শীতের হিমেল আবহ ভ্রমণপিয়াসী পর্যটকদের মনে আনে প্রকৃতির হিমেল পরশ। ভ্রমণপ্রিয় দর্শনার্থীদের কাছে সিলেটের আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর স্থান হলো প্রকৃতিকন্যা জাফলং। পিয়াইন নদীর তীরে থরে থরে সাজানো পাথরের স্তূপ জাফলংয়ের মূল আকর্ষণ। ঈদের এই সময়ে সময় নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন।
মমতাজ আক্তার:
ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য মনোমুগ্ধকর স্থান। এর মধ্যে প্রকৃতিকন্যা জাফলং অন্যতম। প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত জাফলংয়ের প্রকৃতি মনোমুগ্ধকর। প্রকৃতিকন্যা হিসাবে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। সিলেটের জাফলংয়ে পিয়াইন নদীর তীরে থরে থরে সাজানো পাথরের স্তূপ প্রকৃতিকে দিয়েছে পূর্ণতা। খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। পাশেই ভারতের সীমান্ত। আর ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে আসা অবিরাম জলপ্রপাত সেখানে বিচের আবহ তৈরি করে। মৌসুমে এখানে আসা দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নেয় ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি, উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য। প্রকৃতির সুনসান নির্মল পরিবেশে একটু অবকাশ কাটানোর জন্য প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ছুটে আসেন।
জাফলংয়ের ইতিহাস :
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলংয়ের অবস্থান। জেলা সদর থেকে মাত্র ৫৬ কি.মি দূরত্ব। হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীন নির্জন বনভূমি। ধারণা করা হয় ১৯৫৪ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর পরই খাসিয়া জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটেছিল। এরপর এই বিস্তীর্ণ বনভূমি অঞ্চল পতিত পড়েছিল। তখন জাফলং একেবারে জনশূন্য ছিল। এক সময় ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করে। পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটায় সেখানে আস্তে আস্তে নতুন করে জনবসতি গড়ে ওঠে। ১৯৮০ সালে সিলেটের সঙ্গে জাফলং সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। সিলেট থেকে মাত্র ৫৫ কিলোমিটার সড়ক পথ তৈরি করার ফলে জাফলং হয়ে ওঠে নয়নাভিরাম পর্যটন নগরী। ওপারে ভারত আর এপারে বাংলাদেশের বনভূমি হওয়ায় জাফলং অতিদ্রুত প্রসার লাভ করে। দেশি-বিদেশি পর্যটকের পাশাপাশি প্রকৃতিপ্রেমীরাও ভিড় করতে থাকেন জাফলংয়ে। জাফলং এখন দেশের অন্যতম সেরা পর্যটনস্পট।
কীভাবে যাবেন :
ঢাকা থেকে সিলেটে আপনি বাস কিংবা ট্রেনে করে যাতায়াত করতে পারবেন। সিলেটে থেকে বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা বা লেগুনায় যাওয়া যায় জাফলংয়ে। জাফলং যেতে জনপ্রতি বাস ভাড়া পড়বে ৮০ টাকা। যাওয়া আসার জন্য মাইক্রোবাসের ভাড়া পড়বে ৩০০০-৩৫০০ টাকা। সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া পড়বে ১০০০-১২০০ টাকা। সিলেট শহরের যেকোনো অটোরিকশা বা মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়া যাবে। আর জাফলংমুখী বাস ছাড়ে নগরীর শিবগঞ্জ থেকে। প্রতি এক ঘণ্টা পরপর পাওয়া যাবে বাস। সময় লাগবে এক থেকে দেড় ঘণ্টা।
কোথায় থাকবেন :
জায়লংয়ে থাকার মতো তেমন বেশি সুব্যবস্থা না থাকায় সিলেট শহরে গিয়ে থাকতে হয়। সিলেটে রয়েছে বিভিন্ন মানের হোটেল, মোটেল, কটেজ। পর্যটকরা তাদের পছন্দের যে কোনো জায়গায় অবস্থান করতে পারবে। তবে যে কয়টি ব্যবস্থা আছে তাতে জেলা পরিষদের নলজুরী রেস্ট হাউস অন্যতম। এখানে থাকতে হলে আগে অনুমতি নিতে হয়। এ ছাড়া শ্রীপুরের পিকনিক স্পট উল্লেখযোগ্য। কিছু বোডিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া শ্রীপুর ফরেস্টে পর্যটকদের থাকার জন্য একটি বাংলো আছে। সব মিলিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিলেট ভ্রমণে এলে ভ্রমণের আনন্দ আরও অনেকগুণ বেড়ে যাবে।
দর্শনীয় স্থান :
প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ে শীত ও বর্ষা মৌসুমের সৌন্দর্য়ের রূপ ভিন্ন। ঋতু বৈচিত্র্যের সঙ্গে জাফলংও তার রূপ বদলায়। সৌন্দর্যে আসে বিচিত্রিতা। বর্ষায় জাফলংয়ের রূপ লাবণ্য যেন ভিন্ন মাত্রায় ফুটে ওঠে। ধূলি ধূসরিত পরিবেশ হয়ে ওঠে স্বচ্ছ। স্নিগ্ধ পরিবেশে শ্বাস-নিঃশ্বাসে থাকে ফুরফুরে ভাব। খাসিয়া পাহাড়ের সবুজাভ চূড়ায় তুলার মতো মেঘরাশির বিচরণ এবং যখন-তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পাহাড়ি পথ হয়ে ওঠে বিপদসঙ্কুল সে যেন এক ভিন্ন শিহরণ। সেই সঙ্গে কয়েক হাজার ফুট ওপর থেকে নেমে আসা সফেদ ঝরনা ধারার দৃশ্য যে কারও নয়ন জুড়ায়। সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়-টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি, উঁচু পাহাড়ে গহীন অরণ্য ও সুনসান নীরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদের দারুণভাবে মোহাবিষ্ট করে। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ছোট বড় পাথরের উপর দিয়ে ছুটে আসা স্বচ্ছ পানির স্রোতধারা সৃষ্টি করে এক মনোরম পরিবেশ। যা হতে পারে ভ্রমণ পিপাসীদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্থান। পাথর আর পাহাড়ের মিলন, মাধবকু-ের মতো ঝরনা, কক্সবাজারের মতো জলের ঢেউ, শীতল মিষ্টি পানি; এ যেন অনন্য। পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা ঝরনা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘরাশি।
আশপাশের দর্শনীয় স্থান :
স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর দু-ধারের অপরূপ সৌন্দর্য, দীর্ঘ নৌ-ভ্রমণের সাধ যে কোনো পর্যটকের কাছে এক দুর্লভ আর্কষণ। তেমনি এক নির্জন মনকাড়া স্থান লালাখাল। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের স্থান এবং রাতের সৌন্দর্যে ভরপুর এই লালাখাল সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার সন্নিকটে অবস্থিত। চা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পানীয়। বাংলাদেশের যে কয়টি অঞ্চলে চা বাগান পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে মালনীছড়া অন্যতম। সিলেটের চায়ের রং, স্বাদ এবং সুবাস অতুলনীয়। এ ছাড়া পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে অন্যতম বিখ্যাত মাধবকু- ইকোপার্ক অন্যতম। এই স্থানটিতে রয়েছে পর্যটন করপোরেশনের রেস্টহাউস ও রেস্টুরেন্ট।
লেখক: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, মানবাধিকার খবর