বিশেষ প্রতিবেদন
  সুস্থ্য ও শৃঙ্খল জীবনের পথ দেখায় কোয়ান্টাম মেথড
  14-09-2019

সৈয়দ সফি :
সুস্থ্য ও শৃঙ্খল জীবনের পথ দেখায় কোয়ান্টাম মেথড। আত্মশক্তির জাগরণ ঘটিয়ে মেধা, প্রতিভা ও বিশুদ্ধ সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে নিজেকে অনন্য মানুষে রূপান্তরিত করাই এর লক্ষ্য। আর নিজের মেধাকে সমবেত ও সমন্বিতভাবে মানবতা ও সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত করে বিশ্বকে মানবিক মহাসমাজে রূপান্তরিত করাই কোয়ান্টামের স্বপ্ন। সুস্থ্য দেহ সুন্দর মন, কর্মব্যস্ত সুখী জীবন। এমন জীবন সবারই কাম্য। মানুষ তার কর্মের মাধ্যমেই জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে।
কিভাবে সুন্দর জীবন গড়ে তোলা যায় সে সম্পর্কে চমৎকারভাবে ধারণা পাওয়া যাবে কোয়ান্টাম মেথডে। কোয়ান্টাম মেথড সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো।

কোয়ান্টাম মেথড :
কোয়ান্টাম মেথড জীবন যাপনের বিজ্ঞান। এ বিজ্ঞান জীবনকে বদলে দেয়ার, জীবনে ভালো রাখার। শুরু হয় জীবনদৃষ্টি বদলের মধ্য দিয়ে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি মস্তিষ্কের নিউরোনে নতুন ডেনড্রাইট সৃষ্টি করে, সূচিত হয় নিউরোনে নতুন সংযোগায়ন প্রক্রিয়া। ফলে মস্তিষ্ক বদলে যায় ইতিবাচকভাবে। আর এর প্রভাব পড়ে ব্যক্তির আচরণ ও দৈনন্দিন প্রতিটি কাজে। অশান্তি পরিণত হয় প্রশান্তিতে। রোগ সুস্থতায় আর ব্যর্থতা সাফল্যে। তিনি লাভ করেন সুস্থ দেহ, প্রশান্ত মন, কর্মব্যস্ত সুখীজীবন।
প্রাচ্যের সাধনা আর আধুনিক বিজ্ঞানের নির্যাসে সঞ্জীবিত কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন প্রক্রিয়া। সাধকদের সাধনা ও মনোবিজ্ঞানের প্রক্রিয়ার সমন্বয়ের ফলে সহজে মেডিটেটিভ লেভেলে পৌছে আত্মনিমগ্ন হওয়া যায়। গভীর আত্মনিমগ্নতা আত্মশক্তির জাগরণ ঘটায় ভেতর থেকেই। আর অন্তরের জাগরণ বদলে দেয় জীবনের বাকি সবকিছু। সৃষ্টির সেবায় স্ব-অর্থায়নেই যেকোনো কাজ করা সম্ভব। এক যুগ নিরলস পরিশ্রমে কোয়ান্টাম গড়ে তুলেছে রক্তদাতাদের সবচেয়ে বড় ডোনার পুল ও আধুনিক ল্যাব, রক্ত দিয়ে বাঁচাতে সাহায্য করেছে আড়াই লাখ মানুষের প্রাণ। ধ্যানচর্চার শত কেন্দ্রসহ বান্দরবানের লামার দুর্গম এলাকায় গড়ে তুলেছে এক আলোকিত জনপদ। বিশুদ্ধ পানির জন্যে নলকূপ স্থাপন, সুন্নতে খতনা, মাতৃমঙ্গল, ত্রাণ ও দাফন কার্যক্রমসহ সেবার যেকোনো সুযোগ গ্রহণ করেছে আন্তরিক মমতায়। স্বনির্ভরয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তুলেছে অবহেলিত পরিবারগুলোকে। হাজার হাজার মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করেছে সৎ দানে ও সৎ কাজে।

কোয়ান্টামের মূল উদ্দেশ্য :
