বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
শিরোনাম : * ভারতের জলসীমায় ধৃত পাকিস্তানের নুসরাত জাহাজ, উদ্ধার সাত মৎস্যজীবীকে   * কচুয়ায় কৃষক দলের আয়োজনে বৃক্ষরোপণ ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত   * সাড়ে ৩ ঘণ্টা ধরে সড়ক অবরোধ, কক্সবাজার শহর অচল   * সেনাবাহিনী প্রধানের কক্সবাজার এরিয়া পরিদর্শন   * বঙ্গোপসাগর কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত যুক্তরাষ্ট্র চীনের আলাদা আলাদা স্বার্থ রয়েছে:পররাষ্ট্র উপদেষ্টা   * কক্সবাজার জেলা জামায়াতের নতুন মজলিসে শুরা ও কর্মপরিষদ ঘোষণা   * চট্টগ্রামে পাকিস্তানি জাহাজ, উদ্বিগ্ন ভারত   * সেন্ট মার্টিনে কেউ সামরিক ঘাঁটি করতে পারবে না: রিজওয়ানা হাসান   * বিধি নিষেধ তুলে নেওয়ার পর বান্দরবান জেলার পর্যটন শিল্পের প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে;   * জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নকল নবীশদের অবস্থান ধর্মঘট: চাকরি জাতীয়করণের দাবি  

   অধিকারের প্রতিবেদন
অধিকারের প্রতিবেদনে তথ্য গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ধর্ষণসহ ৩ মাসে মানবাধিকার লঙ্গনের ঘটনা সহস্রাধিক
  Date : 27-05-2019

 

 

