পর্যটন
  দেখে এসেছি নয়নাভিরাাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন
  24-03-2019

“দ্বিতীয় পর্ব“

”মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। ভ্রমন করে না অথবা করতে চায় না এমন মানুষ এই দুনিয়ায়  পাওয়া বড় দুস্কর। একঘেঁয়ে জীবন যাত্রায় মানুষ যখন হাঁপিয়ে ওঠে, তখন তার অন্তত কিছু সময়ের জন্য একটু আরাম, একটু বিরাম ও একটু শান্তির খোঁজে বেরিয়ে পড়েন সৃষ্টিকর্তার অপারময় সৃষ্টির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখার জন্য কাছে বা দূরে কোথাও। একজন পর্যটক হিসেবে আপনি ঘুরে আসতে পারেন সারা বিশ্ব। ঢাকার বাইরে ঘুরে আসতে চান? তবে স্বল্প মূল্যে পরিবার নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন দেশের দর্শনীয় স্থানসমুহ। আমাদের সুজলা-সুফলা নদী মাতৃক এই দেশের মধ্যেই রয়েছে পাহাড়, পর্বত সমুদ্র, জঙ্গল, স্থাপত্য, পুরাকীর্তি ইত্যাদি। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য রয়েছে বিনোদনের নানান ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত সম্ভার। পর্যটক হিসেবে আপনি যদি ভ্রমণ করতে চান, মাথার ওপর নীল চাঁদোয়া, মেঘে-বৃষ্টিতে ভেজা বাতাস, পায়ের নিচে অন্য এক পৃথিবী উপভোগ করতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্রগ্রামের রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন। ঘুরে এসে ভ্রমণ পিপাসু পাঠকদের উদ্দেশে লিখেছেন- মোঃ রিয়াজ উদ্দিন

 

পাঠকদের ভ্রমনের সুবিধার্থে রাঙামাটিসহ আমাদের ভ্রমনের গুরুত্বপূর্ণ স্পটগুলির বিস্তারিত তুলে ধরা হলোঃ-
পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বরাবরের মতোই প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। রাঙামাটির প্রকৃতি, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি ভ্রমণপ্রিয়দের আকৃষ্ট করে। প্রকৃতি যেন এখানে বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রুপে সাজে। শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা-রুপের জৌলুস থাকে সাড়া বছরই। পার্থক্য কেবল ঋতুর সাজে। অপরুপ সৌন্দর্যে ভরপুর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলা। এখানে চলে পাহাড়, নদী আর হ্রদের মিলনমেলা। কোনো উপমাই যথেষ্ট নয় যতটা হলে বোঝানো যায় রাঙামাটির সৌন্দর্য। এখানকার পত্যেক পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অদেখা ভুবন যেখানে অপেক্ষা করছে নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। লেকের পানি চিরে ভেসে ওঠা ছোট্ট শহর। নানান বৈচিত্রের ভান্ডারের মধ্যে উপজাতীয় সংস্কৃতি, পাহাড়ি জনপদ এবং মানুষের জীবন সংগ্রাম মনোমুগ্ধ করে তোলে। শহরের আকর্ষন উপজাতীয় জাদুঘর। এখানকার সংস্কৃতি ও ইতিহাসের পুরোটাই মিলবে জাদুঘরে। উল্লেখ্য বাংলাদেশে একমাত্র রিক্সা মুক্ত জেলা হল এই রাঙামাটি শহর।
সৌন্দযের লীলাভূমি রাঙামাটি। পাহাড়ের বুকে সূর্যালোক, ভরা পূর্ণিমা রাতে হ্রদের পানিতে মৃদু ঢেউয়ের ওপর জোছনার ঝলকানি আর গিরি নির্ঝর ঝরনার রূপমাধুরী দেখেনি যে, সে যেন অপরূপ পাহাড়ি অরণ্যের জনপদ রাঙামাটি দেখেনি। এলোমেলো সারিতে সাজানো উঁচু-নিচু ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়ের সমাবেশ। এসব নিয়েই পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটি। যেদিকেই তাকাবেন যেন শৈল্পিক আঁকা দৃশ্য। আঁকাবাঁকা কাপ্তাই লেক। চারদিকেই স্বচ্ছ জলধারা। কাপ্তাই লেক মিশেছে প্রকৃতির সঙ্গে অপরূপ সাজে। প্রকৃতিপ্রেমীদের প্রতিনিয়তই যেন কাছে টানছে কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ জলধারা। এমন পাগল করা প্রকৃতির অদ্ভুদ সৌন্দর্যের আঁধারে মিলিয়ে যেতে কার না মন চায়। তাই তো সময় পেলেই প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসছেন রাঙামাটির দৃষ্টিকাড়া মনোরম রাঙামাটি জাদুঘর, জেলা প্রশাসন বাংলো, রাজবন বিহার, চাকমা রাজার কার্যালয়, বৌদ্ধদের তীর্থস্থান । বৌদ্ধ ধর্মের বেশ কিছু নিদর্শন রয়েছে এখানে। ইচ্ছে করলে অটোরিক্সা ভারা করে ঘুরে আসা যায়। কারণ এগুলো শহরে মধ্যে অবস্থিত। এছাড়া আরো রয়েছে নৌপথে কাপ্তাই হৃদরে স্বচ্ছ জলরাশি বুক চিড়ে অবস্থিত সুভলংয়ের সবুজ দ্বীপ , সেগুন বাগানকে কেন্দ্র করে রয়েছে বেসরকারি পর্যটন স্পট পেদা টিং টিং নামক রেস্টুরেন্ট। পর্যটন স্পট আর নৈসর্গিক আবেশে, ঘুরে বেড়াচ্ছেন পাহাড়ে। 

