প্রবন্ধ
  বন্ধ হোক ক্রসফায়ারের গল্প
  01-09-2020

 

সিনহা রাশেদ খানের যে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে, সেটির দিকে যতবার তাকিয়েছি ততবারই মন খারাপ হয়ে গেছে। ছবিটি এক স্মার্ট, সুদর্শন যুবকের। চেহারায় যে শার্পনেস, তা নজর কাড়বে যে কারও। মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন্তান সিনহা রাশেদ খান ২০১৮ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই মেজর হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যান। অবসরের জন্য ৩৪ কোনো বয়স নয়। সিনহা আসলে অবসর নয়, শুরু করতে চাচ্ছিলেন জীবনের নতুন এক অধ্যায়। তার ইচ্ছা ছিল বিশ্বভ্রমণের। চাকরি ছেড়ে সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছিলেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় সিনহা।

করোনাভাইরাস না এলে বোধহয় সিনহা এখন ল্যাটিন আমেরিকার কোনো দেশে থাকতেন। মেজর (অব.) সিনহা আমাদের মতো ছাপোষা জীবন চাইতেন না। বিয়ে থা করেননি- জীবনটাকে উল্টেপাল্টে উপভোগ করবেন বলে, ঘুরে ঘুরে দেখতে চেয়েছিলেন সৃষ্টির বিস্ময়, প্রকৃতির সৌন্দর্য। করোনা তাকে বিশ্ব ভ্রমণে যেতে না দিলেও খুব বেশি দিন ঘরে আটকেও রাখতে পারেনি।

‘জাস্ট গো’ নামে ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ডকুমেন্টারির শুটিং করতে গত ৩ জুলাই কক্সবাজারে যান। সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের তিন শিক্ষার্থী। হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টে ছিলেন তারা। ৩১ জুলাই টেকনাফের পাহাড়ে রাতের শুটিং শেষে ফেরার সময় এলাকাবাসীর সন্দেহ হয়। তারা পুলিশকে ডাকাত সন্দেহের কথা জানায়। ফেরার পথে প্রথমে একটি বিজিবি ক্যাম্প তাদের গাড়ি আটকালেও পরিচয় পেয়ে ছেড়ে দেয়। পরে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে তাদের গাড়িটি আটকানো হয়। সেখানেই পুলিশের গুলিতে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে একটি অপরিসীম সম্ভাবনার ইতি ঘটে। কীভাবে মারা গেলেন সিনহা রাশেদ খান? কী ঘটেছিল সেখানে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে

তারা নিশ্চয়ই সত্যটা তুলে আনবেন। আপাতত আমরা পুলিশের বক্তব্যকেই সত্য হিসেবে ধরে নিচ্ছি। ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ জানিয়েছে, ওই সাবেক সেনা কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে অন্য একজন সঙ্গীসহ টেকনাফ থেকে কক্সবাজার আসছিলেন। মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া তল্লাশি চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন। এ নিয়ে তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা তার কাছে থাকা পিস্তল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা রাশেদ গুরুতর আহত হন। তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। আমি আপাতত তর্কের খাতিরে পুলিশের এ গল্প বিশ্বাস করছি।

তবে বিশ্বাস করি আর না করি, ক্রসফায়ারের ব্যাপারে র‌্যাব-পুলিশের পাঠানো গল্প আমাদের মেনে নিতে হয়। মাঝেমধ্যে দু-একটা ঘটনা আলোড়ন তোলে বটে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা পুলিশের এ বানানো গল্পটি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিই। একই গল্প। কোনো সৃষ্টিশীলতা নেই। বারবার পুলিশের আত্মরক্ষার অধিকারকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই যদি নিজেকে রক্ষা করতে আরেকজনকে মেরেই ফেলতে হয় তাহলে তো পুলিশের দক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। হাতে অস্ত্র আছে বলেই নিরস্ত্র কাউকে মেরে ফেলায় কোনো বীরত্ব নেই, এটা কাপুরুষের কাজ। তবে টেকনাফের শামলাপুরের ঘটনাটি অন্যসব ঘটনার মতো নয়। এখানে পুলিশকে জবাব দিতেই হবে। এ ঘটনা তদন্ত হচ্ছে। তবে পুরো ঘটনাটি একদম সহজ। মেজর (অব.) সিনহার সঙ্গে গাড়িতে সিফাত নামে একজন ছিলেন। তিনি এখনো বেঁচে আছেন।