মানবাধিকার খবর প্রতিবেদন :
গত তিন মাসে সারাদেশে ৮৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, ১২ গুম ১৭৪ ধর্ষনের শিকারসহ সহ¯্রাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, ধর্ষণ, এসিড সহিংস, যৌন হয়রানি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর মর্যাদাহানিকর আচরণ, গণপিটুনীতে মানুষ হত্যা, মানবাধিকার কর্মকা-ে বাধাসহ প্রভৃতি ঘটনা রয়েছে। অধিকার নামের গণভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যানে এইসব তথ্য উঠে এসেছে। অতি সম্প্রতি অধিকারের ওয়েব সাইটে জানুয়ারি-মার্চ ২০১৯ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অধিকার নামের গণভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনটি ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে জনগণের নাগরিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় নিরলসভাবে সংগ্রাম করে চলেছে। অধিকার বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনকে নিছকই রাষ্ট্রের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ‘ব্যক্তি’কে রক্ষার ব্যাপার মাত্র বলে মনে করে না, বরং ব্যক্তির নাগরিক ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন ও সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বলে মনে করে। একটি মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে অধিকার রাষ্ট্রের হাতে সংঘটিত সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এর বিষয়ে প্রচারাভিযান চালানো, প্রতিবাদ জানানো এবং রাষ্ট্রকে মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে বিরত রাখার জন্য সব সময়ই সচেষ্ট থেকেছে। অধিকার দলমত নির্বিশেষে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ভিকটিমদের পাশে দাঁড়ায় এবং ভিকটিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অধিকার এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার কর্মীদের পাঠানো প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে অধিকার ২০১৯ সালের প্রথম তিন মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
১. এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে ২০১৯ সালের প্রথম তিন মাসের (জানুয়ারি-মার্চ) মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা হরণ এবং জীবনের অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করার মত বিষয়গুলো।
২. আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে, তাই ২০১৯ সালের মানবাধিকার লঙ্ঘন গত দশ বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি ধারাবাহিক রূপ। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্তা¡বধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতায় আসে। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান বিরোধীদল বিএনপি, নাগরিক সমাজ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আপত্তি উপেক্ষা করে এবং গণভোট ছাড়াই একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সর্বসম্মত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের প্রতিবাদে বিএনপিসহ প্রায় সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দল ব্যতীত) ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি’র দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করলে ভোটারবিহীন ও প্রহসনমূলকনির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে। গত ১০ বছরে সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের মাধ্যমে তাদের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছে। ফলে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার তার রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যবহার করার সুযোগ পায়। এরমধ্যে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রহসনমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ভরে রাখা, জাল ভোট দেয়া, ভোটারদের প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীনদলের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করা, কেন্দ্র দখল ও বিরোধীদল মনোনীত প্রার্থীর এজেন্টদের আটক ও বের করে দেয়া এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ অন্যান্য অনিয়মের ঘটনা ঘটে যা ছিল নজিরবিহীন । এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে। একাদশতম জাতীয় নির্বাচনের পর ১০ মার্চ থেকে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে পাঁচ ধাপে উপজেলা নির্বাচন শুরু হয়। একাদশতম জাতীয় নির্বাচন প্রহসনমূলক হওয়ায় এবং এর কোন প্রতিকার না পাওয়ায় প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এবং বাম রাজনৈতিক দলগুলো উপজেলা নির্বাচন ২০১৯ বয়কট করে এবং ক্ষমতাসীনদল আওয়ামী লীগ ও তার শরীক রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী দিয়ে অংশ নেয়। অধিকাংশ উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বীতা না থাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই নির্বাচিত হন। ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির কারণে ভোট দিতে না পারায় ভোটাররা উপজেলা নির্বাচনে ভোট দিতে আর আগ্রহ দেখাননি। ফলে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রই দেখা গেছে ভোটার শূন্য। একই রকম পরিস্থিতি দেখা যায় ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও।
৩. জনগণের ভোট ছাড়া ক্ষমতায় আসার কারণে সরকারের দায়মুক্তির সংস্কৃতি আরও প্রবল হয়েছে। গত তিনমাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। এই সময়ে নাগরিকরা গুম, বিচারবহিভর্ুূত হত্যাকা- এবং নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছেন।
৪. বাংলাদেশে মৃত্যুদ-ের বিধান বিদ্যমান রাখা ছাড়াও বিতর্কিত এবং নিপীড়ণমূলক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। ক্ষমতাসীনদলের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন সভায় মন্তব্য করা, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখা বা কোন পোস্টে ‘লাইক-শেয়ার’ দেয়ার কারণে ভিন্নমতের অনুসারী, বিরোধীদলের নেতাকর্মী ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ ও মানহানির মামলা দিয়ে তাঁদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হয়েছে। সরকার বিভিন্নভাবে সংবাদ মাধ্যমের ওপর চাপ সৃষ্টি করায় বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার ব্যাহত হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাংবাদিকদের সেল্ফ সেন্সরশিপ প্রয়োগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। বিরোধীদলপন্থী ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া- চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি এবং আমার দেশ পত্রিকা ২০১৩ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত বন্ধ করে রাখা হয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে সাংবাদিকরা এই সময়ে সরকারিদলের সমর্থক দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছেন এবং সরকারি উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
