বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে শিশু এবং নারী ধর্ষণ উদ্বিগ্ন ভাবে বেড়েছে। ক্রমেই মহামারী আকার ধারণ করছে ধর্ষণ এবং ধর্ষণ শেষে হত্যা। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, শিশু থেকে তরুণী সমাজের সব ক্ষেত্রে, সব বয়সেই ঘটে যাচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা। কুমিল্লার তনু থেকে বগুড়ার রূপা, শিশু রিশা থেকে দুই মারমা সহোদরা, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের বিউটি আক্তার থেকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার এক বছর দশ মাস বয়সি শিশুকন্যাও বাদ পড়েনি পুরষের লালসা থেকে। আমরা ক্রমেই অসভ্য হয়ে যাচ্ছি। এক অতলান্তিক অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি। একের পর এক ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে, আমরা নির্বিকার। এর শেষ কোথায়? নারী ও শিশুকন্যার প্রতি এ সহিংসতার প্রতিকার কী? যখন একটি শিশুর হামাগুড়ি দেবার বয়স, যখন তার টলমলে পায়ে়সদ্য হাঁটতে পারার বয়স,যখন মায়ের কোল ছেড়ে প্রথম গুটি গুটি পায়ে নার্সারিতে যাবার, খেলতে যাবার বয়স,ঠিক তখনই তার শরীরে বসে যাচ্ছে যৌন নির্যাতনের হিংস্র থাবা। যে থাবার বিষাক্ত নখে ছিঁড়িয়ে যাচ্ছে তার সুকোমল প্রত্যঙ্গ।যে থাবায় ক্ষত বিক্ষত যৌনাঙ্গের রক্তে ভেসে যাচ্ছে যন্ত্রণাদীর্ণ ছোট্ট শরীর, মন, তার অপাপবিদ্ধ শৈশব! প্রত্যহ শিউরে উঠছি পাঁচ, চার, তিন বছরের এমনকি আট মাসের শিশুকন্যারও যৌন অত্যাচারের শিকার হওয়া, তাদের অনেকেরই কচি প্রাণ কেড়ে নেওয়ার খবরে। দেশে প্রতি দুটি শিশুর মধ্যে একটি শিশুই এই যৌন হিংসার শিকার। শুধু তাই নয়, হিংসাকারীরা বুক ফুলিয়ে বলতেও পারছে এটা ততো অপরাধ নয়! শিশুদের ক্ষেত্রে মর্মান্তিক ঘটনা গুলির বেশির ভাগই ঘরের অন্দরে, তথাকথিত নিরাপদ আশ্রয়ে ঘটছে। অতি পরিচিত, নিকট আত্মীয় কখনও বা পরিবারেরই বয়স্ক সদস্যদের দ্বারা ঘটছে। কখনও বা কোনো স্বল্প পরিচিত, অপরিচিতও আদর করে চকলেট দেবার ছলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যাচ্ছে।শুধু যৌন বিকৃতি চরিতাথ্রের জন্যে নারী এমনকি দুধের শিশুর ওপরও যে বল্গাহীন নিষ্ঠুর আচরণ, তার প্রতিবিধানে সমাজ, সরকার এত উদাসীন কেন? যে ট্রমা নিয়ে ওই নির্যাতিত শিশুরা বড় হবে,ধর্ষিত নারীর দিন অতিবাহিত হবে, ভবিষ্যতে পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্কগুলিকে কি তারা বিশ্বাস করতে পারবে? সম্মান করতে পারবে? সেই সম্পর্কগুলিতে শেষাবধি তাদের কোনো আস্থা জন্মাবে কি? সারাজীবন যে ক্ষত নিয়ে তারা পথ চলবে কোনো কিছু দিয়েই কি মুছে ফেলা সম্ভব তা? এইসব নারী ও শিশুদের ওপর নির্মম অত্যাচারের রক্তের দাগ আমাদের প্রত্যেকের হাতেও লেগে যাবে, যদি আমরা সবাই তার বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার না হই। ক্যান্সার রোগীকে সুস্থ করতে আক্রান্ত সেলগুলিকে যেমন সমূলে উৎপাটন করতে হয়, সমাজে ছড়িয়ে পড়া ওই ধর্ষক নামক ক্যান্সার সেলগুলিকেও তেমনি উপড়ে ফেলতে হবে। নারীর শরীর পুরুষের কাছে একটি মাংসপিন্ড, তাদের কাছে নারী স্রেফ একটি যৌনবস্তু। এই কারণে একজন পুরুষে অচেনা কোনো নারী এবং ৫ বছর ২ বছর বা তারও কম বয়সি শিশুকে ধর্ষণ করতে পারে। কারণ পুরুষের কাছে নারী যেই হোক না কেন, তার বয়স যাই হোক না কেন, সে একটি সেক্র অবজেক্ট কারণ সে নারী, তার শরীরে একটি যোনী আছে, জরায়ু আছে। যৌনতার জন্য একজন পুরুষের একটি যোনী হলেই চলে। তার বয়স দেখা লাগে না, সম্পর্ক থাকা লাগে না, প্রেম লাগে না, সময় লাগে না, সমাজ, বিবেক কিছুই লাগে না।মেয়েদের দমন, পীড়ন বা তাদের হেয় করার মধ্যে পুরুষেরা আনন্দ খুঁজে পায়। এটা পুরুষেতন্ত্রের বিকৃতি।যৌন বিকৃত ধর্ষকেরা লিংগের ক্ষমতার প্রদর্শণের জন্যে নারী বা শিশু কন্যার উপর জুলুম করতে ভাবে না। ধর্ষণ আর যাই হোক যৌন সংগম নয়। নারীর উপর শক্তি প্রয়োগের চরম রূপ ধর্ষণ। এসবের জন্য পারিবারিক দায় যেমন রয়েছে তেমনি রাষ্ট্রীয় দায়ও কোনো অর্থে কম নয়।