আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম বিশেষ প্রতিনিধি: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে দখল আর ভীতির রাজ্য তৈরির অভিযোগ প্রকাশ্য। রাজনৈতিক এবং পেশিশক্তি ব্যবহার করে তিনি দখল করেছেন একের পর এক সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। তার হয়রানি আর নির্যাতনের ভয়ে এলাকার মানুষ কোনঠাসা প্রায় দেড় দশক।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে,. সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন কুড়িগ্রাম-৪ আসনে (রৌমারী, চররাজিবপুর ও চিলমারী) আওয়ামী লীগের মনোনয়নে দুই দফায় এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে এমপি হয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর পদও বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন। তিনি কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার বাসিন্দা এবং বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
খোদ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, সীমান্তের গরু আর মাদকের চোরাকারবারি দিয়ে রোজগার শুরু হয় জাকির হোসেনের। আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দুই বার এমপি নির্বাচিত হলে হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর আরও ‘ভয়ংকর’ হয়ে ওঠেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। তার ছত্রছায়ায় সীমান্তে মাদক ও গরু চোরকারবারিসহ তৈরি হয় ত্রাসের রাজত্ব। স্থানীয় হাট নিয়ন্ত্রণ ও নদীতে অগণিত অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রকও হয়ে ওঠেন জাকির ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। সরেজমিন এসব অভিযোগের সত্যতা মেলে।
উপজেলার স্থলবন্দরগামী তুরা রোডের পাশে বঙ্গবন্ধু পত্নী শেখ ফজিলাতুন্নেসার নামে কলেজ প্রতিষ্ঠার নামে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের বিশালাকার জায়গা দখলে নিয়েছেন জাকির হোসেন। তৎসংলগ্ন স্থানীয় কৃষকদের আবাদি জমি দখলে নিয়ে বালু ভরাট করে তৈরি করেছেন পাথর ব্যবসার প্রতিষ্ঠান। আইন আদালত করেও সেই জায়গা পুণরুদ্ধার করতে পারেননি ভুক্তভোগী কৃষকরা। জাকিরের অদম্য ক্ষমতার কাছে তারা ছিলেন অসহায়।
দখলকৃত স্থানে খাসজমি সংলগ্ন একটি জমি কিনেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক জালাল মাস্টার। সড়কের পাশে খাস জমিতে প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ করে মাটি ভরাট করে বাড়ি করেছিলেন ভাঙনে ভিটাহারা এই স্কুল শিক্ষক। নদী ভাঙন থেকে বাঁচতে বসতভিটা স্থানান্তরিত করলেও জাকিরের ভূমি লালসা থেকে বাঁচতে পারেননি বৃদ্ধ জালাল মাস্টার। হাতে ৫ লাখ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তাকে বসতি সরাতে বাধ্য করেছেন জাকির।
বয়োবৃদ্ধ জালাল মাস্টার বলেন, আমারে টাকা ধরাইয়া দিয়া কইলো ঘর সরায় নিতে। সরায় নিলাম। তারপরও আমার রেকর্ডকৃত জমিতে বালু ফেলে দখলে নিচে। জায়গাতেও লোকসান, টাকাতেও লোকসান। কী করমু, তার ক্ষমতার কাছে আমরা টিকতে পারি না। এখানে যে জায়গা দখলে নিছে তার অর্ধেক খাস আর অর্ধেক ব্যক্তিমালিকানাধীন। কারও জমির টাকা দেয় নাই।
একই স্থানে জাকিরের ভূমিদস্যুতার শিকার বামনের চর গ্রামের কৃষক দানেজ আলী বলেন, ‘মন্ত্রী হওয়ার পর আমাগোরে এহানে অন্তত ১৪/১৫ জন কৃষকের রেকর্ডি জমি সে দখলে নিছে। আমার ৪ কাঠা জমিত বালু ফেইলা বাঁধছে। ওগুলা আবাদ কইরা আমাগো সংসার চলতো। জমিতে ধানের বিচন (বীজ) ফেলছিলাম। হের ওপরে সে বালু ফেলছে। জমির বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও আমরা কিছুই করতে পারি নাই। তার কাছে টিকতে পারি না। আমরা জমি ফেরত চাই।’
উপজেলার চর শৌলমারী ইউনিয়নেও পড়েছে জাকিরের দখলের ছাপ। ইউনিয়নের টোপপাড়া গ্রামে ঈদগাহ মাঠ সংলগ্ন স্থানে সোলার বিদ্যুৎ পয়েন্ট স্থাপনের নামে প্রতারণা করে কয়েক একর জমি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে করে নিয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী। বর্তমানে সীমানা প্রাচীর দিয়ে জায়গাগুলোর তিনদিক ঘিরে নিয়ে ভিতরে একটি ভবন তৈরি করেছেন। দখল দৌরাত্ম বাড়াতে পূর্ব প্রান্তে দিয়েছেন অস্থায়ী সীমানা বেড়া। দুই দফা এমপি থাকাকালীন সময়ে বাড়িয়েছেন দখলি জমির পরিধি। বিনিময় মূল্য দিতে চাইলেও অনেককে বঞ্চিত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ওই এলাকার বাসিন্দা দেলোয়ার বলেন, ‘আমাদের এখানে আগে বিদ্যুৎ ছিলো না। সে (জাকির) এলাকায় আইসা মানুষজনকে নিয়া মিটিং করে। সৌরবিদ্যুৎ চালু করার নামে মানুষের কাছে দলিল করে নিছে। ওনার ভেতরে যে চক্রান্ত ছিলো তা মাইনষের জানা ছিল না। জসিম স্যারসহ অনেকের জমি দলিল করে নিছে। সৌরবিদ্যুৎ আর হয় নাই। এখন ওইহানে খালি গাঁজা মদের আডডা বসে।’