৫. সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের পাশাপশি সভা-সমাবেশের অধিকারও হরন করেছে। ২০১৯ সালের শুরু থেকেই বিরোধীদল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের সভা-সমাবেশ করার অধিকারকে সংকুচিত করা অব্যাহত থাকে। বিএনপি ছাড়াও অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিকদল ও সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনের মিছিল সমাবেশে বাধা ও হামলা করা হয়েছে।
৬. ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সারাদেশে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনের সময়ে দায়ের করা গায়েবী মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় কারাগারে পাঠানো অব্যাহত থাকে। ফলে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দি থাকার কারণে কারাগারগুলোতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয় এবং অনেক বন্দি কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এছাড়া চিকিৎসার অপ্রতুলতা থাকায় এবং কারাকর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে আটক বন্দিদের মধ্যে কারো কারো মৃত্যু ঘটছে বলে অভিযোগ আছে।
৭. ক্ষমতাসীনদলের নেতাকর্মীদের দলীয় অন্তর্কলহ ও দুর্বৃত্তায়ন গত তিন মাসে বরাবরের মতোই ছিল দৃশ্যমান। গত ১০ বছরে সারাদেশে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকা- সীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং তারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দায়মুক্তি ভোগ করছে। তারা প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র এবং অন্যান্য মারণাস্ত্র ব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলেও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তাদের বিরুদ্ধে সচরাচর কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে (ডাকসু) আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সহায়তায় ব্যাপক অনিয়ম ও প্রহসনের মধ্যে দিয়ে ৩০ ডিসেম্বর একাদশতম জাতীয় নির্বাচনের মতই অধিকাংশ আসন তাদের দখলে নেয়।
৮. ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়মুক্তি এবং দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে এবং গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনাগুলোও ঘটেছে।
৯. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা অব্যাহত থেকেছে এই তিন মাসে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ও সংখ্যালঘু আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে ও দোকানপাটে হামলা চালায় দুবৃর্ত্তরা। এক পর্যায়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয় প্রশাসন।
১০. গত তিনমাসে নারীর ওপর সহিংসতা অব্যাহত ছিল। অনেক নারী ও মেয়ে শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হন। এই সময়ে ধর্ষণ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই সময়ে সরকারি দলের নেতাকর্মী কর্তৃক রাজনৈতিক কারণে বিরোধীদলের কর্মীর স্ত্রীর গণধর্ষণের শিকার হওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
১১. এই তিন মাসে শ্রমিকদের অধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে এবং পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তাঁদের ওপর আক্রমণ করে এবং পুলিশের গুলিতে ১ জন শ্রমিক নিহত হন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী নারী শ্রমিকদের ওপর যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে এবং এইক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতার বিষয়ে অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
১২. বাংলাদেশের ওপর ভারতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বরাবরের মতোই অব্যাহত ছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যা-নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে এই সময়ে। বিএসএফের সদস্যরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হামলা চালানোর মতো ঘটনাও ঘটায়।
১৩. মিয়ানমারের বুথিডংয়ে চারটি সীমান্ত চৌকিতে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির হামলার জেরে রাখাইনে অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা পুনরায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আক্রমণের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন।
১৪. ২০১৩ সালে অধিকার এর ওপর যে সরকারি নিপীড়ন শুরু হয় তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অধিকার এর ওপর নানা ধরনের হয়রানির ঘটনা ঘটে। ২০১৪ সালে অধিকার তার নিবন্ধন নবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ এনজিও বিষয়ক ব্যুরোতে আবেদন করলেও এই রির্পোট প্রকাশের সময়কাল পর্যন্ত নিবন্ধন নবায়ন করা হয়নি।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড গুম:
১. দুর্বল ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সুযোগে রাষ্ট্র কর্তৃক হত্যাকারীদের দায়মুক্তির কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে। সরকার ২০১৮ সালের ১৫ মে থেকে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ব্যাপক রূপ নেয়; যা এখনও চলমান রয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার কোন কোন ব্যক্তির পরিবার অভিযোগ করেন যে, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাঁদের বিরোধী পক্ষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ব্যবহার করে হত্যা করেছে।
২. গত ৫ মার্চ ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার মোহাম্মদ সেলিম (৩৮) এর স্ত্রী নাসরিন বেগম অভিযোগ করেন যে, তাঁর স্বামীকে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জের বাসা থেকে কোন ওয়ারেন্ট ছাড়াই তুলে নিয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বে পুলিশ প্রথমে নির্যাতন করে এবং পরে গত ১ মার্চ ধলেশ্বরী নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে। সংবাদ সম্মেলনে নাসরিন বেগম আরো জানান, তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে সিরাজদিখান থানায় কোন মামলা বা জিডি নাই। তাঁর শ্বশুড় আনোয়ার হোসেনের হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পুলিশকে দিয়ে তাঁর স্বামীকে হত্যা করিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
৩. গত ১৩ মার্চ কক্সবাজার জেলার টেকনাফে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) দাবি করেছে নিহত ব্যক্তি একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী। কিন্তু নিহতের স্ত্রী পারভিন আক্তার জানান, তাঁর স্বামী ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। তিনি পেশায় একজন টমটম চালক। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাস জানান, নিহত নুরুল ইসলামের নামে থানায় কোন অভিযোগ বা মামলা নেই।

