মানব র্দুভোগ
  কাজে আসছে না কোনো পরিকল্পনা সড়কে মৃত্যুর মিছিল! থামবে কবে?
  01-05-2016

 

প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। সড়ক-মহাসড়কগুলো যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। এতে অসংখ্য জীবন যাচ্ছে। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করছে চিরতরে। এইসব পরিবারের ওপর নেমে আসছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালোছায়া। অথচ প্রতিকারহীনভাবেই চলছে এই ‘দুর্ঘটনা’ নামক ‘হত্যাযজ্ঞ’। এ নিয়ে অনেক কথা হলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। এর প্রমাণ গতকাল রংপুরে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৩ জন মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়া। প্রশ্ন উঠেছে এভাবে আর কতোদিন?

দেশের কোনো না কোনো স্থানে প্রতিদিনই কারো না কারো জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে ‘দুর্ঘটনা’ নামক দানবের হাতে। সর্বশেষ ২০ এপ্রিল রংপুরের তারাগঞ্জে দুই যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনাটি এর সর্বশেষ সংযোজন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক।

২০ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে উপজেলার রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের ইকরচালী বরাতির ব্রিজ এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।  ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া সায়মুন পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস ওই এলাকায় পৌঁছালে সামনের ডানদিকের চাকা পাংচার হয়। এ সময় চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় বিপরীত দিক থেকে আসা দিনাজপুর থেকে রংপুরগামী তৃপ্তি পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ৮ জন নিহত হন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো ৪ জনের মৃত্যু হয়।  এ ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যু কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে।

এক হিসেবে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে দেশে প্রায় দেড় লাখেরও বেশি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে ৫০ হাজারের বেশি লোক প্রাণ হারায়। আহতের সংখ্যা এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রতিবছর দেশের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ শতাংশ। নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সমস্যা, পরিকল্পনা ও নীতির দুর্বলতা, অসচেতনতা ইত্যাদি বিষয় সড়ক দুর্ঘটনা ত্বরান্বিত করছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, এক বছরে প্রায় ২০ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার মানুষ নিহত হয়। আহত হয় এক লাখ। এদের বেশিরভাগই পঙ্গুত্ববরণ করে।

 

কারণগুলো জানা থাকলেও প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না দুর্ঘটনা। যানবাহনের অধিক এবং বেপরোয়া গতিই কেড়ে নিচ্ছে অনেকের প্রাণ। রংপুরের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও চালকের বেপরোয়া গতিই অন্যতম কারণ। সংঘর্ষে দু’টি বাসের দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া থেকেই বিষয়টি আঁচ করা যায়। কিন্তু দোষী চালককে এজন্য তেমন কোনো শাস্তি পেতে হয় না। কারো শাস্তি হলে হরতাল ধর্মঘট ডেকে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা জিম্মিদশা সৃষ্টি করে। সত্যি বলতে কি নানাভাবেই পরিবহন সেক্টরের কাছে মানুষজন জিম্মি। এই দশা যে কবে কাটবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

সুষ্ঠু ও নির্বিঘœ যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য সমন্বিত ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা জরুরি। দুর্ঘটনা রোধে চালক ও পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যানবাহনের উচ্চগতি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যাবে না। ফুটপাথগুলো দখলমুক্ত করে পথচারী চলার উপযোগী করতে হবে। তুলে দিতে হবে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন। রাস্তা চলাচলে আইন অমান্যের জন্য আরও কঠিন শাস্তি ও জরিমানা আদায় করতে হবে। তাছাড়া রাস্তায় যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং, ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, একই রাস্তায় নছিমন-করিমনসহ বিভিন্ন গতির যানবাহন চলাচল, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি, চালকের মাদকাসক্তি ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু ও সমন্বিত পদক্ষেপে দেশ দুর্ঘটনামুক্ত হবে এ প্রত্যাশা সকলের। দেশের মানুষ সড়কে নিরাপত্তা চায়। তারা এ ধরনের করুণ মৃত্যু ও কান্না আর দেখতে চায় না।

