|
চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা: ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প সুফল বয়ে আনবে কতটা? |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
বর্ষা মৌসুমে ভারি বৃষ্টিপাত চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি অনিবার্য করে তোলে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দায়দোষ চাপানোর মধ্যে নগরকে জলযট মুক্ত করতে নেওয়া ১৪ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প কতটা সুফল বয়ে আনতে পারছে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা-পর্যালোচনা। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, জলাবদ্ধতা নিরসনে চার প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজ শেষ হওয়ায় এরই মধ্যে সুফল আসা শুরু হয়েছে। তবে নগরবাসীর সঙ্গে বিশেষজ্ঞরাও বলছে, এবার মধ্য শ্রাবণ পর্যন্ত ভারি বৃষ্টি কম হওয়ায় জলাবদ্ধতা সহনীয় রয়েছে। প্রকল্পের সফলতা বোঝা যাবে ভরা বর্ষায়। পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী একাধিক গণমাধ্যমকে বলছেন, এখন পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে কম। তাই এখনই প্রকল্পের সফলতা কত ভাগ, সেটা বলার সময় আসেনি পাশাপাশি পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার ও পাহাড় কাটা বন্ধ করা এবং ভবিষ্যতে নগরীর পানি ব্যবস্থাপনার জন্য এখন পরিকল্পনা প্র্রয়োজন বলে মনে করেন এই পরিবেশবিদ। চট্টগ্রাম বন্দর নগরীর কয়েক দশকের পুরোনো জলাবদ্ধতা নিরসনে চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এগুলো মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ এর ৩৬টি খাল ঘিরে নেওয়া প্রকল্প। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। গত বছরের নভেম্বরে সংশোধনের পর প্রকল্প ব্যয় আরও ৩ হাজার ১০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। প্রকল্পটির পূর্ত কাজ করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো এর অধীনে আরেকটি প্রকল্প চলছে। ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পটির খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। প্রতি বর্ষায় নগরীর চকবাজার, মুরাদপুর, বাকলিয়ার একাংশ, দুই নম্বর গেইট, বহদ্দারহাট, কাপাসগোলা, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, আগ্রাবাদ, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ভারি বৃষ্টিতে কোমর সমান পানিতে ডুবে যায় দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি। খাবার পানি, রোগবালাইসহ নানা ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীদের। এমন কি গত তিন বছরে বর্ষায় অরক্ষিত খাল-নালায় পড়ে মারা গেছে শিশুসহ ১০ জন।মে ও জুনের শেষে কয়েকদিন বৃষ্টি হলেও পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। এতেই চকবাজার, কাপাসগোলা ও আগ্রাবাদে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তবে অন্য এলাকাগুলোতে মাত্রা তুলনামূলক কম ছিল। সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মো. ফেরদৌস আহমেদ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলছেন, “আমাদের প্রকল্পের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৭২ শতাংশ। খালগুলোর বেশ কিছু অংশ বর্ষার আগে খনন করা হয়- বড় পরিসরে। ২ কোটি ৭০ লাখ ৫৯ হাজার ঘনফুট মাটি খাল থেকে তোলা হয়েছে। “তবে পাহাড়ি এলাকা থেকে ঢলের সাথে মাটি নেমে আসে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। কর্ণফুলীতে বিপুল পরিমাণ পলি গিয়ে পড়ছে প্রতিবছর।” তিনি বলছেন, “তারপরও গত ৬ মে, ২৭ মে এবং ৩০ জুন ও ১ জুলাই টানা বৃষ্টি হলেও নগরে জলাবদ্ধতা সেভাবে হয়নি। কারণ খালগুলো এখন পানি ধারণে প্রস্তুত। ড্রেন পরিষ্কার করারও সুফল মিলছে বলে মন্তব্য করেন প্রকল্প পরিচালক ফেরদৌস বলেন, “পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাথে মিলে আমরা মেসিভ স্কেলে ড্রেন পরিষ্কার করেছি এবার। যদিও ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের মাত্র ৩০ শতাংশ আমাদের প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত। বাকিটা সিটি করপোরেশনের অধীনে।” জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরীতে যে ৪১টি রেগুলেটর স্থাপন করা হচ্ছে, তার মধ্যে ছয়টি এই প্রকল্পের অধীনে জানিয়ে ফেরদৌস আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এর মধ্যে পাঁচটি চালু হয়ে গেছে। বাকিটির কাজও শেষ পর্যায়ে। “তাই এবার ভালো অবস্থায় আছি। তবে শহরের ভেতরে কিছু খালের খনন কাজে জমি অধিগ্রহণ শেষ না হওয়ায় ধীর গতি ছিল। যেমন- হিজড়া খাল, জামালখান খাল ও মির্জা খালের এক্সটেনশন। “এগুলোর কারণে মেহেদীবাগ, দামপাড়া, সিডিএ এভিনিউর কিছু অংশ ও কাপাসগোলায় পানি উঠে। আশাকরি আগামী মৌসুমেই হিজড়া খলের কাজ শেষ হবে।” প্রকল্পের অধীনে ৩৬টি খালের মধ্যে ১৭টি খালের কাজ শতভাগ শেষ। পাঁচটি খালের কাজ ৮৫ শতাংশ শেষ। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, “অন্য কাজও প্রায় হয়ে গেছে। এখন পানির গতিপথ ও কানেক্টিভিটি যাচাই করে দেখছি আমরা। তারপর প্রজেক্ট কমপ্লিশন রিপোর্ট দেব।” ফেরদৌস আহমেদ আশা করছেন, এবার বর্ষায় জলাবদ্ধতা সহনীয় থাকবে। অন্য স্থানে কমলেও চকবাজার ও সংলগ্ন এলাকায় এবার জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।এমন কেন হল- জানতে চাইলে ফেরদৌস আহমেদ বলেন, চকবাবাজার এলাকার জলাবদ্ধতার কারণ ফুলতলা ব্রিজের কাজ চলমান এবং ওই এলাকার অভ্যন্তরীণ ড্রেনেজ সিস্টেম খুব খারাপ। মিয়ার বাপের ব্রিজের কাজও চলছে। এটা আগামী মৌসুমে শেষ হবে। তবে এবার এখনও ঘাসিয়া পাড়ায় পানি উঠেনি।তবে প্রকল্পের সুফল বুঝতে ভারি বৃষ্টি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন পরিবেশবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী।একাধিক গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে কম। তাই এখনই প্রকল্পের সফলতা কত ভাগ সেটা বলার সময় আসেনি। তবে গত কয়েক বছরের চেয়ে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভালো, সেটা বলা যায়।জুলাই প্রায় শেষ হলেও অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে খুব কম সময়ে ভারি বৃষ্টি হতে পারে। সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ”চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে পাহাড় কাটা এবং পলিথিনের ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিচ্ছেন অধ্যাপদ ইদ্রিস।সিডিএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছের কাজকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অধ্যাপক ইদ্রিস।“তিনি চেষ্টা করছেন প্রকল্প কাজের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে। কতটা সফল হন, সেটা সময়ই বলে দেবে।”মোহাম্মদ ইউনুছ গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, “সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থাকে আমি তালিকা দিয়েছি, খালে থাকা প্রতিবন্ধকতা অপসারণের জন্য। নগরীর বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছি, কোন এলাকায় কেন জলাবদ্ধতা হচ্ছে তা জানতে।“চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা শূন্যে নামাতে চাই। এতে নগরবাসীসহ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। খাল ও নালাতে বাসাবাড়ির আবর্জনা ও পলিথিন না ফেলার জন্য অনুরোধ করছি। খাল ও খালপাড়ের রাস্তা দখল করে বাড়ি বা অবকাঠামো না করতে তাগিদ দিচ্ছি।”তবে পরিবেশবাদী সংগঠন পিপল’স ভয়েস এর সভাপতি শরীফ চৌহান ১৪ হাজার কোটি টাকার চলমান এসব প্রকল্পের বিষয়ে সাংবাদিকদের বলছেন, প্রকল্পগুলোর অধীনে নির্মিত অবকাঠামোগুলো ভবিষ্যতে কারা দেখাশোনা করবে, তা এখনও নির্ধারণ হয়নি।“পলিথিন ও আবর্জনা খালে-নালায় পড়া বন্ধ করতে কার্যকর উপায় এখন পর্যন্ত ঠিক করা হয়নি। পাহাড় কাটা থামাতে না পারলে খালে ও নদীতে পলি জমা ঠেকানো যাবে না। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন খুব জরুরি।”প্রায় কাছাকাছি মত জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক ফেরদৌস আহমেদ বলছেন, প্রতিদিন নগরীর ১ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন আবর্জনা খালে পড়ছে। এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিকমত করা গেলে আশা করি জলাবদ্ধতার বেশিরভাগ নিরসন হবে।“চট্টগ্রাম নগরীর পানি ব্যবস্থাপনা ও নেটওয়ার্কিং খুবই জটিল ধরনের। এটা ম্যানেজমেন্ট সঠিকভাবে করা গেলেই পুরো প্রকল্পের কাজ শেষে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকা সহজ হবে।”
মােঃ জানে আলম সাকী,
ব্যুরো চীফ, চট্টগ্রাম।
|
|
|
|
|