 

 

৪. জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত ৯১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে ৫২ জন পুলিশ, ১৯ জন র‌্যাব, ১১ জন বিজিবি, ৩ জন ডিবি পুলিশ, ৪ জন পুলিশ-বিজিবি, ১ জন কোস্টগার্ড ও ১ জন আর্মি প্যারাকমান্ডো’র হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার ৯১ জনের মধ্যে ৮৬ জন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। এই সময়ে ৪ জন ব্যক্তি গুলিতে নিহত হয়েছেন। এছাড়া ১ জনকে পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর মর্যাদাহানিকর আচরণ ও জবাবদিহিতার অভাব
৫. আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে নাগরিকদের গুলি করে হত্যা, তাঁদের ওপর নির্যাতন, নির্যাতন না করার জন্য ঘুষ আদায়, ধর্ষণ, হামলা, হয়রানি এবং চাঁদা আদায়ের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
৬. গত ৬ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলার রায়হান সরকার তাঁর বন্ধু লাবিব হোসেন, নওশাদ ইসলাম, তরিবুল্লাহ ও রাকিবুল ইসলামকে নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে ঢাকায় বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার সময় কালিয়াকৈর উপজেলার সুত্রাপুর এলাকায় গাড়িতে গ্যাস ভরার জন্য একটি ফিলিং স্টেশনে থামেন। এই সময় তরিবুল্লাহ ও রাকিবুল ইসলাম পাশের দোকানে চা পান করার জন্য যান। কিছুক্ষণ পর সেখানে পৃথক গাড়িতে হাজির হন কালিয়াকৈর থানার এএসআই আবদুল্লাহ আল মামুন এবং মির্জাপুর থানার এএসআই মুসরাফিকুর রহমান। তাঁরা সেখান থেকে রায়হান সরকার, লাবিব হোসেন ও নওশাদ ইসলামকে জোর করে ধরে মাইক্রেবাসে তুলে মির্জাপুরের দেওড়া এলাকায় নিয়ে গিয়ে ৩০ লক্ষ টাকা দাবি করেন; না হলে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করার হুমকি দেন। দেনদরবারের একপর্যায়ে ১০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে তাঁদের ছেড়ে দিতে রাজি হন দুই এএসআই। এদিকে তাঁদের দুই বন্ধু ঘটনাটি কালিয়াকৈর থানায় জানালে আটক তিনজনকে প্রথমে মির্জাপুর থানায় এবং পরে কালিয়াকৈর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনায় রায়হান সরকার কালিয়াকৈর থানায় মামলা দায়ের করলে পুলিশ গত ৮ ফেব্রুয়ারি দুই এএসআইকে গ্রেফতার করা হয়।


৭. গত ৬ ফেব্রুয়ারি এক তরুণী তাঁর পূর্ব পরিচিত এক নারীর সঙ্গে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানায় যান। ঐ নারী থানার এসআই সেকেন্দার হোসেনের কাছে তাঁর পাওনা টাকা চাইলে এসআই সেকেন্দার তাঁদেরকে থানার পাশে অবস্থিত জেলা পরিষদের ডাক বাংলোতে নিয়ে যান। পাওনা টাকা নিয়ে আলোচনা করার সময় একই থানার এএসআই মাজহারুল উপস্থিত হন। এরপর পাওনাদার নারীকে একটি কক্ষে আটকিয়ে রেখে দুই পুলিশ ঐ তরুণীকে জোরপূর্বক ইয়াবা সেবন করিয়ে ধর্ষণ করে। এই ব্যাপারে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ধর্ষণের শিকার এই তরুণী মামলা দায়ের করলে এসআই সেকেন্দার ও এএসআই মাজহারুলকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। এদিকে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিটের প্রেক্ষিতে ভিকটিমকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রুল জারি করেন।
৮. গত ১০ ফেব্রুয়ারি ভোর ৩ টায় ঢাকার শাহবাগে শিশু পার্কের সামনে মাসুদ নামে এক ব্যাক্তির বাম পায়ের হাঁটুতে গুলি করে গুরুতর আহত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে শাহবাগ থানার পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। আহত মাসুদকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে সে ছিনতাইকারী। তবে মাসুদ জানান, তিনি কেরানীগঞ্জে একটি বোরকা তৈরির কারখানায় কাজ করেন। গত ৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় তিনি বাংলা একাডেমির একুশে বই মেলায় আসার পরে পুলিশ তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পরে তাঁর বাম পায়ে গুলি করে।
৯. গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার রুহিয়া উত্তরপাড়া গ্রামে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা ভারতীয় গরু সন্দেহে স্থানীয়দের গরু জব্দ করলে গ্রামবাসীদের সঙ্গে বিজিবি সদস্যদের বাকবিত-া হয়। তখন বিজিবির সদস্যরা গ্রামবাসীদের ওপর গুলি বর্ষণ করলে সাদেক আলী (৪০), নবাব আলী (২৫) এবং জয়নুল (১২) নিহত হন এবং ১৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। উল্লেখ্য নিহত সাদেক আলী তাঁর মেয়ের বিয়ের খরচের জন্য তাঁর দুটি গরু বিক্রি করতে হাটে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁর গরুগুলোকে ভারতীয় গরু বলে জব্দ করে বিজিবি। অন্যদিকে বিজ্ঞানে ¯œাতক নিহত নবাব আলী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াতেন। শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু খাতাপত্র কিনতে তিনি সে সময় হাটে যাচ্ছিলেন। তিনিও বিজিবি’র ছোঁড়া গুলিতে নিহত হন। স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র জয়নুলও হাটে যাচ্ছিল। সেও বিজিবি’র গুলিতে নিহত হয়। এই ঘটনায় বিজিবি হরিপুর থানায় ২৭২ জনকে আসামী করে দুইটি মামলা দায়ের করে এবং বিজিবির গুলিতে নিহত মোহাম্মদ নবাব এবং ছাদেক আলীর নামও মামলায় আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
১০. ঝালকাঠিতে র‌্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন হোসেনের মায়ের দায়ের করা মামলায় ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা জজ এস কে এম তোফায়েল হাসান ২০১৮ এর ১ এপ্রিল লিমনের মামলার পুনরায় তদন্ত করার জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কে নির্দেশ দেন। কিন্তু পিবিআই এই প্রতিবেদন প্রকাশকালীন সময় পর্যন্ত তদন্ত সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্লেখ্য, লিমনের ওপর গুলির ঘটনায় তাঁর মা হেনোয়ারা বেগম রাজাপুর থানায় র‌্যাব অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে চাইলে প্রত্যাখ্যাত হন। পরবর্তীতে পুলিশ ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে মামলাটি রেকর্ড করে। গত ১৪ আগস্ট ২০১২ পুলিশ এই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় এবং দাবি করে যে, তদন্তে কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গত ৩০ আগস্ট ২০১২ হেনোয়ারা বেগম পুলিশ প্রতিবেদন চ্যালেঞ্জ করে একটি আবেদন দাখিল করেন, যা ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর তিনি ১৩ মার্চ ২০১৩ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের শরণাপন্ন হন। মার্চ ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রসিকিউশন শুনানির জন্য প্রায় ৪০টি তারিখ নির্ধারণ করে।

