মােঃ জানে আলম সাকী, ব্যুরো চীফ, চট্টগ্রাম : সেন্টমার্টিন দ্বীপ। পর্যটকদের আগ্রহের তালিকায় থাকা শীর্ষস্থানীয় পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটকদের জন্য টেকনাফ উপজেলার এই দ্বীপ ইউনিয়নে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ও সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি হলেও এখানকার স্থানীয়দের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই নাজুক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। দারিদ্র্যতা ও যাতায়াতের সুব্যবস্থার অভাবে দ্বীপের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর এমন প্রভাব ফেলেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। জানা গেছে, দ্বীপে শিশুদের শিক্ষার হার ১৫.১৩% হলেও বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার ৩০ শতাংশের বেশি। তবে শিক্ষার এই অবস্থার উন্নতিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নুর আহমেদ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেন, দ্বীপে সাড়ে ১০ হাজার মানুষের বসবাস। এখানে একটি উচ্চ বিদ্যালয়সহ কলেজ, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আরও একটি এনজিও সংস্থা পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। দ্বীপে আনুমানিক ১২০০ শিশুর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার বয়স হয়েছে। কিন্তু বিদ্যালয়ের দূরত্ব, যাতায়াত খরচ, যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্যসা, দারিদ্র্যতা ও সচেতনতার অভাবে এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছে না।
তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনে শিক্ষার উপকরণসহ দ্বীপের যাবতীয় মালামাল আনতে হয় টেকনাফ থেকে। সবসময় সাগরপথে যা আনা কঠিন। এর মধ্যে বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনা। এতে এক ধরনের ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করে।
তিনি জানান, স্কুলগুলোতে শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শেষ করে আর মাধ্যমিকে পড়ছে না। আবার কেউ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করলেও উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ এজন্য তাদেরকে টেকনাফ, কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রামে যেতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও দিতে হচ্ছে টেকনাফে গিয়ে। অনেক পরিবার আছে হতদরিদ্র। টেকনাফে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গেলে পরীক্ষা পর্যন্ত বাসা ভাড়া কিংবা হোটেল ভাড়া নিতে হচ্ছে। দ্বীপের অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস যেখানে সাগরে মাছ ধরা এভাবে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করানো তাদের জন্য বিলাসিতাই বটে। তবে দ্বীপেই এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সেন্টার করা ও স্কুলে যাতায়াতে সরকারিভাবে গাড়ি দেওয়া গেলে শিক্ষার মান আরও বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান গণমাধ্যম কে বলেন, দ্বীপের শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার ৩০ শতাংশের বেশি হতে পারে। এই দ্বীপের অধিকাংশ পরিবার দরিদ্র। পর্যটন মৌসুমের আয় দিয়ে সারা বছর জীবিকা নির্বাহ করে। অভিভাবকরা লেখাপড়ার চেয়ে শিশুদের দিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরানো, পর্যটন মৌসুমে স্টিমার ঘাটে মুটে বহন, হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাজ অথবা রিকশা ভ্যান চালানোর কাজে লাগায়। ফলে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, দ্বীপে নতুন আরও বিদ্যালয় স্থাপনসহ শিক্ষক সংকট দূর করতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।
জিনজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মিঠুন চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেন, এই বিদ্যালয়ে ৭ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও দুইজন শিক্ষক দিয়ে স্কুলের পাঠদান চলছে। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২০২ জন। প্রতি বছর প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যেতেই ৭-৮ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, তাছাড়া দ্বীপের দূরবর্তী গ্রাম থেকে অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করতে স্কুলে আসে না। সেন্টমার্টিন দ্বীপে শিক্ষার হার বাড়ানো বা মানোন্নয়ন করতে বিদ্যালয়ের খালি পদে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা দরকার। দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবু নোমান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ একাধিক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সেন্টমার্টিনে একটি সরকারি ও আরও একটি এনজিও সংস্থার মোট দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা চলছে। এনজিও সংস্থা ক্রিটে ১৫০ জন শিক্ষার্থী ও জিনজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছে। জিনজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষক দুইজন ও ক্রিট এনজিও সংস্থার স্কুলে ৩ জন শিক্ষক রয়েছেন। তবে দ্বীপে বর্তমানে শিক্ষক সংকট রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, টেকনাফ উপজেলার বাহিরের শিক্ষকদের সেন্টমার্টিনে বদলি করা হলে তারা সেখানে থাকতে চান না। তারা দ্রুত চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
এদিকে সেন্টমার্টিন বিএন ইসলামিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মো. শাহ জালাল সাংবাদিকদের বলেন, টেকনাফের অন্যান্য স্কুলের চাইতে সেন্টমার্টিনের স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম, তবুও আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করছি শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়াতে এবং আরও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করতে। সেন্টমার্টিন বিএন ইসলামিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৩ জন খণ্ডকালীন শিক্ষকসহ মোট ১৫ জন শিক্ষক রয়েছেন, শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৫২ জন।
তিনি জানান, সেন্টমার্টিন বিএন ইসলামিক স্কুল থেকে প্রতি বছর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৬-৭ জন ছাত্র-ছাত্রী ঝরে পড়ছে। এদের ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণির মাঝেই ঝরে পড়ার হার বেশি। এ বছরের শুরুতে মার্চে এসএসসি পরীক্ষায় ৪০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৬ জন পাস করে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপে শিক্ষার হার ১৫.১৩%। তবে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে না আসার কারণে এই স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম বলেও জানান ওই প্রধান শিক্ষক।
তিনি আরও বলেন, সেন্টমার্টিনে স্কুলের শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষা দিতে টেকনাফে যেতে হয়। দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনাসহ টেকনাফে গিয়ে পরীক্ষার দেওয়ার মতো খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেন, সেন্টমার্টিনে শিক্ষা ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সেইসঙ্গে যেসব স্কুলের শিক্ষকের পদ খালি, সেখানে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সেন্টমার্টিনে এসএসসি পরীক্ষার শিক্ষার্থী তুলনামূলক কম এবং আলাদা সেন্টার করতে গেলে পরীক্ষার বিষয়ে তদারকি করার জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগসহ যাবতীয় মালামাল দরকার। আবার বৈরী আবহাওয়ার কারণে যাতায়াতের সমস্যাও সৃষ্টি হয়। সব মিলিয়ে সেন্টমার্টিনে এসএসসি পরীক্ষার সেন্টার করা হচ্ছে না। তবুও বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।