দিশা বিশ্বাস
আমাকে আমার সাংবাদিক দাদু অমর সাহা মাঝে মধ্যে বলতেন, এবার তুই ঢাকা গেলে তোকে রকেটে চড়াব। শুনে আমি থ খেয়ে যেতাম । সে আবার কী ? রকেট তো সাধারণ মানুষের চড়ার জন্য নয়। আমেরিকা, রাশিয়া,ভারত সহ পৃথিবীর নানা দেশ রকেট ছাড়ছে। চাঁদে যাচ্ছে। মহাশুন্যে ঘাঁটি করছে। তাই রকেটের কথা শুনে চমকে উঠি। এরপরেই দাদু বললেন, আরে সে রকেট নয়। এ রকেট জলে চলে। রহস্য আরও ঘনীভূত হল। বুঝে উঠতে পারছিলামনা এ বার কী ধরণের রকেট, যে রকেট জলে চলে। দাদু বুঝলেন, সত্যিই আমি রকেট নিয়ে ধোয়াশায় পড়ে গেছি।
শেষমেষ দাদু রহস্যের দরজা খুলে দিলেন। বললেন, স্টিমারের কথা শুনেছিস না? সেই দ্রতগামী স্টিমারকে বাংলাদেশে রকেট বলে। আবার জাহাজও বলে। তবে, বেশি পরিচিত রকেট স্টিমার হিসাবে। একেবারে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে খুলনায় যায়। সন্ধ্যায় এই রকেট ঢাকা থেকে ছাড়লে পরেরদিন দিনগত রাতে খুলনায় পৌঁছে। এই রকেট স্টিমার আবার দোতালা। রং গেরুয়া। দোতালায় রয়েছে প্রথম শ্রেণী আর দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা। রয়েছে সাধারণের জন্য ডেক। আর তিনতলার ওপরে রকেটের পাইলট বা সারেং’এর ঘর। তিনিই রকেট চালান। এই রকেটের মাঝ বরাবর দুদিকে অর্থ্যাৎ বাম ও ডানদিকে রয়েছে বৃহৎ আকারের দুটি চাকা। এই চাকা দুটিই জলকেটে টেনে নিয়ে যায় রকেটকে। লঞ্চে যেমন রয়েছে
পেছনে জলের তলে পাখা বা প্রপেলার। যে পাখায় চলে লঞ্চ। আমি শুনে বললাম, ঢাকা থেকে খুলনা যেতে বাসে ৮-৯ ঘন্টা লাগে। তবে কেন রকেটে ২৮ ঘন্টায় খুলনা যাব? দাদু বললেন, রকেটের যাত্রা আর বাসের যাত্রা এক নয়। রকেটের যাত্রা রোমাঞ্চকর। আলাদা অনুভূতির যাত্রা। দেখা যায় বাংলাদেশের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তোর ভাল লাগবে। এই বিশাল রকেট স্টিমার নদীর বুক চিরে চলে সেই বুড়িগঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা নদী পেরিয়ে বরিশালের কীর্তনখোলা , কচা, বলেশ্বর, পানগুছি, পশুর, রুপসার ভৈরব নদী হয়ে খুলনার পাড়ের খুলনা শহর পর্যন্ত। দাদুকে বললাম, একবার তুমি আমাকে এই রকেটে করে নিয়ে যাবে তোমার গ্রামের বাড়িতে ? তোমাদের আদি বাড়িতো বৃহত্তর বরিশাল জেলায়। এখন পিরোজপুর জেলা। তুমি একবার বলেছিলে এই জেলার হুলারহাট বন্দরে রকেট থামে। এবার না হয়, ঢাকা থেকে হুলারহাট যাব রকেটে করে। দাদুও রাজী হয়ে যান। আমিও ভাবলাম ট্রেন, বাস, লঞ্চ ও বিমানে চড়েছি। এবার না হয় রকেটে চড়ে নতুন এক অনুভূতিতে আনন্দ ভাগ করে নেব। দাদু রাজী হয়ে যান। বললেন, নিশ্চয়ই তোকে রকেট স্টিমারে করে পিরোজপুরের হুলারহাট বন্দরে নিয়ে যাব। তারপর সেখান থেকে দাদুর শহর পিরোজপুরে নিয়ে যাব রিক্সা বা ব্যাটারিচালিত ইজি-বাইক, কলকাতার কথায় টো-টো গাড়িতে করে। সেইভাবে আমি প্রস্তুতি নেই দাদুর সঙ্গে যাওয়ার। আমাদের আরও সঙ্গী হন দিদাও। আমরা তিনজনে মিলে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসি মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে করে।