 

কাজে আসছে না কোনো পরিকল্পনা

 

সড়ক দুর্ঘটনা অপ্রত্যাশিত হলেও আমাদের দেশে তা নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে দুর্ঘটনা। দীর্ঘ হচ্ছে সড়কে লাশের মিছিল। চলতি বছরের শুধু দুই মাসেই প্রায় ৩শ’ মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতিবছর প্রায় ৭ হাজার ৫শ’ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।

 

মৃত্যু মানুষের স্বাভাবিক নিয়তি। তাই বলে যদি এমন হয়, কোনো দুর্ঘটনার ফলে নিমিষেই ঝরে যাচ্ছে একেকটি প্রাণ, তবে তা সত্যিই বেদনাদায়ক এবং একই সঙ্গে উদ্বেগের। কেননা সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, একের পর এক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই। অথচ যা সতর্কতা অবলম্বন ও যথাযথ আইন মান্য করলে অনেকটাই এড়ানো সম্ভব। আমরা তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, বিভিন্ন পেশার কৃতী সন্তানসহ অনেক মানুষকে হারিয়েছি শুধু দুর্ঘটনার কারণে, এটা আমাদের জাতি হিসেবেও দুর্ভাগ্যের। যে ক্ষতি একবার হয়ে গেছে তা আর শুধরানোর কোনো সুযোগ নেই, সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য। ফলে দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যরোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না।

সম্প্রতি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে দুর্ঘটনায় মৃত্যুসংক্রান্ত যে চিত্র উঠে এসেছে, তা রীতিমতো উৎকণ্ঠাজনক। দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায়ই শুধু গড়ে ৫৫ জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে গেল বছর জানিয়েছে পরিবেশবাদী সংস্থা পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসোসিয়েশন (বিএইচএ)।

 

সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটা সত্য, বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থা অনেকাংশেই উন্নত হয়েছে। একটি দেশে যখন প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ৫৫ জন মানুষ মারা যাচ্ছে তখন তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা স্বাভাবিক ঘটনা বলারও কোনো সুযোগ নেই। গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাবে দেশে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন লোক মারা গেছে যার বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই চালকদের ভুলের কারণে ঘটছে। একই সঙ্গে অবৈধ লাইসেন্স বাণিজ্যরও যে খবর জানা যায় তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আরো পরিতাপের যে যখন একের পর এক দুর্ঘটনার কবলে মানুষ মারা যাচ্ছে তখনো অদক্ষ চালকরা লাইসেন্স পাচ্ছে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে এবং আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা তার দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে ১শ’ ৪৪টি ব্লাকস্পট নির্ধারণ করে তা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কয়েকটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানও সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো ঔষধেই দুর্ঘটনার নিরাময়ক হচ্ছে না। অদক্ষ ড্রাইভার, সড়কের ত্রুটি, দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়া, ওভারটেকিং আর লাইসেন্সবিহীন পরিবহনই সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

১৯৯৩ সালে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর থেকে তিনিই প্রথম দেশে ব্যাপকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করছেন। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা)।

 

নিসচা এর তথ্য মতে, প্রতি বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় প্রায় ৭ হাজার মানুষ। এ হিসেবে গত ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ১৭ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে লক্ষাধিক মানুষ। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)-এর জরিপ অনুযায়ী, বছরে কমপক্ষে ১২ হাজার ৮শ’ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৯ সালের প্রতিবেদনে অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে মারা যায় ২০ হাজার ২৩ জন। তবে পুলিশের হিসাবে ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ২ হাজার ২শ’ ৪১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। মারা যায় ২ হাজার ১৪০ জন। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৩শ’ জন নিহত ও ৩০ হাজার মানুষ আহত হয়। ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশে মোট ৪০ হাজার ৯শ’ ২৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় নিহত হয় ৩২ হাজার ২শ’ ৬১ জন। আর আহত হয় ২৯ হাজার ৬শ’ ৭৯ জন।