কোয়ান্টামের মূল উদ্দেশ্য প্রতিটি মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি এবং সম্ভাবনাকে জাগ্রত করা যাতে সে তার মেধার সর্বোত্তম বিকাশ ঘটিয়ে একজন সফল মানুষে পরিণত হতে পারে। সেই সাথে সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার একক কল্যাণশক্তিকে বহুগুণে বৃদ্ধি করা। কারণ একক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় বড় কোনো কল্যাণমূলক কাজ করা না গেলেও অনেকে যখন সমবেত হন, তখন এটা দিয়েই সম্ভব দূরপ্রসারি কিছু করা। অবশ্য সবকিছুর আগে প্রয়োজন ব্যক্তির আত্মনির্মাণ, ব্যক্তির সাফল্য। কারণ ব্যক্তি যদি সফল না হয়, তাহলে সমাজ সফল হবে না, রাষ্ট্র সফল হবে না। তাই ব্যক্তির আত্মিক, বৈষয়িক, পারিবারিক স্বাস্থ্যগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সফল মানুষদের সঙ্ঘশক্তি সৃষ্টি করে বিশ্বকে কল্যাণের পথে নেতৃত্ব দেয়াই কোয়ান্টামের মূল উদ্দেশ্য।

কোয়ান্টামের কার্যক্রম :
কোয়ান্টামের কার্যক্রম মূলত দুটি ধারায় পরিচালিত হচ্ছে, আত্মউন্নয়ন এবং সৃষ্টির সেবামূলক। আত্মউন্নয়নমূলক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে এর সদস্যদের সফল জীবনের সূত্রের পাশাপাশি একজন মানুষ যাতে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি আয়ত্ত করে অনন্য মানুষ হয়ে উঠতে পারে সেজন্যে সারা মাসজুড়ে পরিচালিত হচ্ছে কোয়ান্টামের নানা ধরনের আত্মউন্নয়নমূলক কাজ।
এর পাশাপাশি সৃষ্টির সেবার জন্যে ফাউন্ডেশন করছে সৃষ্টির সেবামূলক কার্যক্রম। স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম, বান্দরবানের লামায় বঞ্চিত শিশুদের আলোকিত মানুষররুপে গড়ে তোলার জন্যে কোয়ান্টাম শিশুকানন, রাজশাহীতে অভিভাবকহীন শিশুদের আলোকিত মানুষরুপে গড়ে তোলার জন্যে কোয়ান্টাম শিশুসদন, খতনা কার্যক্রম, বিশুদ্ধ খাবার পানি কার্যক্রম, চিকিৎসাসেবা, এবং দুস্থদের ঋণমুক্তি ও পুনর্বাসন কার্যক্রম।

নামকরণ কোয়ান্টাম কেন :
কোয়ান্টাম ফিজিক্স, নিউরো সাইন্স এবং জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ শতকে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের বিশ্বদৃষ্টিকেই পাল্টে দেয়। যে বিজ্ঞান ছিলো দীর্ঘদিন বস্তুকেন্দ্রিক, নিউটনিয়ান মেকানিক্সের নিগড়ে বন্দি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স আসার পর সে বিজ্ঞান এখন হয়ে উঠেছে চেতনানির্ভর। যেহেতু কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিজ্ঞান থেকে নির্বাসিত মনকে বিজ্ঞানে পুনর্বাসিত করেছে, তাই চেতনার শক্তিকে, মনের অসীম ক্ষমতাকে মানবতার কল্যাণে ব্যবহারের সহজ ও পরীক্ষিত এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটির নাম আমরা রেখেছি কোয়ান্টাম মেথড। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে একটি ইলেকট্রন যখন তার কক্ষপথে ঘোরে তখন ঘুরতে ঘুরতে কেন্দ্রের দিকে এগুতে থাকে। এরই একপর্যায়ে সে একটা উচ্চতর কক্ষপথে লাফ দেয়। খুব দ্রুত ঘটা এ পরিবর্তনটিকে বলা হয় কোয়ান্টাম লিপ বা কোয়ান্টাম উলম্ফন। তেমনি একজন মানুষ যখন ধ্যান করে, আত্মনিমগ্নতার গভীরে হারিয়ে যায়, তখন তার মধ্যেও একটা উপলব্ধির স্ফূরণ ঘটে যা তাকে আগের চেয়ে উন্নততর স্তরে নিয়ে যায়। ধ্যানের স্তরে যখন একজন মানুষ যায় তখন কোয়ান্টাম লিপের মতো তার চেতনার জগতেও একটা উলম্ফন হয়। কোয়ান্টাম মেথড নামকরণের এটাও একটা কারণ। আর কোয়ান্টাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পরিমিতি। কারণ সুস্থ, সুন্দর ও সার্থক জীবনের জন্যে প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ জীবনদৃষ্টি এবং সবকিছুর মধ্যে একটা পরিমিতি। কোয়ান্টাম হচ্ছে সাইন্স অফ লিভিং বা সাইন্স অব ওয়েল বিয়িং। জীবন যাপনের বিজ্ঞান বা ভালো থাকার বিজ্ঞান যা বলে দেয় জীবনটাকে কীভাবে সুন্দর করা যায়, ভুল থেকে কীভাবে দূরে থাকা যায়, আর ভালো বা কল্যাণ কত বেশি করা যায়। তাই আমরা কোয়ান্টামকে বলি জীবন যাপনের বিজ্ঞান, জীবন আচরণের বিজ্ঞান। কোয়ান্টাম চর্চা করে আমরা ভালো থাকছি, আমরা আলোকিত হচ্ছি এবং আলোকিত করছি সাধারণ মানুষকে। বদলে দিচ্ছি নিজেদের এবং পরিচিতজনদের জীবনকে।

কোয়ান্টামের অর্থের উৎস :
কোয়ান্টামের প্রতিটি সৃষ্টির সেবামূলক কার্যক্রমের অর্থায়ন হয় ফাউন্ডেশনের সদস্যদের অর্থায়নে। শুধু অর্থায়নই নয়, পরিকল্পনা এবং উদ্যোগও ফাউন্ডেশনের নিজস্ব।কারণ আমরা বিশ্বাস করি, স্ব-উদ্যোগ, স্ব-পরিকল্পনা ও স্ব-অর্থায়নে সৃষ্টির সেবায় যেকোনো কাজ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে আমাদের অর্থায়নের একটি জনপ্রিয় উৎস হলো মাটির ব্যাংক। এছাড়াও রয়েছে সদস্যদের অনুদান ও বিশেষ দান।
কোয়ান্টাম মেথডে যেসব ফল পাওয়া যায়-
১. সচেতনভাবে দেহ এবং স্নায়ুর শিথিলায়ন :
ঘুমের সময় একজন মানুষের দেহ ও স্নায়ু শিথিল হলে তার চেতনাও তখন হয়ে পড়ে অচেতন। কিন্তু মেডিটেশনে আমাদের দেহ ও স্নায়ু যেমন শিথিল হয়, তেমনি চেতনাও থাকে সজাগ। ফলে সচেতন মন তখন অবচেতন মনকে যথাযথ নির্দেশ প্রদান করতে ও সৃজনশীলভাবে কাজে লাগাতে পারে।
২. মনকে বর্তমানে নিয়ে আসা আমাদের মন হয় অতীত নিয়ে অনুশোচনা করে, না হয় ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা করে, বর্তমানে থাকতে চায় না। মেডিটেশন মনকে বর্তমানে নিয়ে আসে। ফলে দুশ্চিন্তা বা আশঙ্কায় সময় নষ্ট না করে মনের শক্তি নিয়োজিত হয় দেহের স্বাস্থ্য উদ্ধারে, সৃজনশীলতার বিকাশে, চেতনার অভ্রভেদী বিস্তারে।
