বিশেষ প্রতিবেদন
  চার বছরে ত্রিশোধিক নারী-শিশু উদ্ধার : অপেক্ষায় চার
  10-02-2019

মানবাধিকার খবরের দেশ-বিদেশে অনুসন্ধানী অভিযান

এই মহতী  উদ্যোগে সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে সার্বিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহবান।

সৈয়দ সফি :
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে প্রায় ২০ হাজারের ও বেশি নারী ও শিশু। তাই, “মানবাধিকার খবর” একটি মানবাধিকার খবর বিষয়ক পত্রিকা হওয়া সত্বেও কেবল সংবাদ পরিবেশন নয়, পাঠকদের কাছে সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া নারী-শিশু উদ্ধারের মতো মহৎ ও সামাজিক-মানবিক কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মানবাধিকার খবরের সম্পাদক ও প্রকাশক রোটা. মো. রিয়াজ উদ্দিন অনুসন্ধানী অভিযান চালিয়ে গত চার বছরে ভারতে পাচার হয়ে যাওয়া ত্রিশোধিক শিশু-নারীকে দেশ-বিদেশ থেকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের পরিবারের কাছে। উদ্ধার হওয়া এসব শিশু-নারীরা ফিরে পেয়েছে এক নতুন জীবন। ফলে, মহা আনন্দে মাতোহারা এসব পরিবার। সফলতার সঙ্গে একের পর এক শিশু-নারীদেরকে উদ্ধারে সক্ষম হওয়ায় অনেক পরিবার এখন ছুটে আসছেন মানবাধিকার খবর অফিসে। কেউ তার সন্তান, কেউ তার পরিবারের সদস্যকে উদ্ধারে চাইছেন সহায়তা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাচার হয়ে যাওয়া নারী-শিশুদের পরিবারগুলো গরীব ও অভাবগ্রস্থ। ফলে, সময় সাপেক্ষ ও উদ্ধার কাজ ব্যয় বহুল হওয়ায় মানবাধিকার খবরের পক্ষে খুব বেশি তৎপরতা চালানো সম্ভব হয়ে উঠে না। মানব কল্যানে সমাজের দয়াশীল শ্রেনীর মানুষ ও প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপরে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিলে আরো অনেককেই উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে জানান মো. রিয়াজ উদ্দিন। মানবাধিকার খবরের সম্পাদক এই প্রতিবেদককে বলেন, একজনকে উদ্ধার করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার যাতায়াত করতে হয়। ফলে যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, খোঁজ-খবর করা বা উদ্ধারের জন্য অনুসন্ধান চালানোসহ বিভিন্ন কাজে বহুটাকা ব্যয় করতে হয়।
অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও মানবতার কল্যাণে সাধ্যমতো তিনি এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। এই মূহুর্তে বিক্রমপুরের কিশোরী মায়া, বাগেরহাটের কুলসুম, যশোরের কিশোর আপন এবং নড়াইলের আশিকসহ আরো ৪-৫ শিশু-নারী উদ্ধারের অপেক্ষায় রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

 

নারী ও শিশু পাচার :
তৃতীয় বিশ^ বা গরীব দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে নারী ও শিশু পাচারের মতো জঘন্যতম, নিকৃষ্ট, অমানবিক ও সমাজবিরোধী অপরাধমূলক কাজটি বহুকাল থেকে চলে আসছে। তবে, বিগত দু’আড়াই যুগ ধরে এই অপরাধের প্রবণতা যেন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ থেকেও অসখ্য নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) এর তথ্যে মতে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ২০ হাজারের ও বেশি নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে।