এ ছাড়া ঘটনাস্থলে পুলিশের আরও অনেকে ছিলেন। সবাইকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই পুরো চিত্রটা পাওয়া যাবে। তখন জানা যাবে, পুলিশের বক্তব্য সত্য না মিথ্যা। ইতোমধ্যে পুলিশের বক্তব্যের পাল্টা একটি বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছাপা হচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে, মেজর (অব.) সিনহা তার লাইসেন্স করা পিস্তল গাড়িতে রেখে হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামছিলেন। নামার সঙ্গে সঙ্গেই ইন্সপেক্টর লিয়াকত তাকে ৩ রাউন্ড গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ হয়েও সিনহা অনেকক্ষণ বেঁচে ছিলেন। কিন্তু সময়মতো তাকে হাসপাতালেও নেওয়া হয়নি। একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা পুলিশের দিকে পিস্তল তাক করবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। একজন সেনা কর্মকর্তা অবশ্যই জানেন অস্ত্রের ব্যবহার কখন, কোথায়, কীভাবে করতে হয়। তার পরও আমি ধরে নিচ্ছি পুলিশের বক্তব্যই সত্য। মেজর (অব.) সিনহা পুলিশের দিকে অস্ত্র তাক করেছিলেন।

কিন্তু সন্দেহটা হলো, একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চৌকস সেনা কর্মকর্তা চাকরি জীবনে যিনি এসএসএফেও দায়িত্ব পালন করেছেন; তিনি পিস্তল তাক করতে করতে পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর তাকে ৩টি গুলি করে মেরে ফেললেন; এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। যদি সত্যি মেজর (অব.) সিনহা পিস্তল দিয়ে গুলি করতে চাইতেন, তাহলে তিনি নিজে মরার আগে আরও কয়েকজনকে মেরে যেতে পারতেন। তাও ধরে নিচ্ছি, একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরের চেয়ে একজন দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টরের রিফ্লেক্স ভালো। কিন্তু তাই বলে ইন্সপেক্টর লিয়াকত ৩টি গুলি করতে করতে সিনহা ১টি গুলিও করতে পারলেন না, এও বিশ্বাস করতে হবে? আর একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ কেন অপ্রয়োজনে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ করতে যাবেন? তার পরও আমি ধরে নিচ্ছি, পুলিশের বক্তব্যই সত্য। মেজর (অব.) সিনহা পুলিশের দিকে পিস্তল তাক করেছিলেন। কিন্তু তাই বলে তাকে একেবারে ৩টি গুলি করে মেরে ফেলতে হবে! আত্মরক্ষার অধিকার পুলিশের আছে।

কিন্তু সিনহাকে তো পিস্তল ধরা হাতে বা পায়ে গুলি করেও ধরার চেষ্টা করা যেত। এখন পর্যন্ত মেজর (অব.) সিনহার অপরাধ হলো, পুলিশের দিকে পিস্তল তাক করা। কিন্তু এটি কি মৃত্যুদন্ড যোগ্য অপরাধ? গুলি করার পর নাকি তার গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ৫০টি ইয়াবা বড়ি, কিছু গাঁজা ও ২টি বিদেশি মদের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। কোনো অভিযানে যাওয়ার আগে মদের বোতল, ইয়াবা, গাঁজা নিয়ে যাওয়ার পুলিশি কৌশল বহু পুরনো ও ক্লিশে। ঢাকার অনেক মোটরসাইকেল চালক অনেকবার পুলিশের ইয়াবা বা গাঁজা কৌশলের শিকার হয়েছেন। তার পরও আমি ধরে নিচ্ছি, পুলিশের এ দাবিও সত্যি। কিন্তু ইয়াবা, মদ বা গাঁজা বহন করা কি মৃত্যুদ-যোগ্য অপরাধ? এতক্ষণ পুলিশের বক্তব্য বিশ্বাসের কথা বললেও আমি এবং আমি জানি বাংলাদেশের কেউই ক্রসফায়ার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গল্প বিশ্বাস করেন না।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে ক্রসফায়ার এক ধরনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আর এ গ্রহণযোগ্যকতাকে পুঁজি করেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ভাষায় ‘ক্রসফায়ার’, সুশীলসমাজের ভাষায় ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড’, আসলে ঠান্ডা মাথায় নির্দোষ মানুষকে ‘খুন’ করে যাচ্ছে। ২০০৪ সালে র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটা হয়ে আসছে। বিএনপির উদ্ভাবিত ক্রসফায়ার নামের এ অপকর্মটি আওয়ামী লীগ করে যাচ্ছে অবলীলায় বছরের পর বছর ধরে। ক্রসফায়ারের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একসঙ্গে অনেক অপরাধ করে- ঠান্ডা মাথায় খুন, তারপর একটি মিথ্যা গল্প, ক্রসফায়ার জায়েজ করতে মৃত ব্যক্তির চরিত্রহনন, আর বারবার অপরাধ করতে করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভাবতে থাকে। আপনি যখন কাউকে একটা অন্যায়ের অনুমতি দেবেন, সে কিন্তু সে অনুমতি ব্যবহার করে আরও দশটা অপরাধ করবে। তখন আপনার নৈতিক অধিকার থাকবে না তাকে বারণ করার। কারণ একই ধরনের অপরাধ করার অধিকার আপনি তাকে দিয়েছেন। ওপরের অনুমতি ছাড়া পুলিশ তো নিজেদের ইচ্ছায় ক্রসফায়ার করছে না।