 

বিশ্বে প্রতিবছর ১ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ সংখ্যা আরো বেশি। বাংলাদেশে এর পরিমাণ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিভিন্ন দুর্ঘটনার মাঝে ১৯৯০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দিক দিয়ে বাংলাদেশ ৯ম স্থানে ছিল তা ২০২০ সালে ৩য় স্থানে এসে দাঁড়াতে পারে।

ঢাকা সিটি করপোরেশন যানবাহন সমন্বয় বোর্ড (ডিটিসিবি)’র হিসাবে, ১৯৯১ সালে রাজধানীতে পথচারীরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছিল ৬৭ শতাংশ তা ২০০৮ সালে দাঁড়ায় ৮৬ শতাংশে। তার মধ্যে শহরে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা হয়ে থাকে বাস, ট্রাক ও মিনিবাসের কারণে।

 

নিসচা-এর তথ্য মতে, ২০১৪ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৬ হাজার ৫৮২ জন। জানুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৬৪টি। এতে নিহত ৪২৫, আহত ৬৪৬ জন। ফেব্রুয়ারিতে ১৯১টি দুর্ঘটনায় নিহত ৪৪৭, আহত ৯১৫ জন। মার্চে ২১৪টি দুর্ঘটনায় ৪৯৭ জন নিহতসহ ৯৮৪ জন আহত হন। এপ্রিলে ২৬টি দুর্ঘটনায় ৩৬৫ জন নিহতসহ আহত হয়েছে ৭৯৩ জন। মে মাসে ২৬১টি দুর্ঘটনায় ৪৫৭ জন নিহত ও ১ হাজার ৬২ জন আহত হয়। জুন মাসে ২৪৭টি দুর্ঘটনায় ৩১৬ জন নিহতসহ ৯৬৯ জন আহত হয়। জুলাইয়ে ২০৭টি দুর্ঘটনায় ৪৩৫ জন নিহতসহ আহত হয় ১ হাজার ২৪০ জন। আগস্টে দুর্ঘটনা ঘটে ২৫৬টি। ৩৮৪ জন নিহত ও আহত হয় ১ হাজার ১০৮ জন। সেপ্টেম্বরে ২৪৩টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ২৭৮ জন নিহত ও ৫৯৯ জন আহত হয়। অক্টোবরে ২২৪টি দুর্ঘটনায় ৩৯৮ নিহত ও ১ হাজার ২৪ জন আহত হয়। নভেম্বরে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২০৪টি। নিহতের সংখ্যা ২৫৩ ও আহত ৫৭১ জন। ডিসেম্বরে ১৯৬টি দুর্ঘটনায় ২৮১ জন নিহতসহ ৮৫৯ জন আহত হন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবার পর মারা যায় ১ হাজার ৭৭ জন। আর হাসপাতাল ছেড়ে যাবার পর মারা যায় ৯৬৯ জন।

সড়ক দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ এম, মনিরুজ্জামান ও রাকিব মিত্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত দেশে ২৩ হাজার ২৭৩টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসময় ১৭ হাজার ৮৪ জন নিহতসহ আহত হয়েছে ১৯ হাজার ৮৪১জন। একই সময় শুধু ঢাকা শহরেই ৫ হাজার ১৬৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসময় নিহত হন ২১০জন আর আহত হয় ৩ হাজার ৯২৩জন। বাংলাদেশ পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার প্রাণ বিনাশ হয় আর আহত হন প্রায় ৫ হাজার।