৩. মনোযোগায়ন
মনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো মনোযোগ। আর মনোযোগায়ন হলো একটি বিষয়ের উপর মনকে নিবদ্ধ করা। ক্রমাগত মেডিটেশনের মধ্য দিয়েই একজন মানুষ অর্জন করে মনকে সূচাগ্র করার এই শক্তি অর্জন করতে।
৪. ব্রেনকে বেশি পরিমাণে ব্যবহার
মানবদেহের সবচেয়ে জটিল, রহস্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে ব্রেন বা মস্তিষ্ক। ব্রেনই মানুষকে প্রথম পাথরের অস্ত্র তৈরি করতে শিখিয়েছে। আর সেই ব্রেনের জেনেটিক উত্তরসূরীরাই বানিয়েছে মহাশূন্য যান। মানুষ অতীতে যা করেছে, ভবিষ্যতে যা করবে তা এই ব্রেনেরই ফসল। ব্রেনই মানুষকে মানুষ বানিয়েছে। এই ব্রেনকে বেশ পরিমাণে কাজে লাগাবার জন্যে যে সুসংহত মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন তা গঠনেই সাহায্য করে মেডিটেশন।
৫. আত্ম-নিমগ্নতা
মেডিটেশন মানে একজন মানুষের নিজের গভীরে নিমগ্ন হওয়া এবং অন্তরতম আমি-র সাথে সংযুক্ত হওয়া। তখনই একজন মানুষের অনুভবের দরজা খুলে যায় এবং সে নতুন সত্যকে অনুভব করতে পারে।

কোয়ান্টাম সম্পর্কে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ :
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কোয়ান্টাম সম্পর্কে বলেন,
একটি যুগের ভেতর যে দুঃখ আর বেদনাগুলো থাকে সে যুগের প্রতিটি সচেতন ও বেদনাবান মানুষকে সেসব বেদনা আর দুঃখের সাধ্যমতো জবাব দিতে হয়। মানবিক মুক্তির জন্যে এই সংগ্রাম আর আত্মোৎসর্গের পথ ধরেই মানুষ তার নিজের অসহায়তাগুলো অতিক্রম করে, রচিত হয় মানবসভ্যতার উচ্চতর সোপান। মহাজাতক শহীদ আল বোখারী একসময় তার চারপাশের মানুষের ভেতর আধ্যাত্মিক নিঃস্বতার এই কালো অন্ধকার লক্ষ্য করেছিলেন । দেখেছিলেন আত্মশক্তি বা আত্মোৎবোধনের অভাবে, মনের একাগ্রতা ও শৃঙ্খলার অনটনে বহু মানুষ এক ধরনের শারীরিক ও মানসিক নৈরাজ্য ও নিষ্কিয়তায় ভুগে দুর্লভ মানবজন্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তো হারিয়ে ফেলছেই, সেই সঙ্গে নিজেদের ন্যুনতম সুস্থতা রক্ষা করতেও অপারগ হচ্ছে। কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশনের মাধ্যমে তিনি তাদের দিকে শুশ্রুশার হাত বাড়িয়ে দিয়েছন। তার চেষ্টার ফলশ্রুতিতে বহু মানুষ নানা মানসিক ও নিষ্ক্রিয়তা থেকে সেরে উঠে আলোকিত জীবনের পথ খুঁজে পেয়েছ। যে আত্মাহীন নৈরাজ্যপূর্ণ যুগের আক্রমণে আজ আমাদের প্রতিটি মানুষের স্নায়ু ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে, মানুষ প্রতি মুহূর্তে সুস্থতা হারাচ্ছে সে মুহূর্তে মহাজাতকের এই সেবার উদ্যোগ সেই মানবিক ধসের বিরুদ্ধে