ইসলাম
  আশুরার মর্মকথা ঃ করণীয় ও বর্জনীয় আমল সমূহ
  28-07-2023

আশুরা আরবী শব্দ। আশারাতুন থেকে নির্গত হয়েছে যার অর্থ দশ। আশুরা অর্থ দশ বা দশম। আক্ষরিক অর্থে যে কোন মাসের দশ তারিখকেই আশুরা বলা যায়। কিন্তু ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় কেবলমাত্র মুহাররম মাসের দশ তারিখকেই আশুরা বলা হয়।
ইসলাম ধর্মে এই দিবসটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এই দিনে ইসলামের অনেক ঐতিহাসিক ও তাৎপর্য পূর্ণ ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছে।
যেমনঃ হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে যে, (একদা) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াহুদীদের কতিপয় এমন লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন, যারা আশুরার দিনে রোযা রেখেছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন “এটা কিসের রোযা?” উত্তরে তারা বলল, “এই দিনে আল্লাহ তা‘আলা হযরত মূসা আ. ও বনী ইসরাঈলকে ডুবে যাওয়া থেকে উদ্ধার করেছিলেন। (অন্য বর্ণনায় আছে ফিরআউনের নির্যাতন থেকে মুক্ত করেছিলেন।) এবং ফিরআউনকে দল-বল সহ নিমজ্জিত করেছিলেন। আর এই দিনেই হযরত নূহ আ.- এর কিশতী জূদী পর্বতে স্থির হয়েছিল। ফলে এই দিনে হযরত নূহ আ. ও হযরত মূসা আ. কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রোযা রেখেছিলেন। তাই আমরাও এই দিনে রোযা রাখি।” তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “মূসা আ.-এর অনুসরণের ব্যাপারে এবং এই দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশী হক্বদার।” অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিন (আশুরার দিন) রোযা রাখেন এবং সাহাবাদেরকেও রোযা রাখতে আদেশ করেন।
(বুখারীঃ হাঃ নং ২০০৪, মুসলিমঃ হাঃ নং ১১৩০, মুসনাদে আহমাদ হাঃ নং-৩৬০)
ফযীলত
১. হযরত আবূ কাতাদাহ রাযি.থেকে বর্ণিত যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আমি আশাবাদী যে, আশুরার দিনের রোযার উসীলায় আল্লাহ তা‘আলা অতীতের এক বৎসরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।” (তিরমিযীঃ হাঃনং ৭৫১)
২. হযরত আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত অপর হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “রমাযানের রোযার পর মুহাররম মাসের রোযা সর্বোত্তম।” (মুসলিমঃ হাঃ নং ১১৬৩)
করণীয়
১. আশুরার দিনে রোযা রাখা। তবে এর সাথে ৯ তারিখ বা ১১ তারিখ মিলিয়ে রাখা। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “তোমরা আশুরার দিনে রোযা রাখ। তবে এ ক্ষেত্রে ইয়াহুদীদের থেকে ভিন্নতা অবলম্বন করতঃ তোমরা আশুরার পূর্বে অথবা পরের একদিন সহ রোযা রাখবে।” (মুসনাদে আহমাদ-হাঃ নং ২৪১)
২. এই দিন বেশী বেশী তাওবা-ইস্তিগফার করা। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুহাররম হলো আল্লাহ তা‘আলার (নিকট একটি মর্যাদাবান) মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতীতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন। (তিরমিযীঃ নং ৭৪১)
৩. দীনের খাতিরে এই দিনে হযরত হুসাইন রাযি. যে ত্যাগ-তিতিক্ষা প্রদর্শন করেছেন তা থেকে সকল মুসলমানের দীনের জন্য যে কোন ধরনের ত্যাগ ও কুরবানী পেশ করার শিক্ষা গ্রহণ করা।
৪.আশুরার দিনে যথাসাধ্য ভালো খাবার খাওয়াঃ
হযরত আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সা: থেকে বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারে প্রশস্ততা প্রদর্শন করবে, সে সারা বছর প্রশস্ততায় থাকবে।’ (তাবরানি, মুজামে কবির : ১০০০৭, বায়হাকি : ৩৭৯৫)
বর্জনীয়