পাচার রোধে সরকারের নজরদারি থাকা সত্ত্বেও পাচারকারীরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের একাধিক রুট দিয়ে নিত্যনতুন কৌশলে তারা নারী-শিশুদের ফাঁদে ফেলে পাচার করছে। কলেজপড়–য়া ছাত্রীদের বিয়ের প্রলোভন, দরিদ্র-অসহায় নারীদের বিদেশে গৃহপরিচারিকার কাজ, গার্মেন্টের নারীদেরও ভালো কাজের কথা বলে পাচার করা হচ্ছে। আর পাচারের শিকার ৬০ ভাগের বয়সই ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। নারী ও শিশুদের সহজে ফাঁদে ফেলতে পাচার কাজে নারী দালালদের বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে বলে । বিএনডব্লিউএলএ-এর গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভারতীয় একটি চক্র তাদের দালালদের মাধ্যমে প্রথমে পাচারকৃত নারীদের সংগ্রহ করে। আর প্রত্যেক নারীর জন্য দালালদের ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। পরে এসব নারীকে কলকাতা, মুম্বাই, হায়দরাবাদসহ বিভিন্ন শহরের পাচারকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিভিন্ন রুটের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের বিভিন্ন রুট দিয়ে আর সাতক্ষীরার কয়েকটি সীমান্ত দিয়েও ভারতে নারী পাচার হচ্ছে। অন্যদিকে সেন্টার ফর উইমেন্স অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজের তথ্যে, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশি নারী ও শিশু পাচার হয়েছে। এসব পাচার হয়ে যাওয়া উল্লেখসংখ্যক নারীদেরকে দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেহ ব্যবসা ছাড়াও নারী-শিশুদের দিয়ে অশ্লীল ছবি নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানোসহ মধ্যপ্রাচ্যের ধনী ব্যক্তিদের কাছে দাসী হিসেবে বিক্রি করা হয়। পাচারের উদ্দেশে কলকাতা, দিল্লী, মুম্বাই ও হায়দরাবাদকেন্দ্রিক পাচারকারী চক্র দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। তারা ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মফস্বলের ও গ্রামের উঠতি বয়সের কিশোরীদের ফাঁদে ফেলছে।
ভারতের যৌনপল্লিতে বাংলাদেশি নারী-শিশু :
বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের সঙ্ঘবদ্ধ পাচারকারীরা ভাগ্য বিড়ম্বিত নারী ও শিশুদের সরলতা ও অসচেতনতাকে পুঁজি করে তাদেরকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করে দিচ্ছে যৌনপল্লিতে। ফলে ভারতের যৌনপল্লিগুলোতে শিশু, কিশোরী ও নারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও কুষ্টিয়া ছাড়াও অন্যান্য এলাকার গ্রামাঞ্চলের অসহায় পরিবারের শিশু-নারীরাই প্রতারক চক্রের খপ্পড়ে পড়ছে। অনেক সময় এসব চক্রের সদস্যরা তাদের কাছের বা দূরের স্বজনদেরকেও টার্গেট করতে কুন্ঠাবোধ করেনা। এদিকে ভারতের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে আসা একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানান, ভারতের মুম্বাই, গোয়া, পুনে এই শহরগুলোর যৌনপল্লিগুলোতে উদ্বেগজনক হারে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়ছে। সূত্র মতে, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৬ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুম্বাই, গোয়া, পুনে, কেরালা, দামান ও তামিলনাডু থেকে উদ্ধারের পর অন্তত ৩৭০ জন নারী ও শিশুকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

নারী-শিশু উদ্ধারে মানবাধিকার খবরের অনুসন্ধান শুরু যেভাবে :
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। এক কলেজছাত্রীকে পাত্র দেখানোর নাম করে গ্রামের বাড়ি থেকে জেলা শহরে নিয়ে যায় তাঁর চাচাতো দুলাভাই। কলেজছাত্রী নাজমা বেগমের (ছদ্বনাম)
