বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে কুড়িগ্রামে তীব্র হয়ে উঠেছে নদীভাঙন। বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদ-নদীর তীরবর্তী বাসিন্দারা। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা ঘরবাড়িতে বসবাস করা পরিবারগুলো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য বলছে, প্রায় ৫০টি পয়েন্টে অব্যাহত রয়েছে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও গঙ্গাধর নদীর ভাঙন। তবে নদ-নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতিনিয়ত ভাঙনের কবলে পড়লেও টনক নড়ছে না পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১১ জুলাই থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার ও তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। প্লাবিত হয় জেলার নয়টি উপজেলার প্রায় ৫৫টি ইউনিয়ন। এখন বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় বেড়েছে ভাঙনের তীব্রতা।
সরজমিনে দেখা গেছে, সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হয়েছে রলাকাটা চরের প্রায় ৫০টি পরিবারের ঘরবাড়ি। চরে শতাধিক পরিবারের বসবাস থাকলেও প্রায় ৫০টি পরিবার ভাঙনের শিকার হয়ে অন্যত্র চলে গেছে। বাকি ৫০টি পরিবারের ঘর-বাড়িও ঝুঁকিতে। প্রতিদিনই ভাঙছে কারো না কারো ঘর-বাড়ি, গাছপালা ও ফললি জমি। একই ইউনিয়নের বড়ুয়া, ভগবতীপুরসহ আরো কয়েকটি চরে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে রৌমারী উপজেলার সোনাপুর, ফলুয়ারচর ঘাট, কোদালকাটি, চিলমারীর শাখাহাতি, অষ্টমীর চরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে।
অন্যদিকে তিস্তার ভাঙনের কবলে পড়েছে রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের খিতাবখাঁ, কালিরহাট, উলিপুর উপজেলার সাদুয়া ধামারহাট, থেতরাইসহ বামতীরের বিভিন্ন এলাকা। সদর উপজেলা আরাজী পলাশবাড়ী, জয়কুমার, সারডোব, চরসিতাইঝাড়সহ বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলে ধরলার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অব্যাহত রয়েছে দুধকুমার এবং গঙ্গাধর নদের ভাঙন। বন্যার পানির স্রোতে বিধ্বস্ত হয়ে আছে নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নে দুধকুমারের প্রায় ২০০ মিটার তীর রক্ষা বাঁধ।
পুরো জেলার প্রায় সব উপজেলায় এসব নদ-নদীর ভাঙন অব্যাহত থাকলেও তেমন পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় ও ভুক্তভোগীরা। পানি উন্নয়ন বোর্ড শুধু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায় অস্থায়ী ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেললেও ভাঙন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের খিতাবখাঁ গ্রামের আবুল হোসেন জানান, তিস্তার ভাঙনে গত তিন-চারদিনে তার বাড়িসহ এলাকার অন্তত ২০টি ভাঙনের কবলে পড়েছে। ঘরের চালসহ বেড়া ও কিছু গাছ কেটে স্কুলের মাঠে রাখলেও নিজেদের থাকার জায়গা মিলছে না। একেকজন একেক জায়গায় রাত কাটাচ্ছে। নিজস্ব আর কোনো জমিও নেই। ঘর তৈরির জন্য জমিও পাওয়া যাচ্ছে না।
একই এলাকার জোবেদ আলী জানান, ঘরবাড়ি, জমিজমা সব নদীতে চলে গেছে। এখন ভাঙনের মুখে রয়েছে আরো অসংখ্য বাড়ি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা। পানি উন্নয়ন বোর্ড শুধু বিদ্যালয় রক্ষার জন্য অল্প কিছু জিওব্যাগ পাঠিয়েছে। সেগুলোয় বালি ফেলার কথা থাকলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি। তবে এসব জিওব্যাগ দিয়ে কোনো কাজ হবে না। ঘরবাড়ি বিলীন হলেও ফোন দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো সাড়া পান না তারা।
ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের চর খিতাবখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ডালিম মিয়া জানান, বিদ্যালয়টি একেবারেই তিস্তার কিনারে। জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তবে স্রোতে কতক্ষণ টিকবে বলা যাচ্ছে না। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের রলাকাটার চরের মইনুদ্দিন জানান, চরটিতে প্রায় ১০ বছর ধরে বসবাস করছেন তিনি। এবার ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে তারসহ ৫০টি পরিবার ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। ভাঙন রোধে পাউবো কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। সদ উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান, বন্যার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ইউনিয়নে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের শিকার এসব পরিবারকে মাত্র ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। এখনো ভাঙন অব্যাহত রয়েছে রলাকাটা, বড়ুয়া, ঝুনকার চর, ভগবতীপুর ও পার্বতীপুর চরে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে যোগাযোগ করা হলেও এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কুড়িগ্রাম পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানান, তিস্তার ভাঙন থেকে চর খিতাবখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রক্ষায় জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। খিতাবখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রক্ষায় প্রকল্প চলমান। দলদলিয়া ইউনিয়নেও জিও ব্যাগ দিয়ে জরুরি প্রকল্পের কাজ চলমান। তিস্তার বাইরেও ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমারের কিছু এলাকায় ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
রোববার, ২৮ জুলাই ২০২৪ ইং ০৩:০১ পিএম.