১১. ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশে গুমের অভিযোগগুলো নিয়মিতভাবে আসতে থাকে। গুমের ঘটনাগুলো বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের আগে ও পরে বিরোধীদলের অনেক নেতাকর্মী গুমের শিকার হন। গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গুমের ঘটনা ঘটে, যা এই তিন মাসেও অব্যাহত আছে। বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন থেকে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও সরকারের উচ্চমহল থেকে প্রতিনিয়ত গুমের বিষয়গুলো অস্বীকার করা হচ্ছে।
১২. কোন কোন ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন গুম করে রাখার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ছাড়া পাওয়া ব্যক্তি বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ভয়ে মুখ খুলেন না। উল্লেখ্য, গত ১৫ মার্চ দিবাগত রাত দেড়টায় ১৫ মাস গুম থাকার পর সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান বাসায় ফিরে আসেন। মারুফ জামানের মেয়ে সামিহা জামান জানান, কে বা কারা তাঁকে তাঁদের ধানমন্ডির বাসার নিচে নামিয়ে দিয়ে গেছেন সেটা তিনি জানেন না। তাঁর পরিবার এই ব্যাপারে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
১৩. গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক সাড়ে দশটায় ঢাকার কলাবাগান এলাকার বাসা থেকে সেনাবাহিনীর সাবেক কর্পোরাল মুকুল হোসেনকে গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয়ে ৮-১০ জন অস্ত্রধারী লোক আটক করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় বলে তাঁর স্ত্রী জিয়াসমিন আরা অভিযোগ করেন। মুকুল হোসেনকে তুলে নেয়ার পরদিন ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর বন্ধু আশিস জিয়াসমিন আরাকে ফোন করে জানান, ডিবি পুলিশ মুকুল হোসেনকে ধরে নিয়ে গেছে। এই ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি নিতে কলাবাগান থানা প্রথমে রাজি না হলেও পরে তা গ্রহণ করে।
১৪. অধিকার এর তথ্য মতে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ১২ জনকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তাঁদের গুম হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এঁদের মধ্যে ২ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ৫ জনকে গুম করার পর পরবর্তীতে তাঁদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে এবং ১ জনকে পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এখনও পর্যন্ত বাকি ৪ জনের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

 


