আমাদের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম সোহেল রানা। তিনি প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে মাসুদ পারভেজ, আর অভিনেতা হিসেবে সোহেল রানা নামে খ্যাত। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলার প্রথম মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন ছবির মাধ্যমে তার পদযাত্রা। এরপর থেকে তিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শক হৃদয় জয় করেন। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্রের পুরস্কার সহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। সোহেল রানার একটি সন্তান মাশরুর পারভেজ জীবরার, স্ত্রী ডা. জিনাত পারভেজ। সোহেল রানা বাস্তব জীবনের সত্যিকার এক নায়ক তাইতো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশ রক্ষা করতে ঝাপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে এবং যুদ্ধ করে আনতে পেরেছেন দেশের স্বাধীনতা। মানবাধিকার পরিস্থিতির সামগ্রিক অবস্থা ও সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলা চলচিত্রের কিংবদন্তি সোহেল রানা মানবাধিকার খবরকে একান্ত সাক্ষাৎ প্রদান করেন। যার বিশেষ অংশ মানবাধিকার খবর-এর পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল- মানবাধিকার খবর ঃ বর্তমানে আপনার কিভাবে সময় কাটছে। আপনার লেখা একাধিক বইতো প্রকাশ পেয়েছে। সম্প্রতি কোন লেখায় কি হাত দিয়েছেন? সোহেল রানা ঃ আমার সময়টা কাটছে ধর্মীয় কর্মের মাধ্যমে। বই পড়ে, সমাজ ও মানুষকে নিয়ে ভেবে। কিছুটা সময় রাজনীতিকে ঘিরে। সম্প্রতি একটি চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। পাশাপাশি আমার আত্ম-জীবনি লেখায় হাত দিয়েছি, এইতো এভাবেই সময় অতিবাহিত হচ্ছে। মানবাধিকার খবর ঃ বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই? সোহেল রানা ঃ দেখুন আগে তো মানবতা বোধটা থাকা দরকার তারপর হচ্ছে অধিকারের কথা। যে মানুষের মধ্যে মানবতা বোধ থাকে, মানবিক মূল্যবোধ থাকে ও মানুষের প্রতি মায়া-মমতা থাকে তবেই না সে মানব হবে। তারপর আসবে অধিকারের কথা। মানব না হলে মানবাধিকার বিষয়টি যথার্থ হবে না। বিশ্বের সব ক্ষমতাধর দেশগুলো নিজেদের সভ্য বলে দাবি করলেও তারা কি আসলেই সভ্য বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। বিশ্বের শক্তিধর সভ্য জাতি যুক্তরাষ্ট্র তাদের কথা যদি বলি সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হিলারি থেকে পঞ্চাশ হাজার ভোট কম পেয়ে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু দেখা গেল ভোট নির্বাচকগণ সিলেকশানের মাধ্যমে ট্রাম্পকে জয়ী করলো, অথচ তারা বিশ্ব বাসীর কাছে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বেড়ায়। কোথায় গণতন্ত্র, কোথায় মানবাধিকার। যেমন লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফীর কথা যদি বলি তাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে আমেরিকা হত্যা করল, বিশ্ববাসী শুধু দেখেই রইল। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো হচ্ছে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও পোশাক অথচ এর সবকটি গাদ্দাফীর আমলে ফ্রি ছিল। এটাকেই বলে মানবাধিকার, গণতন্ত্রের অধিকার। আমেরিকার নিজেরই গণতন্ত্র ঠিক নেই তার দেশে খাদ্য বাসস্থান চিকিৎসা, শিক্ষা ও পোশাক কোনটাই ফ্রি না, আবার অভিবাসী বিতাড়িত করতে চাচ্ছেন অথচ তারাই বিশ্ববাসীর উপর মাতাব্বরী করে চলেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রোহিঙ্গা জাতির উপর যে নির্যাতন চলছে এটি একটি জাতির জন্য চরমভাবে মানবাধিকার লংঘন বলে মনে করি। এই যে সূচি দশ লক্ষ রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে আসতে বাধ্য করেছে। তারা অত্যাচারের মুখে পৈতৃক ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। অনেক নারী ধর্ষিত হয়েছে শিশু, যুবক ও বৃদ্ধ খুন হয়েছে তার সেনাবাহিনীর হাতে। বিশ্ববাসী চুপ একের পর এক রোহিঙ্গা খুন হচ্ছে, বিতাড়িত হচ্ছে নিজ ভূমি থেকে। এই যে হত্যাযজ্ঞ মিয়ানমার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতাধর কোনো দেশ শক্ত ভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছে না কারণ তাদের অনেক স্বার্থ নিহিত আছে এই আরাকান রাজ্যে সব ক্ষমতাধর রাষ্ট্রই তাদের বিভিন্ন ইন্ডাষ্ট্রি ও শিল্প কারখানা গড়তে চায় কারণ পৃথিবীর সব চাইতে বৃহৎ গ্যাসের খনি মিয়ানমারের মাটির নিচে সে সব দেশ চাইছে, সে গ্যাস উত্তোলন করবে এবং নিজ দেশেও নিয়ে যাবে। বিশ্বের প্রত্যেকটি ধনী রাষ্ট্রেরই চোখ পড়েছে বার্মার আরাকান রাজ্যে। রোহিঙ্গাদের বলা হচ্ছে ওরা সে দেশের নাগরিক না ওরা বাংলাদেশী। কিন্তু রোহিঙ্গারা বলছে আমরা রোহিঙ্গা বাংলাদেশী নয়। দুইশত বৎসর পেছনে গেলে আমরা ইতিহাসে দেখতে পাব, তৎকালীন আরাকান রাজ্যের রাজ্য পালকে সাহায্য করতে আমাদের দেশ থেকে সৈন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। সে যুদ্ধে আরাকান রাজ্যের বিজয় হয়। যুদ্ধ বিজয়ের পর আমাদের দেশের সৈনিকরা যথারীতি ফিরে আসে তবে কিছু সৈনিক আরাকান রাজ্যেই থেকে যায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে। যা কিনা যুদ্ধ সমাপ্তির পর সব দেশেই হয়ে থাকে। রোহিঙ্গারা তো আজকের নয় দুইশত বৎসর পুরোনো জাতি মিয়ানমারের। তাহলে মুষ্ঠিমেয় কিছু রাষ্ট্রের স্বার্থের কারণে ওরা কেন নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হলো। আজ বাংলাদেশকে বিশ্ববাসী খুব ভাল দেশ বলছে কারণ এতগুলো রোহিঙ্গাদের আমরা থাকতে দিয়েছি। যারা আমাদের প্রশংসা করছে ওদের তো কোন সমস্যা হচ্ছে না হচ্ছে আমাদের, এতগুলো মানুষকে নিয়ে বাংলাদেশ রীতিমত হীমশিম খাচ্ছে। যারা রোহিঙ্গাদের জন্য উপরি মায়া দেখায় তাদেরকে বলছি তারা তাদের দেশের ইমিগ্রেশান ফ্রি করে দিকনা, রোহিঙ্গারা যেকজন যেতে পারে যাবে। আমেরিকায় তো মাইলের পর মাইল জায়গা খালি পড়েই আছে। মোট কথা কোনো জাতিকে নিধন করে সে জায়গায় নতুন কিছু প্রতিষ্ঠা করা মানবাধিকারের চরম লংঘন। তাই বিশ্ব নেতাদের একসাথে আলোচনায় বসে মূল সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে, শুধুমাত্র রোহিঙ্গা ইস্যু নয় বহির্বিশ্বের সব ধরনের যুদ্ধ ও অনাচার বন্ধ করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাহলেই গোটা বিশ্বে আমরা মানবাধিকার সংরক্ষণ করতে পারবো। মানবাধিকার খবর ঃ এ মাস তো স্বাধীনতার মাস আপনাদের মত মুক্তি যোদ্ধাদের জন্যই আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আপনার কিছু চাওয়া ছিল সে সম্বন্ধে আপনার কাছ থেকে আমরা কিছু জানতে চাই। সোহেল রানা ঃ দেশ স্বাধীন হয়েছে সত্যি কিন্তু আমরা কতটুকু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি এটি সবার কাছে প্রশ্ন? আমাদের দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা তৈরী হয়েছে তা আমি মানিনা। এক সরকার এসে বলে তুমি মুক্তিযোদ্ধা আরেক সরকার এসে বলে তুমি মুক্তিযোদ্ধা না। এছাড়া যে নিয়মে মুক্তিযোদ্ধা গন্য করা হয় তা আমি মানতে পারিনা। দেখা যায় যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি এবং যাদের সে সময় জন্মও হয়নি তাদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় উঠে এসেছে। ধরুন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফুটবলার ছিলাম, আমি যদি যুদ্ধের সময় পালিয়ে ভারতে গিয়ে ফুটবল খেলতাম তারপর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেশে এসে বলি খেলার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস দিয়েছি, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠাতাম এটাকি বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো নিশ্চয়ই হতোনা। যেমন যুদ্ধে অনেক মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলো তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই তারাতো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তাদের সম্ভ্রম হারাননি। ইতিহাস বলে পৃথিবীতে এ যাবত যত যুদ্ধ হয়েছে নারীরা ধর্ষিত হয়েছে, এজন্য তারা তো মুক্তিযোদ্ধা হননি। আবার গায়ক গায়িকারা জীবন বাচানোর জন্য শহর ছেড়ে ঘুরে ঘুরে গান গেয় বেড়িয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেছেন, এটাও নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ কিন্তু তারা মুক্তিযোদ্ধা হন কিভাবে? এরা যদি মুক্তিযোদ্ধা হন তাহলে সে সময়ের সাড়ে সাত কোটি মানুষুও মুক্তিযোদ্ধা কারণ তারা আমাদের খেতে দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন ও নিরাপত্তা দিয়েছেন। তবে তাদের কেন আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলিনা। যেমন বলা যায় বিদ্যালয়ের ছাত্র সকল মানে তো এই নয় যে প্রথম শ্রেণীতে যে পড়ছে এবং দশম শ্রেণীতে যে পড়ছে এরা এক হয়ে গেল। আমাদের দেশে এমনটা ঘটেছে। মুক্তিযোদ্ধা তাদেরকে বলা হয় যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে শত্রুর মুশোমুখি হয়। যেমন হানাদার বাহিনী আমাদের গুলি করেছে আমরাও তাদের লক্ষ করে গুলি করেছি। যারা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও জন্মভূমির মুক্তির জন্য শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়েছে তারাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। যারা যোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে ও সমর্থন করেছে তারা হচ্ছে সহ-মুক্তিযোদ্ধা বা সমর্থক মাত্র। আরেকটি বিষয় আমরা যখন মৃত্যুর মুখোমুখি শত্রুর মোকাবিলা করছিলাম তখন সরকারি কর্মকর্তারা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ ও বুদ্ধিজীবিরা ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় কি করছিলেন। তারা কেনই বা পাকিস্তান সরকারের বেতন-ভাতা ভোগ করছিলেন। তাদের কি সন্দেহ ছিল যে আমরা বিজয়ী হবনা? এই প্রশ্নটি আমার জাতির কাছে রইল। মুক্তিযোদ্ধারা একটি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, তাই প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আমার অনেক ভাবনা এবং চাওয়া রয়েছে। একজন পুলিশকে দেখলে আমরা বুঝি তিনি পুলিশের সদস্য, কিংবা একজন আর্মিকে দেখলে আমরা বুঝি তিনি সেনা বাহিনীর সদস্য, কিভাবে চিনি আমরা চিনি তাদের ইউনিফর্ম দিয়ে। তাই আমি সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ইউনিফর্ম চেয়েছিলাম যেন তাঁরা সরকারী অনুষ্ঠান বা ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে এ পোশাক পড়ে যাবে প্রত্যেকটা মানুষ দেখলেই যেন বোঝেন তিনি আমাদের একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটা কার্ড চেয়েছিলাম যা দিয়ে হাসপাতাল, গনপরিবহন, ট্রেন ও অন্যান্য জায়গায় বিশেষ সুবিধা ভোগ করা যায়। বিশেষ করে সরকারী মেডিকের ও প্রাইভেট হাসপাতালে বিশেষ কক্ষ সংরক্ষণ করা যেমনটা ভি,আই,পি দের জন্য সংরক্ষিত থাকে। খারাপ লাগে যখন দেখি একজন মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে থাকে। একজন এমপি মন্ত্রীর আগে মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসার প্রাধান্য পাবে এটাইতো সম্মান। সরকার তাদের চিকিৎসা ছাড়া অন্যান্য সুবিধাগুলো ফ্রি করে দিতে পারেন। এখানে ইচ্ছেটাই যথেষ্ট, মুক্তিযোদ্ধাদের বা তাদের সন্তানদের হাতে ভাতা তুলে দেয়া মানে সম্মান নয়। মুক্তিযোদ্ধারা জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় যেন তাদের প্রাপ্য সব সুবিধাগুলো ভোগ করে যেতে পারে। সরকারকে সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু যখন আদেশ করেছিলেন যা সাথে আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ো দেশ রক্ষা করো, আমরা জীবন বাজী রেখে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম একটি পতাকার জন্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্যে। টাকার জন্য আমরা যুদ্ধ করিনি। দেশ এখন স্বাধীন তাই আমাদের চাওনা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করা হোক, মূল্যায়ন করা হোক তথা প্রাধান্য দেয়া হোক এর চাইতে আর কিবা চাওয়ার আছে। মানবাধিকার খবর ঃ মানবাধিকার খবর পত্রিকা সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই। সোহেল রানা ঃ পত্রিকার মাধ্যমে আপনারা কষ্ট করে যে কাজগুলো করছেন। নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। আপনারা এভাবেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাবেন এটাই কাম্য। সাক্ষাৎকার গ্রহনে- রুবিনা শওকত উল্লাহ
|