সারাদেশ
  হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পদ্মপুরাণ-ভাসান গান
  21-05-2024
গ্রামবাংলার প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী পদ্মপুরাণ (মা মনসামঙ্গল) গানের আসরগুলো দিন দিন কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় পদ্মপুরাণ ও কুশান গানের ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা ছিল দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায়। বিভিন্ন উপজেলাসহ গ্রামে-গঞ্জে জমকালোভাবে মঞ্চায়নের উদ্যোগ নেওয়া হতো। গানের সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ নৃত্য ও গদ্যছন্দে  সংলাপ। মা মনসা ও নাগের জন্ম, দেবতার তুষ্টি, স্বামীভক্তি আর ভালোবাসার কাহিনিই হলো আবহমান বাংলার ভাসান গানের উপজীব্য। কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বৈদ্যের বাজার এলাকার শ্যামল চন্দ্র রায় বাপ-দাদার প্রাচীন ঐতিহ্যকে (প্রথা) ধরে রাখতে নাতির অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান উপলক্ষে নিজ বাড়িতে তিন দিনব্যাপী পদ্মপুরাণ/ভাসান গানের আয়োজন করেন। লালমনিরহাট উপজেলার মোস্তাফি এলাকার অতুল চন্দ্র রায় তাদের শিল্পীগোষ্ঠীর ১২ জন শিল্পী মিলে পদ্মপুরাণ গান ও গীতিনাট্য পরিবেশন করেন। দূর-দূরান্তর থেকে আসা আত্মীয়-স্বজনসহ এলাকার শত শত শ্রোতাদর্শক প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে নারী সেজে পুরুষদের অভিনয়ে ভাসান গান শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। এ অনুষ্ঠানের বেহুলা লখীন্দর ও শিব-পার্বতী কিশোরী মেয়েদের বর-কনে সাজিয়ে বিয়ের অসাধারণ মুহূর্ত উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে তোলে। দর্শকরা যেন সত্যি সত্যি শিব পার্বতী ও বেহুলা লখীন্দরের বিয়ে দেখেন।উচ্ছ্বসিত দর্শকরা জানান, সেই উঠতি বয়সে এ গান শুনেছিলেন তারা। কিন্তু এখন আর তেমন শোনা হয় না। তাই এই ভাসান গানের আয়োজনে যেন আবারও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্য। পরিচালক অতুল চন্দ্র রায় জানান, আমরা এখানে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান করছি। প্রথম দিন যে পালাটি করেছি সেটি সৃষ্টিপত্তন (জাগানভাসান), দ্বিতীয় দিন শিব পার্বতী ও তৃতীয় দিন বুধবার রাতে বেহুলা লখীন্দর পালাটির মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। তিনি জানান,  ভাসান মূলত বেহুলা আর লখীন্দরের গীতিনাট্য। সাধারণত মাঠের ফসল ওঠার পর রাত জেগে এটি পরিবেশন করা হয়। এলাকাভেদে এই গানের নাম আলাদা। আমাদের রংপুর অঞ্চলে বিষহরি ও পদ্মপুরাণ গান নামে এটি পরিচিত। আবার বিভিন্ন অঞ্চলে পদ্মার নাচন, বেহুলার নাচাড়ি, কান্দনী বিষহরির গান নামে পরিচিত। তিনি আরও জানান, আগের মতো এখন এই অনুষ্ঠানগুলো যেখানে সেখানে হয় না, অনেকটা বিলীনের পথে। কিছুটা রক্ষা করছে ধনাঢ্য কিছু হিন্দু পরিবার। আমি এই পেশার সঙ্গে ৮ থেকে ১০ বছর আছি। অনুষ্ঠানগুলো অনেক ব্যয়বহুল, যার কারণে অনেকে এই অনুষ্ঠানগুলো নিতে চায় না। ১২ জন শিল্পী কাজ করেছি। ৫ দিনের পারিশ্রমিক ৩০ হাজার ও সাত দিনের পারিশ্রমিক ৪০ হাজার টাকা বলে জানান শিল্পী অতুল চন্দ্র রায়। এ ছাড়াও তিনি গাইবান্ধা, দিনাজপুর ও রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডাক পান।  শ্যামল চন্দ্র রায় জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে আমাদের বাড়িতে কারও বিয়ে বা অন্নপ্রাশন হলে এই অনুষ্ঠান চলে আসছে। বাপ-দাদার ঐতিহ্য তুলে ধরতেই নাতির অন্নপ্রাশনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। আমি যত দিন বেঁচে থাকব ততদিন এ আয়োজন অব্যাহত থাকবে। ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও কবি আব্দুল হানিফ সরকার জানান, ছোটবেলায় এই গানগুলো রাত জেগে শুনতাম। একটা সময় কুশানগান,  পদ্মপুরাণ ভাসান গান গ্রামবাংলা ঐতিহ্যবাহী গীতিনাট্য হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন কালের আবর্তে এগুলো বিলীনের পথে। গ্রামীণ সংস্কৃতিকে উজ্জীবিত করতে এ ধরনের আয়োজন খুব জরুরি।
 
আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
সোমবার, ২০ মে ২০২৪ ইং ১০:৪৫ পিএম.