বাড়ি বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার একটি গ্রামে। পরিবার জানায়, ২৭ ফেব্রুয়ারি পাত্র দেখিয়ে বাড়িতে দিয়ে যাওয়ার কথা বলে মেয়েটিকে নিয়ে যায় আল আমিন (২৮) নামের তাঁর চাচাতো দুলাভাই। পরে মেয়েটি আর বাড়ি ফেরেননি। এ ঘটনায় এক সপ্তাহ বাদে ৮ মার্চ মেয়েটির বাবা কচুয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। একমাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ১ এপ্রিল রাতে নাজমা ফোন করে তার মায়ের কাছে। ফোনে সে জানায়, দুলাভাই তাকে না জানিয়ে সাতক্ষীরা নিয়ে এক মহিলার হাতে তুলে দেয়। ওই মহিলা তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। নাজমা জানায়, সে ভালো আছে বলে ফোন কেটে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের পক্ষ থেকে একাধিকবার কল ব্যাক করেও সংযোগ পওয়া যায়নি। এরপর ঢাকায় বসবাসকারি নাজমার মামা মানবিধাকার খবরের সম্পাদক ও প্রকাশক রোটা. মো. রিয়াজ উদ্দিনকে বিষয়টি জানানোর পর রিয়াজ উদ্দিন ওই নাম্বারে কল দেয়। তখন অন্য এক মহিলা কলটি রিসিভ করে এবং সে জানায় তার নাম সীমা। বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নন্দী গ্রামে। মহিলাকে রিয়াজ উদ্দিন নিজের পরিচয় দিয়ে তার ভাগ্নিকে সে কিভাবে পেল, ভারতেই বা গেল কিভাবে এসব প্রশ্ন করা হলে মহিলাটি এসব প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিছুটা জোরজবরদোস্তি করার পর মহিলাটি এক পর্যায়ে জানায়, নাজমাকে একটি বাসের মধ্যে অসহায় অবস্থায় দেখে ওর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম বাড়ি বাংলাদেশে। মেয়েটির অসহাত্বের কথা বিবেচনা করে ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি এবং আমার বিউটি পার্লারে একটি কাজ দিয়েছি। ও এখন ভালো আছে। এসময় মহিলাটি জানায়, অভিভাবকদের কেউ এলে তাঁর হাতে নাজমাকে তুলে দেওয়া হবে। এসময় ভাগ্নি সাথে কথা বলতে চাইলে মহিলাটি জানায় ঘন্টা খানেক পরে কথা বলিয়ে দেব। অথচ, ওই রাতে তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি। পরদিন সকাল থেকে চেষ্টার পর বিকেলে সংযোগ পাওয়া গেলে মহিলাটি জানায়, অধাঘন্টা পর কথা বলিয়ে দেব বলে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। আগাগোড়া মহিলার অসলগ্ন কথাবার্তায় সন্দেহ হওয়ায় ভাগ্নির খোঁজ করতে নাজমার মামা রিয়াজ উদ্দিন দ্রুত চলে যান কোলকাতায়। কোলকাতায় গিয়ে ওই নাম্বারে কল দেয়া হলে মহিলাটি অসৌজন্যমূলক আচরণ করে কলটি কেটে দেয় এবং ২-৩ দিন নাম্বারটি বন্ধ রাখে। অনেক চেষ্টা করে দিন তিনেক বাদে আবার সংযোগ পাওয়া গেলে এক পর্যায়ে মহিলাটি আমার ভাগ্নির সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দেয়। কিন্তুৃ ১০-১২ মিনিটের ফোনালাপে ভাগ্নির মুখ থেকে কোন তথ্য বের করা যায়নি। কারণ, সে যে একটি ভীতিকর পরিস্থিতিতে রয়েছে ফোনের কথাবার্তায় তা’ স্পষ্ঠ আভাষ পাওয়া যায়। প্রকৃত পক্ষে তার মুখ থেকে পাচারকারি চক্রের শিখিয়ে দেয়া বুলি’র প্রতিধ্বনি ফুটে উঠে। এক পর্যায়ে তার অবস্থান সম্পর্কে আমাকে কিছুই বলতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে ফোনটি কেটে দেয়। কয়েক ঘন্টা বাদে আবার কল দেয়া হলে মহিলাটি হুমকির সুরে বলে মেয়েটির ভালো চাইলে এই নাম্বারে আর কল দিবেন না। রিয়াজ উদ্দিন জানান, এই পরিস্থিতিতে পরদিন ৬ মে কলেজ শিক্ষার্থী নাজমাকে উদ্ধারের