একটি সুস্পষ্ট প্রতিরোধ । আজ তিনি কোয়ান্টামকে পারিবারিক রুপ দিয়েছন। তার পরিবারের সভ্যরা সবাই সবার দোসর হিসেবে বন্ধু হিসেবে যে অভিন্ন একাত্মতায় জেগে উঠেছেন, তা-ও মনকে মুগ্ধ করে। তাদের মাধ্যমে তিনি যেসব সামাজিক কার্যক্রম সফল করে চলেছেন যেমনÑ রক্তদান কর্মসূচি, স্বেচ্ছা দাফন কার্যক্রম, মাতৃমঙ্গল কার্যক্রম, যাকাত ফান্ড, মেডিকেল ক্যাম্প থেকে শুরু করে অনান্য কার্যক্রম- সেসবের সাফল্যও অনন্য। কোয়ান্টাম মেথড কোর্সের ৩০০ তম পর্বের পূতি উপলক্ষে এই প্রতিষ্ঠানের বিরল সাফল্যকে আমি অভিনন্দন জানাই। আজকের বাংলাদেশের আতœস্বার্থসর্বস্ব পরিবেশে এমন অভাবিত সাফল্য বিরল।

পরিশেষে :
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রতিমাসেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে কোয়ান্টাম মেথড কোর্স। কোর্স করে প্রশান্তি সুস্বাস্থ্য সাফল্যের পথে ফাউন্ডেশনের আজীবনের একজন সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য দান করা যায়, কোয়ান্টাম মাটির ব্যাংকসহ ফাউন্ডেশনের শিশুকানন, শিশুসদন, টিউবওয়েল, খতনা, দাফনসহ অন্য যেকোনো খাতে। রক্ত দিতে পারেন যে কেউ। ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমে রক্ত দান করা যায়।


মানবিক বিশ্বায়নের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেই
প্রফেসর আনু মোহম্মদ

অন্তর্গতভাবে মানুষ একক, অখন্ড একটি জাতি। অর্থ্যাৎ মানবজাতি। কিন্ত সৃষ্টির নিয়মেই তার মধ্যে কিছু বৈচিত্র আছে, পার্থক্য আছে। যেমন, গায়ের রঙ, জাতীয়তা, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যা খুব স্বাভাবিক। কিন্ত এ পার্থক্যগুলোর ভিত্তিতে যদি তার সাথে বৈষম্য করা হয়, নিপীড়ন, নির্যাতন করা হয় বা তাকে বঞ্চিত করা হয়, তাহলে সেটা খুবই অযৌক্তিক একটি ব্যাপার। কারণ এ বৈশিষ্ট্যগুলো তার ইচ্ছানিরাপেক্ষ। যেমন, একজন মানুষ কেন দেশে, কোন বর্ণে, কোন ধর্মে বা কোন ভাষা নিয়ে জন্মাবে এটা সে নিজে নির্ধারণ করে না।
এটা নির্ধারিত হয়। বৈষম্যের এই যে নানা রূপ, নানা মাত্রা- এর বিপরীতে একটি অখন্ড মানবসমাজের ঐক্যের জন্যেই বিশ্বায়নের ধারণার উদ্ভব। বলাবাহুল্য, তাতে মানবসমাজের স্বাভাবিক বৈচিত্রপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো থাকবে। কিন্তু তারপরও তারা হবে অখন্ড একটি মানবসমাজ। সেটা বিশ্বায়নের প্রচলিত ধারণা নয়; বরং সেটা হলো এক মানবিক বিশ্বায়ন, যেখানে একটি দেশ বাকি পৃথিবীর সঙ্গে তার শক্তি এবং দুর্বলতাগুলোর বিনিমযের মাধ্যমে সুস্থ ভারসাম্য পৌছাতে পারে । আরও আশার কথা হলো, যে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও সম্পদের অবস্থা- তা দিয়েই অর্জিত হতে