রাষ্ট্র যদি উগ্রবাদকে মদদ দেয়, ধর্ষককে প্রশ্রয় দেয়, তবে এই সমাজে মেয়েদের হেয় করা যেমন কমবে না, কমবে না ধর্ষণও।২০১৮ এর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে মোট ১৮৭ জন নারী ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয়। উক্ত সময় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৯ জন নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেন ২ জন এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ২১ জন নারীকে।এ সময় যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২৭ জন নারী।এদিকে বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) সারাদেশে ১৭৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ১৭.৬১ শতাংশ বেশি হয়েছে চলতি বছরে। ১৫টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত শিশু অধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করে তারা এ সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেন।পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৫টি করে। এবং মার্চ মাসে এ সংখ্যা ৬৬টি। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে ৫৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এছাড়াও ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২১ শিশুকে।ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পায়নি প্রতিবন্ধী শিশুরাও। গত তিন মাসে ৮ প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষিত হয়েছে। এছাড়াও গণধর্ষণ হয়েছে ২০ শিশু, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৫ শিশুকে।পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ১৩-১৮ বছরের শিশুরাই ধর্ষণের শিকার বেশি হচ্ছে। গত তিন মাসে ৫৭ শিশু ধর্ষিত হয়েছে।৭-১২ বছরের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৩৭ আর ১-৬ বছরের ক্ষেত্রে ১৫ বলে উল্লেøখ করা হয়েছে।১৮ বছর বয়সের নিচে ধর্ষক যেমন আছে তেমনি ৪৫ বছরের উপরের বয়সেরও ধর্ষক রয়েছে। ২০১৭ সালে মোট ৫৯৩টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যাদের মধ্যে ৭০টি শিশু গণধর্ষিত হয়েছে, ৪৪টি প্রতিবন্ধী বা বিশেষ শিশু ধর্ষিত হয়েছে, ২২টি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ৭টি শিশু ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়াও ৭২টি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৭ সালে ৫১টি শিশু ইভটিজিং এবং ৯০টি শিশু যৌন নিপীড়ন/হয়রানির শিকার হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৫টি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।প্রতিটি শিশু যৌন-নির্যাতনের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে জড়িত বা অভিযুক্তরা মাঝ বয়সী। স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান, শিক্ষক, দফতরি থেকে শু করে বাবার বন্ধু। সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে– মৌখিক, শারীরিক ও যৌন হয়রা- নির শিকার ৬৬ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষেদের দ্বারা। যার মানে দাঁড়াচ্ছে নারীদের নিগৃহীত করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরাট একটি অংশেরই সম্ভবত পরিবার আছে। তারা অবিবাহিত তরুণ নয়। তারা যৌন অবদমনে ভুগছে না।পুরুষ অত্যন্ত যৌন কামনায় ধর্ষণ করে,তা সঠিক নয়। এর সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে। ধর্ষণ হলো নারী বিদ্বেষ এবং পুরুষের একটি ঝুলন্ত প্রত্যঙ্গের ক্ষমতার প্রকাশ। পুরুষ মনে করে এসেছে নারী তার অধঃস্তন, তাই তার উপর জোর-জবরদস্তি করা চলে। পুরুষ জেনে এসেছে নারী যৌনবস্তু, নারী খাদ্য।