রাঙামাটির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাদুঘরে রয়েছে পাহাড়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ জাতিগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সাংস্কৃতির প্রাচীন নিদর্শন।
কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকার কলাবাগন, ফকিরাপুল ও কমলাপুর থেকে সরাসরি রাঙামাটি ছেড়ে যায় এস আলম, সৌদিয়া, শ্যামলী সহ বিভিন্ন পরিবহন। এছাড়া অন্যান্য বাস ট্রেন ও বিমানে চট্টগ্রাম হয়ে বাই রোডে রাঙামাটি আসা যায়। চট্টগ্রাম বদ্দারহাট বাসটার্মিনাল থেকে প্রতিদিনই মিলবে রাঙামাটির বাহন।
চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া যায় খুব সহজে। চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৭৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পর্যটন শহর রাঙামাটি। চট্টগ্রাম শহর থেকে রাঙামাটি আসতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। চট্টগ্রামের মুরাদপুর বিশ্বরোডে আছে রাঙামাটির প্রধান বাস স্টেশন। যেখান থেকে ছাড়ে বিআরটিসি এবং বিরতিহীন বাস সার্ভিস সমূহ।

কোথায় অবস্থান করবেনঃ একটু নিরিবিলি পরিবেশে থাকতে চাইলে উঠতে পারেন রাঙামাটির পর্যটন মোটেলে। এখানে শুধু ডবল রুম রয়েছে। প্রতি রুমের জন্য ভাড়া গুনতে হবে ৮০০টাকা। আবার এসি ডবল রুমের ভাড়া পরবে ১২০০ টাকা। এছাড়া বেসরকারী হোটেলে রাতযাপন করা যায়। এজন্য বাড়া নিতে পারেন পৌরসভার কার্যালয়ের পাশেই অবস্থিত হোটেল সুফিয়া, রির্জাভ বাজারে গ্রীন ক্যাসেল, কলেজ েেটর মোঠেল জজ। এসব হোটেলে সিঙ্গেল রুরে ভাড়া পরবে ৫০০ টাকা, ডবল রুম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং এসি রুমের জন্য দিতে হবে ১২০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা । এ ছাড়াও পর্যটকদের থাকার জন্য মাঝারি মানের অল্প টাকার হোটেলেও রয়েছে।

রাঙামাটির বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের চিত্র পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো।
কাপ্তাই লেকঃ পার্বত্য অঞ্চলের সম্পূর্নটাই সৌন্দর্যে ভরপুর পুরো এলাকা তন্ন তন্ন করে চষে বেড়ালেও আপনার মুগ্ধতা শেষ হবে না। এখানে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘুমিয়ে থাকে শান্ত পানির হ্রদ। প্রকৃতি এতো সুন্দর! তবে কাপ্তাই লেককে প্রাকৃতিক বললে ভুল হয়ে যাবে। পাকিস্তান আমলে জলবিদ্যুত বাস্তবায়নের স্বার্থে কর্ণফুলী নদীর গতিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পাহাড়ে ফাঁক ফুকুরের সমতল আবাদি জমি গুলো পানিতে পূর্ণ হয়ে বিশাল এক সরোবরে পরিণত হয়। এটি এখন কাপ্তাই লেক। লেকের নীল জল যে কারো হৃদয় শীতল করে দেয়। সম্পূর্ন আবৃত করে রেখেছে পর্বতশ্রেণী। লেকের জলে নৌকায় ভেসে বেড়ানো যে কারো জন্য স্মরণীয় ঘটনা।

শুভলং ঝরণাঃ জেলার সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় জায়গার মধ্যে শুভলং ঝরনা একটি। রাঙামাটি ভ্রমনে এলে সবার প্রথম আকর্ষণ। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে ঝরনাটি পতিত হয়েছে কাপ্তাই লেকে। শুভলং কাছে যেতে বাধা নেই, ফলে ঝরনার রুপমাধুর্য প্রাণ ভরে উপভোগ করা যায় সহজেই। সেখানে যাওয়ার একমাত্র উপায় নৌকা বা স্প্রীড বোট।
শুভলং বাজারঃ এখানকার সাজসজ্জা অন্য বাজারের থেকে খানিকটা ভিন্ন। বিন্নিচাল তিতগুলা, তিতবেগুন, বাঁশপ্রোল, গোমাইত্যা, শিমে আলু, তারা ডাঁটা- এগুলো স্থানীয় খাবার। রাঙামাটি রেস্তোরায় পাওয়া যায় নানা ধরনের পাহাড়ি খাবার। পাওয়া যায় তাদের হাতে বোনা ঐতিহ্যবাহী পোশাক, গামছা, গায়ের চাদর, কম্বল ইত্যাদী। বাজারে যেতে হলে শুভলং ঝরনার পথেই যেতে হয়।

