ইসলাম
  মুসলিম জাতির বিভাজন : উত্তোরণের উপায়
  04-04-2018

মাওলানা আবুবকর সিদ্দীক আদ্দাঈ
আজ মুসলিম উম্মাহ শত বিভক্ত। এই বিভক্তির সুযোগে ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের ধ্বংস সাধনে অধিকতর তৎপর হয়ে উঠেছে। ফলে বিশ্বের দিকে দিকে আজ মুসলমানরা মার খাচ্ছে। পৃথিবীর আকাশ বাতাস মজলুমের আত্ম চিৎকারে অস্থির হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা  থেকে মুক্তির প্রয়োজনে দরকার মুসলিম জাতির ইস্পাত কঠিন ঐক্য। যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে রসুল(সঃ)- এর ক র্মপদ্ধতির পূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে। কিন্তু বড়ই পরিতাপ ও লজ্জার বিষয়, মুসলিম সমাজে রসুল (সঃ)- এর কর্মপদ্ধতির পূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণের বড়ই অভাব। এ অভাবই মুসলিম অনৈক্যের মৌলিক কারণ। তাই আজ গোটা মুসলিম বিশ্বে দাউ দাউ করে জ্বলছে অশান্তির আগুন। গোটা মুসলিম উম্মাহ তার মৌলিক দায়িত্ব বিশ্ব মানবতাকে আল্লøাহর পথে আহ্বান ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ পরিত্যাগ করে দ্বীনের কিছু কাজ আঞ্জাম দিয়ে রসুলের সুন্নতকে মেনে চলার দাবি করে আত্ম তৃপ্তি লাভ করছি, আর অপর দিকে রসুলের প্রতিষ্ঠিত জীবন ব্যবস্থা যা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ, তা ধ্বংসের যারা চক্রান্ত চালাচ্ছে তাদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে, বুকে বুক মিলিয়ে চলছি।
মুসলিম ঐক্যের বদলে এই বিভক্তির কারণ কী তা বুঝে নেয়ার সময় এসেছে। আমাদের এ কালে আমরা অধিকাংশ মুসলমানই বিক্ষিপ্ত ভাবে রসুল (সঃ)-এর অনুসরণের কিছু কিছু কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু রসুলের উপরে অর্পিত মূল দায়িত্ব দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজ থেকে দূরে অবস্থান করছি। অথচ রসুলের প্রতি আগত কিতাবের প্রতিষ্ঠাই ছিল আমাদের মূল কাজ। এ কথাই ইরশাদ হচ্ছে পবিত্র কালাতুলাহতে-“বলে দিন : হে আহলে কিতাবগণ,  তোমরা কোন পথেই নও, যে পর্যন্ত না তোমরা তাওরাত, ইঞ্জিল এবং যে গ্রন্থ তোমাদের উপরে  তোমাদের পালন কর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে তা সর্বোপরি প্রতিষ্ঠা না কর। (আল মায়েদা- ৬৮)
এই দায়িত্ব পালন করা ছিল মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ কাজ। কিন্তু আমরা আল্লøাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য রসুলের সুন্নত অনুযায়ী অগ্রসর হতে আগ্রহী নই। যে কারণে আমরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি মহব্বত ও দরদ অনুভব করি না। সাহাবায়ে কেরাম রসুলের সুন্নাত অনুযায়ী দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে গেছেন, তাইতো তারা ছিলেন ‘রুহামাউ বাইনাহুম’ -একে অপরের প্রতি ছিলেন বন্ধু প্রতিম। কিন্তু আমরা সাহাবাগণের বৈশিষ্ট্যের কাছাকাছিও নেই। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে বরং আমরা একে অপরকে হেয় করার জন্য ফতোয়াবাজিতে ব্যস্ত। এ জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে উপদলে বিভক্ত সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ মূলক হাদিস- “তোমাদের পূর্ববর্তী কিতাবধারীগণ বাহাত্তরটি দলে বিভক্ত ছিল আর উম্মতেরা তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে এবং একটি দল জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর সেই দলটি হলো জামায়াত। (ইবনে মাজাহ, সুনান, আবওয়াব আল ফিতান) যেখানে মুসলমানদের উচিত ছিল একে অপরের সাধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুন্নাত প্রতিষ্ঠায় আত্ম নিয়োগ, সেখানে এই হাদিসকে ভিত্তি করে তারা একে অন্যকে ভ্রান্ত, ফাসেক এমনকি কাফের ফতোয়া দিয়ে বাহবা কুড়াচ্ছে।