দেলোয়ারের কথার সূত্র ধরে স্থানীয় স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক জসিম উদ্দিনের কাছে গিয়ে জাকিরের প্রতারণার প্রমাণ মেলে। অবসরপ্রাপ্ত এই প্রধান শিক্ষক বলেন, তখন জাকির এমপি বলছিল সৌরবিদ্যুৎ এনে দেবে। আমাদের অংশিদারিত্ব থাকবে। এলাকার স্বার্থে আমরা কয়েকজন মিলে জমি দলিল করে দিছি। আমার জমি বিক্রি করার প্রয়োজন ছিলো না। সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানির কথা বলে আমার ১৫ শতক জমি লিখে নিছে। আমার পরিবারের ১ একরেরও বেশি জমি লিখে দিছি। পরে আর প্রকল্প হয় নাই।’
জসিম উদ্দিনের বাড়িতে দেখা মেলে তার ভাতিজা আবুল হাশেমের সাথে। হাশেম বলেন, আমার চাষ করা ৩ শতক জমি জোর করে দখলে রাখছে। টাকাও দেয় নাই। কোনও প্রকল্প নাই। এখন ওইখানে ঘর তুলছে। মাঝে মাঝে মন্ত্রী আসতো, মদ-গাঁজার আডডা বসাতো।
জাকিরের প্রতারণার শিকার আরেক ভুক্তভোগী চর শৌলমারীর কৃষক আমজাদ। তিনি বলেন, সৌরবিদ্যুৎ আনবো, পরিবারের লোকদের চাকরি দিবো এইসব কইয়া জায়গা নিছে। দেড় বছর আগে আমার ৫ শতক জমি দখল নিছে। বাধা দিলে পুলিশ নিয়া আসছে। আমি বলছি আমার খেত আমি কেন দিমু। অনেক তর্কাতর্কি হইছে। পরে দুই দফায় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিছে। জমির দাম দশ লাখ। এখন বাকি টাকাও দেয় না, দলিলও কইরা নেয় না। বাকি টাকা মিটায় দিতে চায়া উনি আর আসে না।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকিরের বিরুদ্ধে দখল আর ক্ষমতার অপব্যবহারের এমন অনেক অভিযোগ। রৌমারী শহরে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের জায়গা দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ, সদর ইউনিয়নের রৌমারী-ঢাকা সড়কের পাশে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও খাস জমি দখলে নিয়ে সরকারি যৌথ মালিকানায় স্ত্রীর নামে ‘শিরি অটো রাইস মিলস্’ তৈরির অভিযোগ রয়েছে। দাঁতাভাঙা ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও তৎসংলগ্ন মাজারের জায়গা দখলেরও অভিযোগ রয়েছে জাকিরের বিরুদ্ধে। এছাড়াও উপজেলার ১৯১টি পরিবারকে আশ্রয়ণের ঘর এবং ৭২টি পরিবারকে সৌর বিদ্যুৎ সুবিধার প্রতিশ্রতি দিয়ে ৬০ লাখ ৭২ হাজার টাকা নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে জাকির এবং তার স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়সহ তিন জনের নামে গত ১ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রাম আদালতে মামলা করেছেন মোকছেদ আলী নামে উপজেলার এক বাসিন্দা। এসব অনিয়মের কারণে দলের ভেতরেও তাকে নিয়ে আছে সমালোচনা।
উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা আবিদ শাহনেওয়াজ তুহিন বলেন, আমরা দলগতভাবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের কর্মকাণ্ড নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ বিব্রতবোধ করি। জমি দখল থেকে শুরু করে মাদকের ব্যবসা, মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট, ভাইয়া বাহিনী তৈরি করা সবকিছুই তিনি করেছেন। আমরা দলের হাইকমান্ডকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম। কিন্তু অজানা কারণে দল ব্যবস্থা নেয়নি।
এমপি ও মন্ত্রী হয়ে সম্পদের মালিক হওয়া প্রশ্নে তুহিন বলেন, আমার জানা মতে শুধু কুড়িগ্রামে নয়, ঢাকা, রংপুর ও গাইবান্ধাতেও তার সম্পদ রয়েছে। অনুসন্ধান করলে দেশের বাইরেও তার সম্পদের খোঁজ পাওয়া যাবে। এছাড়াও অন্যের জমি দখল নিয়ে নিজের সম্পদ বানানোতে তিনি সিদ্ধহস্ত। যেখানে তিনি জমি কিনেছের তার পাশেই তিনি দখল করেছেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জাকির হোসেন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কারও কোনও জমি দখল করিনি। সব জমির বৈধ কাগজপত্র আছে। আমি কারও এক আনা ক্ষতি করি নাই। যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেগুলো অপপ্রচার।