তাই ইন্সপেক্টর লিয়াকতরা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে থাকেন। মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যুর ঘটনায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির খবর দিচ্ছেন কেউ কেউ। এটা ঠিক, মেজর (অব.) সিনহার মতো একজন প্রাণবন্ত সহকর্মী বা বন্ধু হারালে যে কেউ ক্ষুব্ধ হবে। আমি যে কখনো তাকে দেখিনি, আমারই তো বেদনায় বুক ভেঙে যাচ্ছে। তবে একটা বিষয় মানতেই হবে, মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যু অবশ্যই বেদনাদায়ক। কিন্তু এর দায় ব্যক্তির, কোনো বাহিনীর নয়। পুলিশের বিরুদ্ধে হাজারটা অভিযোগ আছে। কিন্তু এবার করোনার সময় পুলিশ যে অসাধারণ মানবিক ভূমিকা পালন করেছে, আমি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কখনই পুলিশকে ঢালাও গালি দেব না।

এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী সিনহার মাকে ফোন করে সান্তনা দিয়েছেন, ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ একসঙ্গে কক্সবাজার গিয়েছেন। সেনাপ্রধান বলেছেন, সিনহার মৃত্যুর দায় ব্যক্তির, কোনো প্রতিষ্ঠানের নয়। আর আইজিপি বলেছেন, কোনো উসকানিতে দুই বাহিনীর সম্পর্ক নষ্ট হবে না। এ ঘটনায় সিনহার বোন নয়জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেছেন। এরই মধ্যে সাত আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। র‌্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করি সিনহা হত্যার সুষ্ঠু বিচার হবে। তবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ যেন পানি ঘোলা করতে না পারে সতর্ক থাকতে হবে সে ব্যাপারেও।

এটা ঠিক, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাংলাদেশের সরকার ও মানুষ চট করে সন্ত্রাস দমন, মাদক বন্ধ, ধর্ষণ বন্ধ করতে ক্রসফায়ারকেই অব্যর্থ উপায় হিসেবে বেছে নেয়। ক্রসফায়ারের পক্ষে তাদের হাজারটা যুক্তি আছে। সন্ত্রাসীদের ধরা হলে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। কেউ ভয়ে তাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে চায় না। আর আইনের ফাঁক গলে সন্ত্রাসীরা জামিন পেয়ে যায় বা কিছুদিন কারাভোগ করে এসে আবার দ্বিগুণ উদ্যমে সন্ত্রাস শুরু করে। মানবাধিকার নিয়ে যারা কথা বলেন, তাদের মুখ বন্ধ করতে বলা হয়, সন্ত্রাসীদের কোনো মানবাধিকার থাকতে নেই। কিন্তু যত যুক্তিই দেওয়া হোক, আমাদের মানতে হবে, বুঝতে হবে ক্রসফায়ার কখনই সমাধান নয়। সব মানুষেরই মানবাধিকার আছে, তিনি সন্ত্রাসী হোন আর ভালো মানুষ।