রাজবন বিহারঃ দেশের সর্ববৃহৎ এ জেলার বেশ কয়েকটি নিদর্শনের মধ্যে রাজবন বৌদ্ধ বিহার একটি। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি একটি পবিত্র স্থান। আধ্যাত্মিক মন্দির বলেও এর পরিচিতি বা নাম রয়েছে। মন্দিরের দৃষ্টিনন্দন গঠনের জন্য সাধারন পর্যটকদের কাছেও এটি আকর্ষণীয় জায়গা।
কাপ্তাই ন্যাশনাল পার্কঃ জাতীয় এ উদ্যানের অবস্থান কর্ণফুলী নদী ও কাপ্তাই মাউন্টেন রেঞ্জের মাঝামাঝি। ৫,৪৬৪.৭৮ হেক্টর জমি নিয়ে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে হরিণ, বনবিড়াল, হাতি, বানরসহ অন্যান্য প্রানী। বিলুপ্তপ্রায় বেশ কয়েক প্রকার পাখিও আছে। বর্তানে এটি বন্য পশু-পাখির এক অভয়ারণ্য।


ঝুলন্ত সেতুঃ দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতির পেছনে এখন পর্যন্ত কাপ্তাই লেকের পরই যার স্থান সে হলো রাঙাাটির ঝুলন্ত সেতু। দৃষ্টিনন্দন সেতুটি কাপ্তাই লেকেরই বিশেষ এক অংশে স্থাপিত। সেতুকে কেন্দ্র করে এখানে রয়েছে একাধিক ক্যাটাগরির বোটিং সেবার আয়োজন। বর্ষায় লেক ও তার চারপাশের প্রকৃতিতে লাগে যৌবনের ছোঁয়া। পানিতে টইটম্বুর হয়ে থাকে লেকপ্রাঙ্গন।

প্যাদা টিং টিংঃ কাপ্তাই লেকের একটি অংশের মাঝখানে দ্বীপের মতো জায়গাটিতে একটি রেস্তোরা রয়েছে, নাম প্যাদা টিং টিং। সেখানে মোটামুটি স্বল্প খরচে পাহাড়ি খাবারের হরেক পদ থেকে বেছে নিতে পারবেন আপনার পছন্দের খাবার। মন্ডি, নতুনমন্ডি, চিকেন চাটনি ইত্যাদি এখানকার জনপ্রিয় পদ। বিশেষ করে সেখানে গিয়ে কলাপাতা ও বাঁশের চোঙার মধে রান্œা করা মুরগীর মাংস অথবা মাছ খেতে ভুলবেন না।

কেন যাবেনঃ যেদিকেই তাকাবেন যেন শৈল্পিক আাঁকা দৃশ্য। আঁকাবাঁকা কাপ্তাই লেক। চারদিকেই স্বচ্ছ জলধারা। কাপ্তাই লেক মিশেছে প্রকৃতির সঙ্গে অপরুপ সাজে। দেখলে মনে হয় যেন কোনো এক শিল্পী তার তুলিতে একেছেন জীবন্ত এক চোখ জুৃড়ানো ছবি। সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে অসংখ্য পাহাড়ি ঝরনার কলতান আরো আকর্ষণীয় করেছে। প্রকৃতিপ্রেমীদের প্রতিনিয়তই যেন কাছে টানছে কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ জলধারা।

যাওয়ার পথে যা দেখতে পাবেনঃ চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়কের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে বাসে চড়ারসময় বেতবুনিয়া পা বাড়ালেই রাঙামাটি পার্বত্য জেলা। এ বেতবুনিয়ায় দেশের সর্বপ্রথম উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রটি অবস্থিত। এরপর রানীহাট বাজার অতিক্রম করে সামনে দিকে তাকালে সুউচ্চ অসংখ পাহাড়ের সাড়ি।

ছবি তোলায় সতর্ক ঃ পাহাড়ি ও উপজাতিদের সঙ্গে ছবি তুলতে আগে অনুমতি নিয়ে নিবেন। নতুবা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন। কারণ, উপজাতীদের ছবি বাঙালীদের সাথে তোলার পর যদি সোস্যাল মিডিয়ায় যায়, আর সেই ছবি উপজাতীয় নেতারা দেখতে পায় তাহলে তাদের উর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করেন। উপজাতীয়দের সাথে অনেকে ছবি তুলে বানিজ্য করে বলে নিয়মটা একটু কড়াকড়ি।


বিঃদ্রঃ প্রিয় পাঠক, সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাঙামাটি ভ্রমনের বিস্তারিত জানতে নিয়মিত পড়–ন পরবর্তী পর্বগুলী।

 

লেখক: সম্পাদক, মানবাধিকার খবর

 Email-md.reaz09@yahoo.com