মোঃ একরামুল হক মুন্সী, চিতলমারী (বাগরহাট) প্রতিনিধি: একমাত্র পুত্র হারাবার শোকে চোখেরপানি এখনও ঝরছে বৈষম্যবিরোধী অন্দোলনের বীর শহিদ সাব্বির মল্লিকের মা’ বাবার। শহিদ সাব্বির ছিলেন বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার হিজলা মাঠপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য শহিদুল মল্লিকের একমাত্র পুত্র সন্তান। তিনি চিতলমারী শেরেবাংলা ডিগ্রি কলেজের একাদশশ্রেণীর পরীক্ষার্থী ছিলেন। রাজনৈতিক ভাবে সাব্বির একই কলেজের ছাত্রদলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। প্রতিবাদী ছাত্রদলনেতা সাব্বিরের দলীয় অংশগ্রহন ও কার্যক্রম ছিলো যথারিতি। তিনি সংগঠনের উপজেলা, জেলা ও বিভাগিয় পর্যায় প্রতিটি মিছিল মিটিংএ অংশগ্রহন করে আসছিলেন।
শহিদ সাব্বির মল্লিকের বাবা মো: শহিদুল মল্লিক একজন অব: সেনা সদস্য। অশ্রুসজল চোখে তিনি “আমার দেশ” কে জানান, জুলাই- ২০২৪ এ শেখ হাসিনার পেটুয়া পুলিশ বাহিনীও তার দলবল বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার ওপর পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ওই সময় সাব্বিরের একাদশশ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা চলছিলো। ১৪ জুলাই বিকালে পরীক্ষা শেষে বাড়ীথেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানাদেয় সাব্বির। রাতে টঙ্গিতে বোন শারমিনের বাসায় ওঠে। পর দিন অন্দোলনে যোগ দিতে চেষ্টা করলে মেয়ে এবং জামাই তাকে ঘরথেকে বের না হতে চাপ দেয়। কিন্তু সব চাপ সামলিয়ে ১৯ জুলাই (শুক্রবার) সকাল ১০টায় ভাগ্নে-ভাগ্নিদের জন্য পাশের দোকান থেকে মোজো এবং চিপস কিনে আনবার কথা বলে সরাসরি উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে চলে যায়। ওখানে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাথে দিনভর বিক্ষোভে অংশ নেয়। বিক্ষোভ কালিন সময় সন্ধ্য ৬টা ৩০ মিনিটে পুলিশের ৫টি গুলিরমুখে সাব্বির, শাহাদাৎ বরণ করে। এ সময় তার গায়ে ছিলো লাল রংয়ের পাঞ্জাবী ও পরনে ছিলো সাদা রংয়ের পাজামা।এই বর্ননা দিতে হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলেন বাবা শহিদুল ।
শহিদ সাব্বির মোল্লার বড় বোন ফারহানা শারমীন জানান, ৪ ভাই বোনের মধ্যে ও ছিলো তাদের আদরের ছোট ভাই। ও ছিলো প্রতিবাদী। দলকে খুব ভালো বাসতো। দল করতে গিয়ে মামলা,হামলার শিকার হয়েছে। পুলিশ ওকে বাড়ী ঘুমাতে দিতনা। ওর মূল উদ্যেশ্য ছিলো আন্দোলনে অংশ গ্রহন করা। সে কারনে তার চোক ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। ভাইকে বারবার ফোন দিয়েছে, জবাবে বলে ছিলো আপা আসছি। অতিরিক্ত ফোন দিলে পরে ফোন বন্দ রাখে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আব্বুর কাছে একটা ফোন আসে সাব্বির গুলিতে মারা গেছে।খবর শুনে সেনা কল্যান সংস্থা থেকে আব্বু পাগলেরমত ছুটে আসেন, ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। শারমীনও প্রবল অন্দোলনের মুখে সেখানে যান। গিয়ে দেখেন গুলিতে ঝাঁজরা ভাইয়ের রক্তমাখা নিথর দেহ পড়ে আছে। চারপাশে গুলির শব্দ, এক বিভিশিখাময় অবস্থা। ডাক্তার বলে দেন আপনার ভাই মারা গেছে, দ্রুত লাশ নিয়ে যান। এই বর্ননা দিতেই শারমীন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।
শারমীন আরো জানান, তিনি- তার স্বামী, বাবা ও শিশুদের নিয়ে যখন গাড়ীতে লাশ তুলে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন তখন পথিমধ্যে ছাত্রলীগ- আওয়ামী লীগের গুন্ডাপান্ডা লাশবাহী গাড়ীতে হামলা ও ভাংচুর চালায়। তখন সাথে থাকা শিশুরা চিৎকার করে কাঁদে। কোন অনুরোধ ওরা সোনেনি । সে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে লাশ অন্য একটা গাড়ীতে উঠিয়ে রাত সাড়ে তিনটায় গ্রামের বাড়ীতে আসেন।
শহিদ সাব্বিরের মা’ কাকলী বেগম বিলাপ করে বলেন, যে মায়ের সন্তান হারায় নাই, সে বুঝবেনা সন্তান হারানোর ব্যাথা। আমি এখনও শুনতে পাই আমার সাব্বির আমাকে মা’মা’ বলে ডাকছে। ও আমার পাশে হাটছে চলছে। কিন্ত না আমার বাবাতো অনেক দুরে চলে গেছে। ওতো আর ফিরে আসবেনা। আমার বাবার লাশ আনার পর আমাদের পরিবারসহ উৎসুক গ্রামবাসীকেও এক নজর দেখার সুযোগ দিতে রাজী হয়নি শেখ হাসিনার পুলিশ ও আওয়ামী লীগের গুন্ডা বাহিনী। লাশ দাফনের জন্য মাত্র ৪০ মিনিট সময় বেঁধে দিয়ে ছিলো। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।
স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী অসিকুর রহমান জানান, সাব্বির মল্লিক তার গ্রামের ছেলে, তিনি বিএনপির ছাত্রদল করতো। ৫ আগষ্টের পর অন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটার (প্রশাসন) ও সরকারের উর্দ্ধোতন কর্র্তৃপক্ষ তার কবর জিয়ারত করেছেন। তাকে হত্যার ব্যপারে ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে। আমি তার আত্মর মাগফিরত কামনা করি।
উপজেলা বিএনপির আবায়ক মমিনুল হক টুলু বিশ্বাস জানান, সাব্বির মল্লিক আমার সংগঠনের ছেলে ও শহীদ হবার পর আমিও আমার সদস্য সচিব আহসান হাবীব ঠান্ডুসহ দলীয় লোকজন কবর জিয়ারত করতে ছুটে যাই। তার মা’বাবাকে শান্তনা দেই। আমি তার আত্মার মাগফিরত কামনা করি।