ব্যাপরে সহায়তা চেয়ে কোলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন, পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশন, রাজ্য পুলিশের কাছে আবেদন জানায়। পুলিশ উক্ত মোবাইল ফোন নাম্বারটি ট্র্যাকিং করে জানতে পারে মোবাইলের সিমটি ভারতের বিহার অথবা ঝাড়খ- রাজ্য থেকে ক্রয় করা। তবে, এইটি দিল্লিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাচারে সহায়তা করা স্বজনের ওপর চাপ সৃষ্টি, মোবাইল নাম্বারের সূত্র ধরে ও নানা ভাবে অনুসন্ধান চালানো হয়। ঢাকা-কোলকাতা-দিল্লি দৌড়-ঝাপ করতে হয় একাধিকবার। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে নিশ্চিত হওয়া যায় দিল্লি থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে রুদ্রপুরে নাজমা অবস্থান করছে। দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন ও দিল্লির স্টপ নামের একটি মানবাধিকার সংগঠনের সহযোগিতায় প্রায় আড়াই মাস বাদে উত্তরাখন্ড রাজ্যের রুদ্রপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করা হয়। ফিরে আসে মা-বাবার কোলে। উদ্ধারের পর নাজমা জানায়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে তাকে দিল্লিতে এক মহিলার হাতে তুলে দেয়া হয়। ওই মহিলার ইশারায় তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখা হয় তাকে। অনেক দফা চেষ্টার পর পালিয়ে দিল্লির গ্রীন পার্ক এলাকায় প্রিয়া নামের এক মহিলার কাছে আশ্রয় নেয়। প্রিয়ার কাছে আশ্রয় নেয়ার পর বাংলাদেশে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে নাজমা। পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে ফেরতের ব্যাপরে সহায়তা চাওয়া হলে প্রিয়া পাশ কাটিয়ে যায়। পরে নাজমা বুঝতে পারে আবারো সে দুষ্টু প্রকৃতির মহিলার খপ্পরে পড়েছে। প্রিয়াও অসৎ উদ্দেশে তাকে আশ্রয় দিয়েছে। সাবানার বাড়ি বাংলাদেশে এবং সে এখন বিপদগ্রস্থ্য জানিয়ে ওই বাড়ি কেয়ার টেকারের অমিতের সাহায্য প্রার্থনা করে। মানবিক দিক বিবেচনা করে অতি গোপনে ও সুকৌশলে নাজমাকে দিল্লি থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে নিজ গ্রামের বাড়ি রুদ্রপুরে নিয়ে যায় অমিত। তারপর পরিবারকে খবর দেয়া হলে সেই খবরের ভিত্তিতে পাচারকারিদের হাত থেকে রক্ষা পায় নাজমা।
এদিকে প্রায় আড়াই মাস অনুসন্ধান চালিয়ে ভাগ্নিকে পাচারকারির হাত থেকে উদ্ধারে সফল হওয়ার খবরটি চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে, পাচার হয়ে যাওয়া শিশু-নারী’র অনেক পরিবারের সদস্য এবং স্বজনেরা ছুটে আসে মানবিধাকার খবরের সম্পাদক ও প্রকাশক রোটা. মো. রিয়াজ উদ্দিনের কাছে। কেউ তাদের সন্তান আবার কেউ স্বজনকে উদ্ধারে সহায়তা চান তারা। নিজ ভাগ্নি পাচার হয়ে যাওয়ার ঘটনায় অনুভূত মনের ব্যাথা ও মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে শিশু-নারী’ উদ্ধার কাজ শুরু করেন রোটা. মো. রিয়াজ উদ্দিন। এক এক করে ভারতের উত্তরাখ- প্রদেশের রুদ্রপুর থেকে পাচার হয়ে যাওয়া বাংলাদেশী কলেজছাত্রী নাজম বেগম, হায়দ্রাবাদ থেকে গৃহবধু মুন্নি, পশ্চিমবঙ্গের লক্ষীকান্তপুর থেকে শার্শার কিশোর বিপ্লব, হুগলী থেকে গাইবান্ধার মানুষিক প্রতিবন্ধী সালমা, দিল্ল¬ীর তিহার জেল থেকে পটুয়াখালীর বিউটি আক্তার, খুলনার শিশু সুমন, শারীরিক প্রতিবন্ধী সজীব ঢালী, দিল্লী থেকে কলেজ ছাত্রী অর্থি ও সর্বশেষ কিশোর ছামিরুলসহ এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ নারী-শিশুকে ভারত থেকে সাফল্যের উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে এনে মা-বাবা ও আইনের হাতে তুলে দিয়ে সাফল্য দেখিয়েছে।