ঢাকায় সপ্তাহখানেক বেড়ানোর পর পিরোজপুরে যাওয়ার উদ্যোগ নেই। আগেই কলকাতায় এসে আমাদের দাদুর দেশের এক মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সাংবাদিক কাজী সিরাজুল ইসলাম হিরণ দাদু আমাদের বাসায় বেড়াতে এসে বলেছিলেন, এবার তোমাদের আমি পিরোজপুরে নিয়ে যাব রকেট স্টিমারে। ভাল লাগবে। তিন দশক আগে তোমার দাদু চড়েছিলেন রকেটে। এবার সেই রকেটেই দাদুর সঙ্গে তোমাকেও চড়াব। হিরণ দাদু আমার দাদুকে রকেটে করে পিরোজপুর বেড়ানোর কথা বললে, আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আর ভাবছিলাম সত্যিই এবার রকেটে চড়ার সুযোগ পাব। কলেজের বন্ধুদেরতো রকেটে চড়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে করতে পারব। ঠিক হয় ১৭ জুলাই আমরা ঢাকা থেকে হুলারহাট হয়ে পিরোজপুর যাব রকেট স্টিমারে। সঙ্গী জুটে যায় । ঢাকার মানবাধিকার পত্রিকার সম্পাদক মো: রিয়াজ উদ্দিন আমাদের সঙ্গে যাবেন। আমি আবার মানবাধিকার খবর পত্রিকার কলকাতা প্রতিনিধি। রিয়াজ আংকেলের বাড়ি পিরোজুরের পাশে বাগেরহাট জেলার কচুয়ায়। বাংলাদেশের আভন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ রিয়াজ আংকেলের জন্য রকেটের প্রথম শ্রেণীর একটি রুমের ব্যবস্থা করে দেন। আমরাও ছিলাম প্রথম শ্রেণীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অন্য একটি কক্ষে। আমাদের পাশেই ছিল রিয়াজ আংকেল । আমার দাদু থাকেন অবশ্য আংকেলের কক্ষে। আর আমাদের কক্ষে থাকেন আমি এবং আমার দিদা। যথারীতি সন্ধ্যার একটু আগে রকেট স্টিামারটি ঢাকার সদরঘাট থেকে ছাড়ে। দাদু বললেন, আমাদের সৌভার্গ্য সেদিন আবার এই নৌপথে চলা রকেট স্টিমারের মধ্যে বড় রকেট স্টিমার বা জাহাজটি ছিল মাসুদ। পিএস মাসুদ। এটিই এখন বড় জাহাজ বা রকেট স্টিমার।
আগে এই পথে সবচেয়ে বেশি নাম ছিল গাজী রকেট স্টিমারের। এখন গাজী নেই। চলছে মাসুদ, লেপচা। ছিল টার্ন রকেটও। জানলাম পিএস মাসুদ পুরনো জাহাজ। তবে বরাবর বলা হয় একে রকেট স্টিমার। ১৯২৮ সালে এটি নির্মিত হয় কলকাতার গার্ডেনরিচ ওয়ার্কশপে। পরবর্তীতে আবার এটিকে নতুন করে রুপ দেওয়া হয় ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের নারায়নগঞ্জ ডক ইয়ার্ডে।