পারে এই কাক্সিক্ষত বিশ্বায়ন। আমাদের সম্পদের অভাব আছে- এ বাংলাদেশ বা পৃথিবী- দুই ক্ষেত্রেই খুবই ভুল একটি কথা। বলা হয় পৃথিবীর ৬০০ কোটি মানুষের অর্ধেকেরও বেশি দরিদ্র । বাংলাদেশের ৭ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। এ দারিদ্র সম্পদের অভাবের জন্যে নয়, এ দারিদ্র সম্পদের অসম ব্যবহার এবং অসম বন্টনের জন্যে হয়েছ। যেমন, জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি একটি হিসেব করে দেখিয়েছিলো যে, পৃথিবীর জমি, পানি এবং প্রযুক্তি এই তিনের সমন্বয় ঘটিয়েযে খাদ্য উৎপাদন করা যাবে তাতে ৬,০০০ কোটি মানষের খাবারের সংস্থান হবে যেখানে পৃথিবীর জনসংখ্যা হলো মাত্র ৬০০ কোটি। গত ৩৪ বছরে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেড়েছে ১০০ ভাগ এবং এ সময়ে খাদ্যোৎপাদন বেড়েছে ১৭০ ভাগ।
এখন বাংলাদেশে মাথাপিছু খাদ্যের উৎপাদনও বেশি। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের ৬০ ভাগ শিশু অপুষ্টির শিকার । এখন সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হয় যে খাতে তা খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা বা শিক্ষা নয়, তা হলো সমরাস্ত্র এবং যুদ্ধ সরগ্রাম। প্রতিবছর ৯০০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয় এ খাতে । আর এর ৬০ ভাগ অর্থাৎ ৬০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে একা আমেরিকাই। তারপরও আমেরিকা প্রতিনিয়তই হুমকি মনে করে এমন সব দেশকে যারা এর ১ ভাগও খরচ করে না। বাংলাদেশের মতো এত সমৃদ্ধ অঞ্চল খুব কমই আছে। মাটি যদি উর্বর হয়, তাহলে তা সোনার খনির চেয়েও দামী হতে পারে। কারণ সোনার খনি তুলে ফেললেই শেষ। কিন্তু যে মাটি উর্বর তা-তো অনন্তকাল ধরে উৎপাদন দিতে থাকে।
বাংলাদেশের আছে সেই মাটি। বাংলাদেশের মতো এত সমৃদ্ধ পানিসম্পদ খুব কম দেশেই আছে। এমনকি এর বিপুল জনসংখ্যাও এর জন্যে সম্পদ হতে পারে যদি এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হয়। কারণ মানুষ শুধু মুখ নিয়েই জন্মায় নি, এর সাথে আরো আছে তার হাত, পা এবং অমিত সম্ভাবনাময় ব্রেন। একটা কম্পিউটার নষ্ট হয়েগেলে আমরা কত আফসোস করি কিন্তু এই কম্পিউটারের চেয়েও হাজার গুণ শক্তিশালী যে মস্তিষ্কগুলো ফুটপাতে বস্তিতে হেলায় নষ্ট হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের ভাবনা নেই । এগুলো তো মাটির ওপরের সম্পদ।