সম্প্রতি ‘সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়’ থেকে ঝুকিপূর্ণ ১৪৪টি ব্লাক স্পট নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব স্পট সংস্কারের জন্য একটি প্রকল্পের অধীনে ১৬৫ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ১২৬টি দুর্ঘটনা প্রবণ বাঁক চিহ্নিত করে এবং নতুন করে ১৮টি বাঁক প্রকল্পে যুক্ত করা হয়। একই প্রকল্পের আওতায় পথচারীদের ক্রসিংয়ের উন্নয়ন, মহাসড়কগুলোকে নিরাপদ করতে ইন্টারসেকশন উন্নয়ন, বাঁক সরলীকরণ, ঝুঁকিপূর্ণ স্থান সংস্কার, সিগন্যালিং, রোড মার্কিং স্থাপন, সাইন সিগন্যাল, দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করা হবে। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের মধ্যে এ কাজ সমাপ্ত হবার কথা রয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্ঘটনার সময়ে প্রায় ৫৪ শতাংশ গাড়ির গতি ছিল অতিরিক্ত। মোটরযান আইনে গতিসীমা নির্ধারিত হলেও তা প্রায় কেউই মানে না। মোটরযান আইন অনুযায়ী মহাসড়কে বাস, কোচ ও পিকআপের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার। ভারী ট্রাক, লরির গতিবেগ ৫০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও অন্যান্য ভারী যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার। মোটর ভেহিকেল অর্ডিন্যান্স-১৯৮৩ অনুযায়ী চালককে লাইসেন্স দেয়ার পূর্বে মহাসড়কে ৩৫ মিনিট গাড়ি চালানোর পরীক্ষা ও তাত্তি¦ক পরীক্ষা নেয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এর পেশাদার লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই হয় অর্থের বিনিময়ে। ফলে যথাযথ পরীক্ষা না দিয়ে লাইসেন্স পাওয়া ড্রাইভার মহাসড়কে গাড়ি চালাতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটার ঝুকি বেশি। অন্যদিকে, বিআরটিএ এর হিসাবেই লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা ৮ লাখ। বিআরটিএ এর তথ্য মতে, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা ২১ লাখ। এর বিপরীতে বৈধ চালকের সংখ্যা ১৩ লাখ। কিন্তু যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, বৈধ ও অবৈধ মিলে দেশে প্রায় ৪০ লাখ মোটরযান রয়েছে। ওই হিসেবে প্রায় ২৭ লাখ পরিবহন চলছে লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার দিয়ে। সমিতির ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪০ লাখ যানবাহনের মধ্যে প্রায় ১৮ লাখ যানবাহনের বৈধ কাগজপত্র নেই। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রবাবে এসব অবৈধ যান রাস্তায় চলাচল করছে।

বিআরটিএ এর তথ্য মতে, রাজধানীতে মোটরসাইকেল বাদে যানবাহন রয়েছে ৫ লাখের বেশি। বিশাল সংখ্যাক এই পরিবহনের ফিটনেস পরীক্ষার জন্য মাত্র ১ জন উপ-পরিচালক ১১ জন কর্মকর্তা নিয়ে কাজ করছেন। ফলে প্রকৃতপক্ষে ফিটনেস যাচাই করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া অর্থের বিনিময়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়ার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধের দায়িত্ব কার? এর উত্তর হল, এর দায় একক কোনো সংগঠনের নয়। সড়ক দুর্ঘটনা একক কারণে নয়, তেমনি দুর্ঘটনা রোধ করার দায়িত্বও একক কোনো কর্তৃপক্ষের নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় সড়কের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকগুলো মন্ত্রণালয় রয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কিন্তু সেতুমন্ত্রীর একার নয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সাধারণ মানুষ, সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, সংগঠন, সবারই দায়িত্ব রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব সরকারের।

 

আমরা আশা করি, সরকার সব ঘটনা বিচক্ষণতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করে এমন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুক, যেন চালকের সতর্কতা নিশ্চিত হয় এবং সড়ক পথের যাবতীয় অনিয়মগুলো দূর হয়। যা দেশের দুর্ঘটনায় মৃত্যুরোধে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। সড়ক দুর্ঘটনাকে একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক ভিত্তিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে দুর্ঘটনার পরিমান কমতে পারে বলে আমরা মনে করি। সরকার সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হবেন এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।

বিশেষ প্রতিবেদক