সারাদেশ
  শিকলে বাঁধা তিন যুগ
  22-02-2022

স্ত্রী নেই ঘরে । কেও দেখাশুনা করেনা। বাড়ির উঠানের এক পাশে মাটির ঘর। নেই দরজা জানালা। ঘরের এক কোনে রয়েছে ভাঙ্গা চৌকি। পাশেই পোঁতা রয়েছে কাঠের খুঁটি। চৌকির ওপর বসে থাকা বৃদ্ধকে কোমরে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে খুঁটির সঙ্গে। শোয়া বসার জায়গা নেই। ৩৬ বছর ধরে অন্ধকার ঘরে শিকলে বাঁধা ৬০ বছর বয়সী সাফাজউদ্দিনের জীবন। শিকলবন্দি সাফাজউদ্দিন মোল্লা গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের মূলাইদ গ্রামের মৃত রজব আলী মোল্লার ছেলে। শিকলে বাঁধা অন্ধকার ঘরে এভাবেই কেটে গেল জীবনের বিশেষ সময়টুকু। প্রায় ৩৬ বছর ধরে শিকল বন্দি হয়ে অন্ধকার ঘরে অমানবিক পরিবেশে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। অল্প বয়সে অসুস্থ হওয়ায় তার জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র পর্যন্ত তৈরি করা হয়নি।
সরেজমিনে বিগত ১১ ডিসেম্বর, (শনিবার ) সকালে গিয়ে দেখা যায় মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন মুলাইদ গ্রামে মোল্লা বাড়ির উঠানের এক পাশে রয়েছে মাটির ঘর। বাহির থেকে চট দিয়ে দু’টি জানালা একটি দরজা বন্ধ করে রাখা হয়েছে । ঘরের ভেতরটা ঘুট-ঘুটে অন্ধকার। সূর্যের আলো ঘরে ঢুকতে পারে না। ঘরে নেই বৈদ্যুতিক বাতি। ঘরের এক পাশে রয়েছে বাড়ির পরিত্যক্ত বস্তু। অন্য পাশে রয়েছে একটি ভাঙ্গা জরাজীর্ণ চৌকী। চৌকির এক কোনে রয়েছে ময়লাযুক্ত ছেড়া বালিশ। এতে মাথার স্পর্শ লাগেনি হয়তো বহু বছর। খাবারের জন্য পাশে রয়েছে অপরিষ্কার পাত্রে কিছু ভাত। পানি রাখা হয়েছে রংয়ের পটে । ভাঙ্গা চৌকির এক কোনে যবু-থবু হয়ে নির্বাক বসে আছেন সাফাজউদ্দিন। ঘরে ঢুকতেই ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকেন তিনি ।
মোল্লাবাড়িতে গিয়ে কথা হয় সাফাজ উদ্দিনের বড় ভাই আফাজ উদ্দিন মোল্লার সাথে। তিনি জানান, তারা ৫ ভাই ৪বোন। আফাজউদ্দিন মৃত রজব আলীর প্রথম স্ত্রীর সন্তান। মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা ছায়তুন নেছাকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎ মায়ের গর্ভে জন্ম নেয় সাফাজুদ্দিন সহ ৪ ভাই ৪ বোন। সকল ভাই বোনদের মধ্যে সাফাজুদ্দিন দ্বিতীয়। তিনি আরও বলেন,সাফাজুদ্দিনের মাথায় জটা ছিল। বিয়ের পর তার স্ত্রী কৌশলে চুলের জটা কেটে ফেলে। এরপর থেকেই সে অস্বাভাবিক হয়ে পরে। এরই মধ্যে তার মেয়ে ঝর্ণা আক্তারের জন্ম হয়। কিছুদিন পর অসুস্থ্য স্বামীকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করেন সাফাজ উদ্দিনের স্ত্রী। প্রায় তিন যুগ ধরে শিকল বন্দি আছে সাফাজ উদ্দিন। সাফাজ উদ্দিনের এক মাত্র মেয়ে ঝর্ণা আক্তার । মামাদের আশ্রয়ে লালিত-পালিত ঝর্ণা আক্তার। লালন পালন করে মামারা ভালো ছেলের সাথে বিয়েদেন তাকে। ছোট বেলা থেকেই দেখছেন তার বাবা শিকলবন্দি। যখন বুঝতে শিখেছেন তখন জানতে পারেন তার বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। কখনো বাবার চিকিৎসা হয়েছে কিনা তাও তার জানা নেই। বহু বছর ধরে বাবা বিনা চিকিৎসায় পরে আছে অন্ধকার ঘরে। বাবা অসুস্থ্য হওয়ায় তার জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয় পত্র হয়নি। এনিয়ে তিনি নানা বিরম্বনায় আছেন। মেয়েটি আরও জানান , তার স্বামী ইট ভাটার লড়ি চালক। স্বামীর সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালানোর পর বাবার ভরণ পোষণ দিতে পারেন না। বাবার মালিকানার জমি ভোগ দখল করতে পারছেন না। বিক্রিও করতে পারছেন না। বিনা চিকিৎসায় ধূকছে তার বাবা। বাবার এমন দূর্ভোগের জীবন দেখে শুধুই চোখের জল ফেলেন তিনি। প্রায় ৩ যুগ ধরে তার বাবা শিকল বন্দি হয়ে অন্ধকার ঘরে অমানবিক পরিবেশে দিন কাটাচ্ছে। ভাঙ্গা চৌকিতে তার দিন কাটে বসে থেকে। সামান্য শোবার মতো এতটুকু জায়গাও নেই তার। ঝর্ণা তার বাবার পাশে দাঁড়াতে হৃদয়বানদের সাহায়তা কামনা করেন।
সাফাজ উদ্দিনের বৃদ্ধা মা ছায়তুন নেছা জানান, তার স্ত্রী নেই। কেও দেখাশুনা করেনা। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ছেলেকে ফেলে দিতে পারেন না। এ ভাবেই যুগ যুগ ধরে বেধে রেখে ভরণ পোষণ দিচ্ছেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মোবারক হোসেন জানান, সাফাজ উদ্দিন আমার অতি পরিচিত আতœীয়। বহু বছর ধরে সে অসুস্থ্য । তার একটি মেয়ে আছে। সাফাজ উদ্দিনের জন্য উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন।
শ্রীপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো.মনজুরুল ইসলাম বলেন, আপনাদের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারলাম । আমি সরেজমিনে খবর নিয়ে এ ব্যাপারে দ্রæত যথাযথ ব্যবস্থা নিবো।