১. তা’যিয়া বানানো অর্থাৎ, হযরত হুসাইন রাযি. এর নকল কবর বানানো। এটা বস্তুত এক ধরণের ফাসেকী শিরকী কাজ। কারণ মূর্খ লোকেরা ‘হযরত হুসাইন রাযি. এতে সমাসীন হন’ এই বিশ্বাসে এর পাদদেশে নযর-নিয়ায পেশ করে, এর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ায়, এর দিকে পিঠ প্রদর্শন করাকে বেয়াদবী মনে করে, তা’যিয়ার দর্শনকে ‘যিয়ারত’ বলে আখ্যা দেয় এবং এতে নানা রকমের পতাকা ও ব্যানার টাঙ্গিয়ে মিছিল করে; যা সম্পূর্ণ নাজায়িয ও হারাম। এছাড়াও আরো বহুবিধ কুপ্রথা ও গর্হিত কাজের সমষ্টি হচ্ছে এ তা’যিয়া। (ইমদাদুল ফাতাওয়াঃ ৫/২৯৪,৩৩৫, কিফায়াতুল মুফতীঃ ৯/৩২, ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়াঃ ২/৩৪৩)
স্মর্তব্য: তা’যিয়ার সামনে যে সমস্ত নযর-নিয়ায পেশ করা হয় তা গাইরুল্লাহর নামে উৎসর্গ করা হয় বিধায় তা খাওয়া হারাম। (সূরায়ে মা ইদাহঃ ৩)
২. মর্সিয়া বা শোকগাঁথা পাঠ করা, এর জন্য মজলিস করা এবং তাতে অংশগ্রহণ করা সবই নাজায়িয। (ইমদাদুল ফাতাওয়াঃ ৫/২৯৪, কিফায়াতুল মুফতীঃ ৯/৩২, ৪২)
৩. ‘হায় হুসেন’, ‘হায় আলী’ ইত্যাদি বলে বলে বিলাপ ও মাতম করা এবং ছুরি মেরে নিজের বুক ও পিঠ থেকে রক্ত বের করা। এগুলো করনেওয়ালা, দর্শক ও শ্রোতা উভয়ের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন।
(আবূ দাউদ, হাঃ নং ৩১২, ইবনে মাজাহঃ হাঃ নং ১৫৮৪)
৪. কারবালার শহীদগণ পিপাসার্ত অবস্থায় শাহাদতবরণ করেছেন তাই তাদের পিপাসা নিবারণের জন্য বা অন্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে এই দিনে লোকদেরকে পানি ও শরবত পান করানো। (ইমদাদুল ফাতাওয়াঃ ৫/২৮৯, কিফায়াতুল মুফতীঃ ৯/৪০)
৫. হযরত হুসাইন রাযি. ও তাঁর স্বজনদের উদ্দেশ্যে ঈছালে সাওয়াবের জন্য বিশেষ করে এই দিনে খিচুড়ি পাকিয়ে তা আত্মীয়-স্বজন ও গরীব মিসকীনকে খাওয়ানো ও বিলানো। একে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ যেহেতু নানাবিধ কু-প্রথায় জড়িয়ে পড়েছে তাই তাও নিষিদ্ধ ও না-জায়িয। (কিফায়াতুল মুফতীঃ ৯/৪০)
৬. হযরত হুসাইন রাযি.-এর নামে ছোট বাচ্চাদেরকে ভিক্ষুক বানিয়ে ভিক্ষা করানো। এটা করিয়ে মনে করা যে, ঐ বাচ্চা দীর্ঘায়ু হবে। এটাও মুহাররম বিষয়ক কু-প্রথা ও বিদ‘আত। (ইসলাহুর রুসূম)
৭. তা’যিয়ার সাথে ঢাক-ঢোল ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজানো।(সূরায়ে লুকমানঃ ৬)
৮. আশুরার দিনে শোক পালন করা; চাই তা যে কোন সূরতেই হোক। কারণ শরীয়ত শুধুমাত্র স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রীর জন্য ৪ মাস ১০ দিন আর বিধবা গর্ভবতীর জন্য সন্তান প্রসব পর্যন্ত এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুতে সর্বোচ্চ ৩ দিন শোক পালনের অনুমতি দিয়েছে। এই সময়ের পর শোক পালন করা জায়িয নেই। আর উল্লেখিত শোক পালন এগুলোর কোনটার মধ্যে পড়ে না। (বুখারীঃ হাঃ নং ৫৩৩৪, ৫৩৩৫, ৫৩৩৬, ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়াঃ ২/৩৪৪)
উল্লেখ্য যে শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত শোক পালনের অর্থ হলো শুধুমাত্র সাজ সজ্জা বর্জন করা। শোক পালনের নাম যাচ্ছেতাই করার অনুমতি শরী‘আতে নেই। (দুররে মুখতারঃ২/৫৩০)
৯. শোক প্রকাশ করার জন্য কালো ও সবুজ রঙের বিশেষ পোশাক পরিধান করা। (ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়াঃ ২/৩৪৪)
১০. এই দিনের গুরুত্ব ও ফযীলত বয়ান করার জন্য মিথ্যা ও জা‘ল হাদীস বর্ণনা করা। কারণ হাদীসে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীকে জাহান্নামে ঠিকানা বানিয়ে নিতে বলা হয়েছে। (বুখারীঃ হাঃ নং ১০৭)
এখানে আশুরার দিনের নিন্দিত ও গর্হিত কাজসমূহের কিছু নমুনা পেশ করা হলো মাত্র। মূলকথা, ‘করনীয়’ শিরোনামের অধীনে উল্লেখিত ৪টি আমল ব্যতীত এই দিনে আর কোন বিশেষ আমলের কথা শরী‘আতে প্রমাণিত নেই। তাই এই ব্যতীত আশুরাকে কেন্দ্র করে বিশেষ যে কোন কাজই করা হবে তা বিদ‘আত ও মনগড়া আমল হবে।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে শিরক, বিদ‘আত ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকার তাওফীক দান করুন।
লেখক: সহকারী সম্পাদক মানবাধিকার খবর ও মহাপরিচালক, দারুল উলূম বাংলাদেশ।