ধর্ম শিখিয়েছে নারীর অবস্থান পুরুষের নিচে, নারী শস্যক্ষেত্র। তাই পুরুষ প্রতিনিয়ত উৎসাহী হয়েছে তার পুরুষাঙ্গের ক্ষমতার প্রদর্শণে। নারীর প্রতি ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষকে সাহায্য করে ধর্ষক হতে। পুরুষের মতো এমন যৌন ইতরতা, এতোটা যৌন বিকৃতি আর কোনো প্রাণীর আছে কী না আমাদের জানা নেই। মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেছেন, জবাবদিহিতা না থাকায় সমাজে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। দেখা যায়, ধর্ষণ মামলার তদন্ত চলাকালে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ায় ভিকটিম দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হয়। এই ভয়ে মামলা থেকেই ভিকটিম নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মামলা চালানোর বিষয়ে ভিকটিম আগ্রহী হয় না। তিনি বলেন, বিকৃত মানসিকতার ব্যক্তিরাই এই ঘৃণ্য অপরাধগুলো ঘটাচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি একে আরও উসকে দিচ্ছে। বিচারব্যবস্থার গতি ছাড়া ধর্ষণ মামলার বিষয়ে অপরাধীদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি সম্ভব নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আরও আন্তরিক হতে হবে। অতি দ্রুত নারী নেত্রী, মানবাধিকার কর্মী ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সদস্যদের নিয়ে স্পর্শকাতর মামলাগুলোর তদন্তে মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। তিনি বলেন, গুলশান কমিউনিটি ক্লাব, বারিধারা সোসাইটির মতো ক্লাব বা সামাজিক সংগঠনগুলো এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে এলাকার সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি ইভ টিজিংসহ অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধে ক্লাব, মিডিয়া বা সামাজিক সংগঠনের সদস্যদের এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থায় সেক্স এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেছেন, বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অধিকাংশ ধর্ষণ মামলার তদন্ত কার্যক্রমে কোনো গতি নেই। এটি দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, আলোচিত মামলা ছাড়া বেশির ভাগ ধর্ষণ মামলাই দুর্বল থাকে। সেখানে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ধর্ষণ মামলার তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সময় ক্ষেপণ করেন। সম্প্রতি বিউটি ধর্ষণ ওহত্যাকান্ডে ও এ ঘটনা ঘটেছে। এলিনা খান আরও বলেন, প্রভাবশালী অপরাধীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে বিচারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সমাজের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ভুক্তভোগী মেয়েকেই দোষারোপ করা হয়। আবার গ্রামশালিসে মধ্যস্বত্বভোগীরা টাকা নিয়ে অপরাধীর সঙ্গে ভুক্তভোগীকে আপস করার চাপ দেয়। এসব বিষয়ে স্বরাষ্ট্র, আইন মন্ত্রণালয় এবং উচ্চ আদালত যদি ছয় মাস টানা মনিটরিং করে তাহলে সব মামলাই গতি ফিরে পাবে। তিনি বলেন, ধর্ষণ ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ করার কথা থাকলেও তেমন জোরালো প্রতিবাদ হচ্ছে না। নারী নেতৃত্বের প্রতিবাদী হওয়ার কথা থাকলেও তাদের কার্যকর প্রতিরোধ দেখা যাচ্ছে না। ফলে ধর্ষণ নামের সামাজিক অবক্ষয় থেকে নারীর মুক্তি মিলছে না। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. হেদায়েতুল ইসলাম বলেছেন, পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার থেকেই এ ধরনের মানুষ ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করে। সমাজে তারা সঠিকভাবে কারও সঙ্গে মিশতে না পারায় একাকিত্বে ভোগে। সুস্থভাবে নিজের মনের বহিঃপ্রকাশ করতে না পেরে তারা বিচ্ছিন্নভাবে থাকে। ফলে এ ধরনের কিছু মানুষ দুর্বলের ওপর আঘাত করে। বিশেষ করে মেয়েরা পাল্টা আঘাত না করায় তাদের ওপরই বেশি আক্রমণ হয়। হেদায়েতুল ইসলাম আরও বলেন, ধর্ষকের মনোভাবকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় পারসোনাল সাইকোপ্যাথি টেনডেন্সি বলা হয়। তাই তাদের মধ্যে কোনো ধরনের সামাজিক দায়িত্ববোধ তৈরি হয় না। আসলে তারা অসুস্থ। তাদের যৌনপ্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও অসামাজিকভাবে হয়। তাই শিশুদের ওপর নিজেদের যৌনপ্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। বাদ যায় না প্রতিবন্ধীরাও। শুধু কিশোর বা তরুণ নয়, পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিরাও এ ধরনের রোগে আক্রান্ত। কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ? শিশু ও নারী নির্যাতন না কমার কারণ মূলত বিচারহীনতা এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, অপরাধী অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী এবং স্থানীয় শালিসে এক ধরনের আপস-মীমাংসার প্রবণতা।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচার হচ্ছে না অপরাধীদের। বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে নারীকেই। আর ঘটে যাওয়া ঘটনার দৃষ্টান্ত মূলক বিচার না হওয়ায় বাড়ছে অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনা। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেকেই আদালত বা পুলিশের দোড়গোড়ায় পৌঁছাচ্ছেন না।ফলে এসব অপরাধ ঘটছেই। অনেক নারী এবং ভিকটিম শিশুর অভিভাবক জানেই না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়। আবার অনেক নির্যাতনের ঘটনা কিন্তু আদালত পর্যন্ত না গিয়ে বাইরেই মিটমাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আর যে কোনো ধর্ষণ বা সহিংসতার পিছনেই সমাজের বেশিরভাগের আগ্রহ নারীর দোষ, তার পোশাকের দোষ খোঁজার ক্ষেত্রে, যা ধর্ষণকে আরও উৎসাহিত করে তুলছে।উন্নত দেশে যে ধর্ষণ হয় না, তা নয়। সেখানে কিন্তু দ্রুত বিচার আইনে সাজা হয় এবং মানুষ তা দেখে সচেতন হয়। ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন কম হয়। সেখানে ধর্ষিতাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় কেউ দাঁড় করায় না। আমাদের সোনার বাংলাদেশে ধর্ষক বুক ফুলিয়ে বীরের বেশে ঘুরে বেড়ায় আর ধর্ষিতার স্থান হয় ঘরের কোনে- যদি বেঁচে থাকে সে। যেন ধর্ষিত হওয়া এদেশে নারীরই অপরাধ।মানুষ মাত্রই অন্যের ঘাড় ভীষণ প্রিয়। কারণ দোষ চাপানোর এমন উত্তম জায়গা আকাশ-পাতাল এক করলেও আর মিলবে না! আর মেয়ে হলে তো কথাই নেই। আমাদের সমাজে মেয়েরা হচ্ছে ‘নন্দ ঘোষ’। সব দোষ তাদের ঘাড়ে না চাপালে আমরা শান্তি পাই না। ধর্ষককে বাঁচাতে ধর্ষণের কারণ হিসেবে এ দেশের বিশাল এক শ্রেণি নারীর পোশাকের দোষ খুঁজে পায়- ধর্ষিতা বোরকায় আবৃত হলেও, দুই বছরের শিশু হলেও। আমি বিশ্বাস করি যারা নারীর পোশাকের সমস্যা বের করে পরোক্ষ ভাবে ধর্ষককে রক্ষায় নামে তারাও এক একটি ধর্ষক। ধর্ষণ করলো পুরুষ, কিন্তু বলা হবে সব হচ্ছে মেয়েদের দোষ! পুরুষ তার যৌন লালসার বিকৃত প্রকাশ ঘটাবে, দায় চাপানো হবে নারীর পোশাক, আচরণ ও চলাফেরার ওপর! পুরুষ পারে না তার লিংগ সামলাতে কিন্তু দায়টা নারীর ওপর চাপানো চাই। কি অদ্ভুত আমাদের সমাজ! যেখানে নারী-শিশুদের নিরাপত্তা দেওয়া তো দূরে থাক, তাদের যৌন নির্যাতনকারীদের পরোক্ষভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে এই সমাজ। বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সব অপরাধী। মনের মধ্যে পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে নতুন কোনো মেয়ে বা শিশুকে লক্ষ্য করে এগোচ্ছে। এটাই যদি হয় আমাদের সমাজের রূপ তাহলে কেন বন্ধ হবে শিশু ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ইভটিজিং এর মত সমাজের বুকে গেঁথে যাওয়া অপরাধগুলো! নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারীকে মানুষ ভাবতে শিখতে হবে পুরুষকে এবং নারীর নিজেকেও। প্রতিটি পরিবারের উচিত তাদের ছেলে বা মেয়েকে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ সম্পর্কিত শিক্ষা দেওয়া, বিবেকবোধ, সংবেদেনশীলতা, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি জাগিয়ে দেওয়া। এবং অবশ্যই নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখানো। সেই সাথে আইনের কঠোর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
|