দাদু বললেন, আজ থেকে তিন দশক আগে এই মাসুদে চড়ে আমার দাদুর শ্যালিকা দীপ্তি দিদার বিয়ের বর এবং বরযাত্রী গিয়েছিল ঢাকা থেকে হুলারহাটের পর চড়খালি স্টেশন ছাড়িয়ে মোড়েলগঞ্জ স্টেশনে। ওখানেই বসেছিল বিয়ের আসর। ওখানেই ছিল আমার দাদুর শ্বশুর বাড়ি। দীপ্তি দিদার বিয়ের দিনটি ছিল ১৯৮৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি । আর আমরা রকেটে উঠেছিলম ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকার সদরঘাট থেকে। এই মাসুদ সেদিন মোড়েলগঞ্জ পৌঁছেছিল পরেরদিন অর্থ্যাৎ বিয়ের দিন সকাল সাড়ে ১১টায়। বলছিলেন দাদু।
আমার দাদুর শ্যালিকা দীপ্তি সাহার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল প্রকৌশলী শান্তিময় সাহার। শান্তিময় দাদুর বাড়ি ছিল ঢাকার পাশের নারায়নগঞ্জের পঞ্চবটিতে। পঞ্চবটি থেকে বরযাত্রীরা ঢাকার সদরঘাট স্টেশনে এসে উঠেছিলেন রকেটে। বিয়ের পরদিন অধিকাংশ বরযাত্রীরা আবার ফিরে এসেছিলেন এই
মাসুদ রকেটেই ঢাকাতে। ঢাকার সদরঘাট থেকে যথাসময় রকেট ছাড়ে। বুড়িগঙ্গ নদীর পথে। সেদিন বুড়িগঙ্গায় জমে থাকা প্রচুর কচুরিপনাকে রকেটের দুদিকের বিশাল চাকা ঝপঝপ করে ওই কচুরিপনা কেটে ছুটে ছুটে চলছিল হুলারহাটের পথে। প্রথমে দাড়াবে চাঁদপুর, তারপর বরিশাল, এরপর ঝালকাঠি। ঝালকাঠি ছাড়ার পর দাড়াবে কাউখালি তারপরেই হুলারহাট। ওইদিনই জানলাম এখন আর এই রকেট স্টিমার খুলনা পর্যন্ত যায়না। গন্তব্য বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ পর্যন্ত। তারপর সেখান থেকে আবার ফিরে আসে ঢাকায়।
রকেট চলছে, আমি দেখছি। কী আনন্দ যে ভাষায় ব্যক্ত করতে পারছিনা। সব কিছুই নতুন লাগছে। পদ্মা মেঘনা নদী। স্বপ্নের নদী। দুপাড়ে সৌন্দর্যের নানা হাতছানি। বুড়িগঙ্গা ছেড়ে আমরা মুন্সিগঞ্জ হয়ে চলেছি চাঁদপুরে দিকে মেঘনা হয়ে। তারপর আসবে পদ্মা। বিশাল নদী। জুলাই মাস। সামান্য হাওয়া ছিল। নদীতে সামান্য ঢেউ ছিল, তবুও এতটুকু আতংক হয়নি। দাদু বলেছিল, বর্ষাকালে মানুষ বেশি চলেন এই রকেট স্টিমারে। রকেট ডোবার কোনও ঘটনা শোনেনি দাদু। নদীর দুপাড়ে দুরদুরান্তে বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি মুগ্ধ করেছিল আমার মন। কী অপরুপ সৌন্দর্য! মনভোলানো । আমরা চলেছি রকেটে।
আমার প্রথম চলা এই রকেটে। তাই খুঁটিনাটি জেনে নিচ্ছিলাম দাদুর থেকেই। একসময় রকেটের পাইলটকে বলে আমরা উঠে যাই ব্রীজে। সেখানে চালক আর তাঁর সহকারিরা রকেট চালান। আমরা কলকাতা থেকে এসেছি শুনে ওনারা আমাদের কাছে নিলেন। বললেন রকেট চালনার কথা । এমনকি আমাদের ছবি তুলতেও দিলেন। রকেটের ছাদে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নতুন মাত্রা যোগ করে। আমিতো দারুণ মুগ্ধ। দাদুকে বললাম এবার সত্যিই আমার বাংলাদেশ সফর সার্থক হল। রকেটে যে এত আনন্দ, এত সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় তা আমার ভাবনায় ছিলনা। সব