কারাগারে মানবিক বিপর্যয় :
১৫. ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধীদলের নেতাকর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে গায়েবী মামলা দায়ের এবং বিভিন্ন অজুহাতে ঢালাওভাবে গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়। গণগ্রেফতারের ফলে এ সময় কারাগারের ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেকগুণ বেশি বন্দি ছিল বলে জানা গেছে। ডিসেম্বরে গ্রেফতার হলেও জামিন না হওয়ায় পরবর্তী বছর ২০১৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত তাঁদের অনেকে কারাগারে আটক ছিলেন। অতিরিক্ত বন্দি থাকার কারণে কারাগারগুলোতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। ধারণক্ষমতার অনেক বেশী বন্দি থাকায় জানুয়ারি মাসে খুলনা জেলা কারাগারের পরিত্যক্ত গোডাউনে একশ বন্দির থাকার ব্যবস্থা করা হয়। মানবিক বিপর্যয়ের কারণে অনেক বন্দি কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারাগারে চিকিৎসার ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং কারাগার কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে আটক বন্দিদের মৃত্যু ঘটছে বলে অভিযোগ আছে। সারাদেশে কারাগারের মোট ধারণ ক্ষমতা ৩৬ হাজার ৬১৪ জন। কিন্তু ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্দি ছিল ৮৬,৫৫০ জন।
১৬. জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসে ১২ জন কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। এঁদের মধ্যে ১১ জন ‘অসুস্থতাজনিত’ কারণে এবং ১ জন আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।


রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সভা-সমাবেশে বাধা :
১৭. ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি প্রহসনমূলক ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট পুনরায় ক্ষমতা নেয়ার পর ২০১৯ সালের শুরু থেকেই বিরোধীদল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের সভা-সমাবেশ করার অধিকারকে সংকুচিত করা অব্যাহত থাকে। বিএনপি ছাড়াও অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিকদল ও সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর মিছিল সমাবেশেও সরকার বাধা দিয়েছে এবং হামলা করেছে। এই সময় নারী আন্দোলনকারীদের শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত হতে দেখা গেছে। এই ব্যাপারে নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলঃ
১৮. গত ১ জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচন প্রত্যাখান এবং অনতিবিলম্বে স্থায়ীভাবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে ভোটাধিকার ও সুশাসনে জাতীয় ঐক্য নামে একটি সংগঠন ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানবন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করলে পুলিশের হামলায় তা প- হয়ে যায়।
১৯. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রগুলো আবাসিক হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে করা এবং ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিতের দাবিতে গত ৪ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিতে গেলে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনের ওপর হামলা চালিয়ে তাঁকে আহত করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের সূর্যসেন হল শাখার সহ-সভাপতি রাইসুল ইসলামের নেতৃত্বে ৩০/৪০ জন নেতাকর্মী।
২০. গত ৯ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রেসক্লাব চত্বরে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মহানগর বিএনপি আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ পুলিশের বাধায় প- হয়ে যায়।

২১. বুকার পুরস্কার জয়ী ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ আলোকচিত্র উৎসব ‘ছবিমেলায়’ যোগ দেয়ার জন্য ঢাকায় আসেন। অনুষ্ঠান করার অনুমতি চেয়ে ছবিমেলার সমন্বয়ক গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ উপ-কমিশনারের কাছে চিঠি দিলে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশ শর্ত সাপেক্ষ অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেয়। গত ৫ মার্চ ‘আটমোস্ট এভরিথিং অরুন্ধতী রায় ইন কনভারসেশন উইথ শহিদুল আলম’ শিরোনামে অনুষ্ঠানটি ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৪ মার্চ রাত ১২টায় তেজগাঁও থানা পুলিশ আয়োজকদের জানান অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। তবে কি কারণে অনুষ্ঠান বাতিল করা হলো সে ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি পুলিশ। এরপর আয়োজকরা ঢাকার মাইডাস কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠান করার জন্য অনুমতি নেন। কিন্তু পুলিশী নিষেধাজ্ঞা আছে বলে সেখানেও অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে জনমতের চাপে সরকার অরুন্ধতী রায়ের অনুষ্ঠান বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়।
২২. ডাকসু’র পুর্ননির্বাচনের দাবিতে গত ১২ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্রজোট মিছিল বের করলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা মিছিলে দুই দফা হামলা চালালে মিছিলটি প- হয়ে যায়। এই ঘটনায় প্রগতিশীল ছাত্রজোটের চারজন কর্মী আহত হন। হামলার সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নারী কর্মীদের গালিগালাজ করে।
২৩. স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গত ২৬ মার্চ কুষ্টিয়া জেলা সদরের কালেক্টরেট চত্বরে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে বিএনপি নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করার পর জেলা বিএনপি’র সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১২ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৬ মার্চ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ফেরার সময় ফরিদপুরে বিএনপি’র অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবকদলের মিছিলের ওপর আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। একই সময়ে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাওয়ার সময় শহর বিএনপি ও জেলা যুবদলের আলাদা মিছিলেও হামলা চালানো হয়। দুর্বৃত্তদের হামলায় জেলা বিএনপি’র শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। আহতরা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও পুলিশ তাঁদের ওপর চড়াও হয়।