একজন মানুষ দোষী না নির্দোষ তা নির্ধারণ করবে আদালত, পুলিশ নয়। সবারই আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। যে দেশে বঙ্গবন্ধুর খুনি, যুদ্ধাপরাধীরা আইনের সর্বোচ্চ সুবিধা পান, ন্যায়বিচার পান সে দেশে ক্রসফায়ার চলতে পারে না। আমার বিবেচনায় ক্রসফায়ার হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সূচক। ক্রসফায়ার যত বেশি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তত খারাপ। আইনের শাসন না থাকলেই ক্রসফায়ারের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। আইনের শাসনে বিশ্বাস করলে হাজারো যুক্তিতেও আপনি ক্রসফায়ার জায়েজ করতে পারবেন না। কারণ মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। বিজ্ঞান অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে। কিন্তু মানুষের জীবন দিতে পারে না। তাই যা আপনি দিতে পারবেন না, তা নিতেও পারবেন না। আর এ কারণেই ফাঁসির আসামি আপিল, রিভিউ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা- আইনের সব ধাপে সুযোগ পান। বলাই হয়, ১০ জন দোষী ছাড়া পেয়ে যাক, তবু যেন কোনো নির্দোষ মানুষ সাজা না পায়।

সেই একই দেশে পুলিশ রাস্তায় কাউকে আটকে ইচ্ছা হলেই গুলি করে মেরে ফেলতে এবং একটি গল্প বানিয়ে সেই হত্যাকে জায়েজ করতে পারে না। তবে যে দেশে সাধারণ মানুষ ক্রসফায়ারকে সমর্থন করে, সুশীলসমাজের মানুষও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্ষককে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়ার পরামর্শ দেয় এবং যে দেশে সংসদে আইনপ্রণেতারাও ক্রসফায়ারের দাবি তোলেন; সে দেশে আইনের শাসন আশা করা কঠিন। বাংলাদেশে সব ঘটনায় সবাই যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হয়, আমিও তেমনি হচ্ছি। আমি জানি একমাত্র শেখ হাসিনা চাইলে এবং তিনি নির্দেশ দিলেই ক্রসফায়ারের নামে এ হত্যা বন্ধ হবে। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা চাইলেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ক্রসফায়ারে দিতে পারতেন।

কিন্তু তিনি প্রতিশোধ নেননি, এমনকি দ্রæত বিচারও করেননি; আইনের স্বাভাবিক গতিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন। খুনিদের বিচার করতে তাঁকে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা যদি ন্যায়বিচার পেতে পারেন, দেশের প্রতিটি মানুষ তা পাবে না কেন? সন্ত্রাসী হোক, মাদক ব্যবসায়ী হোক, ধর্ষক হোক; পুলিশের দায়িত্ব হলো তাকে আইনের আওতায় আনা এবং সুষ্ঠু তদন্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। পুলিশই যদি তৎক্ষণাৎ গ্রেফতারকারী, তদন্তকারী, বিচারকারী এবং রায় বাস্তবায়নকারী হয়ে যায় তাহলে আর আইন-আদালত, বিচার, তদন্ত এসবের দরকার কী? আমার মনে আছে, শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা থাকার সময় ক্রসফায়ারের বিরোধিতা করেছিলেন। তখন দলের লোকেরাই বলেছেন, ক্রসফায়ার পাবলিক খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। এর বিরোধিতা না করাই ভালো।

শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, মানুষ গ্রহণ করলেও খারাপ খারাপই। তাই তিনি জনমতের বিপক্ষে যাবে জেনেও ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। আমি জানি, শেখ হাসিনা বরাবরই ক্রসফায়ারের বিপক্ষে, আইনের শাসনের পক্ষে। তিনি নিশ্চয়ই সেই নৈতিক নির্দেশনাটা দেবেন তাঁর বাহিনীকে। আর এ নির্দেশনাই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নৈতিকভাবে আরও অনেক শক্তিশালী করবে। টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুলের কন্যার কান্না- ‘আব্বু তুমি কান্না করতেছ যে’ সারা দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছিল। ভেবেছিলাম তখনই ক্রসফায়ার বন্ধ হবে। হয়নি। তবে এবার মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যু আবার কাঁদিয়েছে সবাইকে। প্রার্থনা- মেজর (অব.) সিনহাই যেন বাংলাদেশে বিনা বিচারে হত্যার সর্বশেষ ব্যক্তি হন। আমরা চাই সন্ত্রাস, মাদক, ধর্ষণের ব্যাপারে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকুক; কিন্তু কোনোভাবেই ক্রসফায়ার চাই না।
লেখক : সাংবাদিক