মাটির নিচের সম্পদের মধ্যে রয়েছ গ্যাস, কয়লা । কিন্ত একটি দেশের শাসকগোষ্ঠী যদি ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্যে কতিপয় কোম্পানি বা বিদেশি গোষ্ঠীর ক্রীড়নকের ভূমিকা গ্রহণ করে তাহলে এতসব সম্পদ বরং সে দেশের জন্যে বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিশেষত সে চক্রান্ত যদি অনবায়নযোগ্য সম্পদ নিয়ে হয়। বাংলাদেশের অবস্থাও অনেকটা তা-ই । আগে একজন বিশেষজ্ঞের কাছে শুনছিলাম, পৃথিবীতে যে দুটি তেলভান্ডারকে কিছুই করা হয় নি তার একটি হলো আলাস্কা এবং আরেকটি হলো বঙ্গোপসাগর এই তেল বা গ্যাসকে যদি আমরা আমাদের কাজে ব্যবহার করি তাহলে কত কিছুই না করতে পারবো । এখন বাংলাদেশের ৭০ ভাগ মানষের কাছে বিদ্যুৎ নেই। গ্যাস দিয়ে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবো । কমে যাবে আমাদের উৎপাদন সম্পদ উত্তোলন বা ব্যবহার করার সামর্থ্য আমাদের নেই। এর জন্যে বিদেশি বিনিয়োগ লাগবে, বিদেশি কনসালটেন্ট লাগবে । তারা এসে মাইলের পর মাইল কৃষিজমি নষ্ট করবে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তচ্যুত করবে, পানি শুকিয়ে মরুভূমি বানাবে। তারপর গ্যাস বা কয়লা সব তুলে নিয়ে গিয়ে আমাদের কাছেই আবার বিক্রি করবে দ্বিগুণ, তিনগুণ বেশি দামে।
“দাতা সংস্থা" বা “বিদেশি সাহায্য শব্দগুলো আমাদের খুব পরিচিত। আমরা কেউ কেউ মনে করি এটা বোধ হয় হাতেম তাঈ, হাজী মুহস্মদ মুহসীন বা আর পি সাহার দান। আসলে তা নয়। “দাতা সংস্থা" বলতে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে বোঝায়, আর `সাহায্য` বলতে বোঝায় এ সংস্থাগুলোর নিজস্ব কৌশল বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশকে খণ দেয়া। আর এরকম বিদেশি সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের নেমে এসেছে আর্সেনিক নামের এক ভয়াবহ বিপর্যযের খন্ড । গভীর নলকৃপ দিয়েনির্বিচার পানি উত্তোলনের ফলে মাটির নিচে পানির ভারসাম্য নষ্ট হয়েগেছে। আবার এখন এই আর্সেনিক সমস্যা নিয়ে চলছে তাদের হাজার কোটি টাকার নতুন নতুন প্রকল্পে ঝাপিয়ে পড়ার প্রতিযোগিতা । বলা বাহুল্য, এসব প্রকল্পের কাজ আর্সেনিক সমস্যার কারণ উদঘাটন নয়, সমাধানও নয়। কাজ হলো নানারকম জরিপ করা আর কনসালটেন্টের লাখ লাখ টাকার বেতন গোনা । এ প্রেক্ষাপটে মানবিক বিশ্বায়নের পথ যতই দুর্গম হোক, আমি বিশ্বাস করি সেটা অসম্ভব নয়। কারণ এ অবস্থা বদলানো যাবে না বা বাংলাদেশ পারবে না- এ ধরনের মানসিক হতাশা হীনম্মন্যতা থেকে আন্তে আস্তে আমরা বেরিয়ে আসছি। মানুষের ভেতরের অমিত সম্ভাবনা এবং তার সঙ্গে সম্পদের যোগ করে যে বিপুল ক্ষমতার স্ফুরণ সম্ভব সেটা ভাবলেই বিশ্বাস হয় যে, এ পরিবর্তন অবশ্যই আমরা করতে পারবো। সকল প্রকার জাতিগত হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলে এ আত্মবিশ্বাস এবং এ স্বপ্ন দেখার প্রক্রিয়া কোয়ান্টাম ইতোমধ্যেই শুরু করেছে- এটা খুবই ইতিবাচক একটি দিক।
[কোয়ান্টাম মুক্ত আলোচনায় প্রদত্ত ভাষণের অনুলিখন]