আমরা একজন নাস্তিক বা ইসলামের কট্টর দুশমনকে ততটা দুশমন মনে করি না যতটুকু করছি অন্য এক মুসলমানকে, যিনি আমার দলের অনুসারী হয়ে ঠিক আমার মত জীবন যাপন করছে না। এই যে বিভেদ ও ফতোয়াবাজি, তার মূল কারণই হলো সুন্নতের সঠিক জ্ঞানের অভাব, আর জ্ঞান থাকলেও তার সঠিক বাস্তব প্রয়োগ না থাকা। এই জঘন্য ব্যাধি হতে মুক্তি পেতে সুন্নতের উপরে প্রতিষ্ঠিত আমাদের পূর্ববর্তী মহান ব্যক্তিদের ইতিহাস থেকে সবক গ্রহণ করা দরকার। আসুন, আমরা খোলা মন নিয়ে ইতিহাস ঘেটে সুন্নতের দাবিদারেরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এক দিলের অধিকারী হওয়ার প্রচেষ্টা চালাই।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই “পূর্বেকার বিশেষজ্ঞ আলেমগণ (সালাফ)  থেকে পরবর্তী আলেমগণ (খালাফ) পর্যন্ত তাঁরা যাদের সম্মান ও মর্যাদার পাত্র মনে করতেন তাদের নিষ্পাপ মনে করা তাদের নীতি ছিল না এবং তাদের ইজতেহাদী বিষয়ের মধ্যে কোন জিনিসকে ভ্রান্ত ও ভুল মনে করেছেন তার বিরোধিতায় অবতীর্ণ হওয়া এবং তাঁদের অবদান অস্বীকার করার মনোবৃত্তি তাদের ছিল না। পক্ষান্তরে তাঁরা যে জিনিসকে ভুল মনে করেছেন তাকে যুক্তি প্রয়োগের সাহায্যে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কিন্তু কারো ইজহেদী ভুলকে তাঁরা সংশ্লিষ্ট মুজতাহিদের মান-মর্যাদার জন্য কলঙ্কজনক মনে করেননি। তাঁরা ইজতেহাদী ভুলকে ভুলও বলতেন এবং তার সাথে মতভেদও পোষণ করতেন, কিন্তু মুজতাহিদের মান-মর্যাদার প্রতিও লক্ষ্য রাখতেন এবং ইজতেহাদী ভুলের কারণে তাঁর সমস্ত অবদান অস্বীকার করে বসতেন না। ” (রাসায়েল ও মাসায়েল-৩য় খন্ড)
সলফে সালেহীনদের এ ব্যাপারে কেমন আচরণ ছিল, তা থেকে দু’একটি ঘটনা তুলে ধরা হলো।
বাদশাহ হারুণ-অর -রশীদ ছিলেন ইমাম মালেক (রঃ )-এর অনুসারী। ইমাম মালেকের মতে রক্ত প্রবাহিত হলে অজু ভঙ্গ হয় না। তাই একদিন রক্তের চাপ কমানোর জন্য দেহ থেকে রক্ত বের করেছিলেন কিন্তু পরে ওজু না করেই নামাজে ইমামতী করেন। ইমাম ইউসুফ রক্ত  বের হলে ওজু ভঙ্গ হয় বলে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তিনি ইমাম মালেকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তাঁর নিজস্ব ইজতেহাদ লব্ধ জ্ঞান পরিত্যাগ করেন। ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) বাদশাহর ভয় বা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য নয় বরং ইমাম মালেকের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য নিজ ইজতেহাদী জ্ঞানকে ছেড়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেননি।
আর একটি ঘটনা ইমাম শাফেয়ী (রঃ)-এর জীবনের। ইমাম শাফেয়ী (রঃ )-এর মতে ফজরের নামাজে দুয়া-ই- কুনুুত পড়তে হয় এবং তিনি ও তাঁর মযহাবের অনুসারীরা বছরের সময় সময়ই এভাবে পড়ে থাকেন। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রঃ)- এর ইন্তিকালের পরে তাঁর কবর জিয়ারতে আসেন ইমাম শাফেয়ী (রঃ)। তিনি ফজরের নামাজ ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-এর কবরের পাশেই আদায় করেন। কিন্তু তিনি সে দিন তাঁর নিজস্ব মযহাব অনুযায়ী ফজরে দোয়া -ই- কুনুুত পড়েননি। এ ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, তাঁর (ইমাম আবু হানিফার) প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব অভিমত এ জায়গায় পরিত্যাগ করেছেন।
যদিও ইমাম শাফেয়ী (রঃ) ফজরে দোয়া ই-কুনুত পাঠ জরুরি তা হাদিস থেকে প্রমাণ  পেশ করে থাকেন। কিন্তু হাদিস দ্বারা প্রমাণিত জরুরি আমলটি একজন মৃত ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য তাঁর কবরের পাশে এসে ছেড়ে দিলেন। আর এভাবেই একজন প্রথম শ্রেণির ইমাম তাঁর পরবর্তী অনুগামীদের জন্য সম্প্রীতি বজায় রাখার আদর্শ রেখে  গেলেন।
একের প্রতি অপরের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার ইতিহাস এখানেই শেষ নয়। হজরত ইবরাহিম নখয়ী ও হজরত ইবরাহিম তায়িমী দুইজন ফকিহ ফেকহী মতামতের ব্যাপারে দুই ধরনের মত অবলম্বন করতেন। কিন্তু তাই বলে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিকতা মোটেও কম ছিল না। তখনকার গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ একটি ব্যাপারে ইবরাহিম নখয়ী (রঃ)-এর উপরে ক্ষেপে গিয়ে তাকে বন্দী করার নির্দেশ প্রদান করেন। গভর্নরের লোকেরা হজরত ইবরাহিম তায়িমীকে ইবরাহিম নখয়ী মনে করে বন্দী করে জেলখানায় আবদ্ধ করে।                                                                                           
                                                                                                                    চলবে-
লেখক ঃ ধর্মীয় গবেষক, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত
 আলোচক ও সহকারী সম্পাদক, মানবাধিকার খবর