দেখে অমি খুবই মুগ্ধ। সেদিন রাতে আমরা আহার সেরেছিরাম এই রকেটে। দাদু আগেই বলেছিলেন, রকেটের রান্নার একটা আলাদা মাত্রা ছিল। সেই রান্নার অপরূপ গন্ধ নাকি ছড়িয়ে থাকতো রকেট জুড়ে। তাইতো দাদু যখন ডেকের যাত্রী থাকতেন তখনও তিনি এই রকেটে খাবার খেতেন সেই দ্বিতীয় শ্রেণীর ডাইনিং কক্ষে এসে। প্রথম শ্রেণীর ডাইনিং কক্ষে যেতে দিতেননা ডেকের যাত্রীদের। দাদু একথাও বলেছেন, সেদিনের খাবারের সেই স্বাদ আর এখন পাওয়া যায়না। তবে রকেটের কর্মীদের আতিথিয়তায় এতটুকু ঘাটতি ছিলনা। সকালে উঠে দাদু ডেকে গিয়ে রকেটের চায়ের দোকান থেকে চা বিস্কুট খেয়ে নিয়েছিলেন।
একটু পিছিয়ে যাই। রাত ১১টায় রকেট পৌঁছে চাঁদপুর বন্দরে। ভোর ৪ টায় বরিশাল বন্দরে বা শহরে। সকাল পৌণে ৮টায় ঝালকাঠি। সকাল সোয়া ৯টায় কাউখালি আর সকাল পৌনে ১০টায় পৌছি হুলারহাট বন্দরে। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর রকেটের সামনে গিয়ে মনভরে উপভোগ করেছি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দেখেছি গ্রামগাঁয়ের নানা ছবি। সকাল বেলা এক পশলা বৃস্টিও হয়েছে ঝালকাঠি বন্দর ছাড়ার পর। সেই বৃস্টিও রকেটে বসে মনভরে উপভোগ করেছি। রকেটের একেবারে সামনের চেয়ারে বসে।
তবে একটি আফসোস থেকে গেছে। দাদু বললেন, কাউখালির শীতল পাটি এই অঞ্চলে দারুণ প্রসিদ্ধ। রকেট স্টিমার কাউখালি বন্দরে ভিড়লে শীতল পাটি নিয়ে উঠে পড়েন পাটি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সেদিন আর চোখে পড়েনি শীতল পাটি নিয়ে রকেটে ওঠা পাটি ব্যবসায়ীদের। আর একটি আফসোসের কথা বললেন দাদু। কাউখালির চিড়ের মোয়া আর নারকেল কোড়া দারুণ ভাল। আমার দাদু এই চিড়ের মোয়া কোড়ানো নারকেল দিয়ে খেতে দারুণ ভালবাসেন । রকেটে উঠলেই খেতেন। কিন্তু ওইদিন রকেটে আর খোঁজ মেলেনি চিড়ের মোয়া আর নারকেল কোড়া নিয়ে ওঠা গ্রামের মোয়া বিক্রেতাদের। দাদু খেতে না পেরে তাঁর আফসোসের কথা বলতে দ্বিধা করেননি। রকেট তখন হুলারহাট বন্দরে ভিড়েছে। আমরা রকেট থেকে নামলাম। সেখান থেকে টোটো করে পিরোজপুর শহর যেতে হবে। হুলারহাট বন্দরে আগে থেকে অপেক্ষা করছিল আমার সেজ দাদুর ছেলে শুভ। ওই-ই আমাদের নিয়ে গেল ওদের বাড়িতে অর্থ্যাৎ আমাদের দাদুর সেজ ভাই সমর দাদুর বাড়িতে। পিরোজপুর শহরের পালপাড়ায়। ব্যাটারিচালিত ইজি-বাইক বা টো টোতে উঠে দাদু বললেন, দিশা সত্যিই এখন মাসুদ বুড়ো হয়ে গেছে। জীর্ণ হয়ে পড়েছে। দেখোনি বহু জায়গায় জোড়াতালি লাগনো হয়েছে। রং উঠে গেছে। ছাদ চুষে জলও পড়ে। তবু রকেট স্টিমার তার ঐতিহ্য একেবারে হারায়নি। এখনও সেই ঐতিহ্যের টানে বহু মানুষ পর্যটকরা রকেটে চড়ছেন। সত্যিই এ এক নস্টালজিয়া!
লেখিকা : মানবাধিকার খবর, কলকাতা প্রতিনিধি।