয় পক্ষের অভিভাবক মহলের উপস্থিতিতে এক সালিশ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সালিশিতে মানবাধিকার খবরে সম্পাদক, প্রকাশক ও রোটারিয়ান মোঃ রিয়াজ উদ্দিন, উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য রাহেলা রহমান, আবু বকর সিদ্দিক সহ মানবাধিকার খবরের কর্মকর্তা, সিনিয়র সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন। নিজের বাল্য বিবাহ রুখে ওয়ারিসা আক্তার রিফাত লেখাপড়া চালিয়ে জীবনকে আরও উন্নত ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। রিফাতের এই ভূমিকা সালিশিতে উপস্থিত সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বাস্তবায়নে বিতর্ক, পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ বিয়ের বয়স কমানোর আইনের বিতর্ক যখন তুঙ্গে উঠে, তখন বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন সংসদে পাশ হয়। এই আইন ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে বাল্যবিবাহমুক্ত করবে বিশেষজ্ঞরা এই মনে করেন। নতুন আইন পাশের পরপরই আইনটির ধারা ১৯ নিয়ে নানান বিতর্ক উঠে আসে। ম্যারেজ রেমট্রেইট এ বলা হয়েছিল কোন নারী ১৮ বছরের আগে এবং কোন পুরুষ ২১ বছরের আগে যদি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে তা শাস্তির যোগ্য অপরাধ। যার পরিপ্রেক্ষিতে উভয় পক্ষের বক্তব্য ও কাগজপত্র পর্যালোচনার ভিত্তিতে রিফাতকে নাবালিকা দেখিয়ে বাল্যবিবাহ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য স্বামীকে অনুরোধ জানানো হয়। বর্তমান স্বামী মোঃ সোহাগ তার স্ত্রী রিফাত এর সাথে বিচ্ছেদে রাজি হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রিফাত অতি সত্ত¡র তার স্বামীকে মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তালাক প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। পাশাপাশি কোন পক্ষই রিফাতকে শারীরিক, মানসিক সহ কোন প্রকার অত্যাচার করতে পারবে না। রিফাতের ইচ্ছা অনুযায়ী পড়ালেখা চালিয়ে যাবে তার পাশে থেকে সার্বিক সহযে গীতা করবে মানবাধিকার খবর পরিবার। উভয় পক্ষের মধ্যে জটিলতার অবসান ঘটিয়ে রিফাতকে তার চাচা মোঃ হাবিবুল্লাহ সরদারের কাছে তুলে দেন “ মানবাধিকার খবর ” কর্তৃপক্ষ। তিনি সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে রিফাতকে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ে তার মায়ের কাছে পৌছিয়ে দেন। রিফাত বর্তমানে তার মায়ের কাছে নিরাপদে ভালোই আছেন বলে গত ৯-ই মে সকালে সম্পাদকের সাথে ফোনে কথা বলে নিশ্চিত করেন। রিফাত মায়ের কাছে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাবেন বলে জানান। রিফাত এর আগে মানবাধিকার খবরের ফেব্রুয়ারী ২০১৮ সংখ্যায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের কপি ও ফেসবুকে দেখতে পেয়ে তার ফেসবুক বন্ধু ও মানবাধিকার কর্মী তানিয়া আক্তারের সাথে যোগাযোগ করে তার ঢাকার বাসায় আশ্রয় নেয়। তানিয়ার সহযোগিতায় রিফাত মানবা ধিকার খবর অফিসে আসেন। এই সময়ের মধ্য রিফাতের বাড়ি ও শশুর বাড়ির লোকজন থানায় জিটি করা সহ র্যাব পুলিশকে অবহিত করে। র্যাব, পুলিশ সন্দেহজনক ভাবে অনেককে আটক করে অমানবিক নির্যাতন করে বলে জানা যায়। এতে এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই জটিল পরিস্থিতি থেকে ও রিফাতকে বাল্যবিবাহ থেকে মুক্ত করে নতুন জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মানবাধিকার খবরের কাছে পত্রিকা সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। পাশাপাশি তার মা, র্যাব, পুলিশ, স্থানীয় সংসদ সদস্য, ও জনপ্রতিনিধিগণ সৃষ্ট সমস্যার সুষ্ঠ সমাধানের জন্য মানবাধিকার খবরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, গত ২১-শে এপ্রিল ২০১৮ ইং বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পঞ্চগঙ থেকে স্বামী সোহাগের কাছ থেকে পালিয়ে এসে “ মানবাধিকার খবর ” পত্রিকার সম্পাদক বরাবর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে রিফাত একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন আমি নিজ পায়ে দাড়াতে চাই। জোর পূর্বক ভাবে আমাকে বাল্যবিবাহ দেয়া হয়েছে তা থেকে আমি মুক্তি চাই। ওয়ারিসা আক্তার রিফাতের অভিযোগের ভিত্তিতে “ মানবাধিকার খবর ” পত্রিকার মাঠ পর্যায়ের প্রতিনিধিগণ সত্যতা যাচাই ও আবেদনের উল্লেখ্য বিষয় গুলো নিশ্চিত হওয়ার পর উভয় পক্ষকে সালিশের মাধ্যমে সমাধানে আসতে বলা হয়। “ মানবাধিকার খবর ” মানবাধিকার বিষয়ক সংবাদ প্রকাশনার পাশাপাশি দেশ-বিদেশ থেকে নারী ও শিশু উদ্ধার, আইনি সহায়তা, চিকিৎসক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণ ও দারিদ্রের সহায়তা পর্যাটন শিল্পসহ নানাবিধ সামাজিক কাজ করে যাচ্ছে।