ক্ষমতাসীনদলের দাপট :
২৪. চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত ও ৫৫১ জন আহত হয়েছেন। এই তিন মাসে আওয়ামী লীগের ৫৭টি অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ১৩ জন নিহত ও ৫০৫ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
২৫. বাংলাদেশের রাজনীতিতে দাপট বা দুর্বৃত্তায়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে সব দল অংশ নিলেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সবন্দি করা, জাল ভোট দেয়া, প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীনদলের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করা, কেন্দ্র দখল ও বিরোধীদল মনোনীত প্রার্থীর এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, আটক করা এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে, যা ছিল নজিরবিহীন। এই ধরনের একটি অগ্রহণযোগ্য ও প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পর তারা বিরোধীদলের নেতাকর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। গত তিনমাসে সারাদেশে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকা- অব্যাহত ছিল। এছাড়া তারা বরাবরের মত নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্বের কারণেও সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে এবং তাদের আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিচারের সম্মুখিন করা হয়নি।
২৬. গত ২ জানুয়ারি রাত ১০টায় নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার হাসান ভুঁইয়ার হাট এলাকায় ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেয়ায় স্থানীয় যুবলীগ কর্মী মো. ফজলু ও মজনুর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি দল বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল কর্মীদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে। এই ঘটনায় ৩ জন বিএনপি নেতাকর্মী আহত হন। আহতদের নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
২৭. গত ২৪ জানুয়ারি রাতে নোয়াখালী সদর উপজেলার বক্তারপুর গ্রামে উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইলিয়াস আলীর বাড়িতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে। এই সময় তারা ইলিয়াস আলীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করে। এরপর যুবদল কর্মী শাহজাহানের বাড়িতে হামলা চালিয়ে শাহজাহানসহ বাড়ির লোকজনকে মারধর ও ঘরবাড়ী ভাংচুর করা হয়। হামলার সময় সুধারাম থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও পুলিশ তাতে সাড়া দেয়নি। ইলিয়াস আলী ও শাহজাহানকে গুরুতর আহত অবস্থায় নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
২৮. গত ২৪ জানুয়ারি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের যুগ্ম আহাবায়ক রাশেদ খান নেতৃত্বে অমর একুশে বই মেলার প্রস্তুতি দেখতে বাংলা একাডেমিতে গেলে সেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের ১০-১২ জন নেতাকর্মী তাঁদের ওপর হামলা চালায়। এরপর কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নুরুল হক, ইনজামুল হক, রাফি আবিয়ান ও মুনতাসীর মাহমুদ নামে চার শিক্ষার্থীকে অবরুদ্ধ করে রাখে। নুরুল হক জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনে (ডাকসু) অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করায় এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াতে তাঁদের ওপর এ হামলা চালানো হয়েছে।
২৯. গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্?

  
  সর্বশেষ
ভারতের জলসীমায় ধৃত পাকিস্তানের নুসরাত জাহাজ, উদ্ধার সাত মৎস্যজীবীকে
কচুয়ায় কৃষক দলের আয়োজনে বৃক্ষরোপণ ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত
সাড়ে ৩ ঘণ্টা ধরে সড়ক অবরোধ, কক্সবাজার শহর অচল
সেনাবাহিনী প্রধানের কক্সবাজার এরিয়া পরিদর্শন

Md Reaz Uddin Editor & Publisher
Editorial Office
Kabbokosh Bhabon, Level-5, Suite#18, Kawran Bazar, Dhaka-1215.
E-mail:manabadhikarkhabar11@gmail.com
Tel:+88-02-41010307
Mobile: +8801978882223 Fax: +88-02-41010308