এছাড়া ভারতীয় কিশোরী বৈশাখী ও পাকিস্তানের নাগরিক প্রকৌশলী অনিল কুমারকে বাংলাদেশ থেকে উদ্ধারের সার্বিক সহযোগিতা করে নিজ দেশে পাঠাতে সহায়তা করে মানবাধিকার খবর।
সংসার করছে, ভালো আছে নাজমা :
স্বজনের সহযোগিতায় কলেজ ছাত্রী নাজমা পাচার হয়ে গিয়েছিল ভারতে। একাধিক পাচারকারি চক্রের কবলে পড়ে চার দেয়ালের অভ্যন্তরে বন্দী হয় সে। তার জীবনে নেমে আসে এক অন্ধকার জগৎ। বন্দী অবস্থায় তাকে অনেক অত্যাচার, অনাচার, নীপিড়ন, নির্যাতন সহ্য করতে হয়। কয়েকদফা প্রচেষ্ঠার পর এক সহানভুতিশীল মানুষের আন্তরিক সহযোগীতায় নিরাপদ আশ্রয় পায় সে। এরপর মামা রিয়াজ উদ্দিন ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের রুদ্রপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে তাকে উদ্ধার করে। ফলে, প্রায় আড়াই মাসের মাথায় পিতা-মাতার কোলে ফিরে আসে নাজমা ফিরে পায় এক নতুন জীবন। এরই মধ্যে নাজমার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী একজন মৎস্য ব্যবসায়ী। নাজমার কোলে এখন এক বছর বয়সের পুত্রসন্তান। স্বামী ও শিশুকে নিয়ে সংসার করছে এবং ভালো আছে নাজমা।

মানবাধিকার খবরের সহায়তায় ভারতে ফিরলো বৈশাখী :
ভারতে পাচার হয়ে যাওয়া নারী-শিশু উদ্ধারের পাশাপাশি ভারত থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এক কিশোরীকে তিন বছর আগে মায়ের কাছে ফেরত পাঠাতে সহায়তা করেছে মানবাধিকার খবর। বৈশাখীর মা নিবেদিতা কান্ডার কলকাতার আলীপুর ভবানী ভবনে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পুলিশ সুপার শান্তি দাসকে এক লিখিত অভিযোগ জানান। আমার নাবালিকা কন্যা বৈশাখী গোসাবা থানার রাঙা বেলিয়া উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেুণীর ছাত্রী। প্রতিদিনের ন্যায় বিগত ২০১৬ সালের ২১ জুন সকাল ১০টায় বৈশাখী স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। স্কুলে যাওয়ার সময় ঠিকাদার ব্যবসায়ী অনিমেশের এক কর্মচারি বৈশাখীকে উক্ততো করার অভিযোগ রয়েছে। তাই, সর্বত্র খোঁজাখুজি করে না পেয়ে উক্ত অনিমেশকে জিজ্ঞাসা করা হলে, সে জানায় তার কর্মচারি স্বপন মালি¬ক বৈশাখীকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে। এই কথা শুনে বৈশাখীর অভিযোগ করে বলেন, অনিমেশ ও তার স্ত্রীর সহযোগীতায় স্বপন তার নাবালিকা কন্যাকে অপহরণ করে অসৎ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পাচার করেছে। তার মেয়েকে উদ্ধার ও পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার জন্য পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করেন বৈশাখীর মা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসবা থানায় একই বছর ২৫ জুন মাসে এ সংক্রান্ত একটি ডায়েরিও করা হয়। যার সং-১২৬। অন্যদিকে বৈশাখীর মায়ের অনুরোধের ভিত্তিতে মানবাধিকার খবরের সম্পাদক ও প্রকাশক রোটা. মো. রিয়াজ উদ্দিন বিষয়টি অনুসন্ধান করেন। মানবাধিকার খবর অনুসন্ধান করে জানতে পারে, বৈশাখী স্বপনের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তখন বৈশাখীর মা-বাবা বৈশাখীকে অন্যত্র বিবাহ দেওয়ার উদ্যোগ নিলে সে স্বপনের সাথে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বৈশাখীকে নিয়ে স্বপন বাংলাদেশে চলে আসে এবং বরিশালের বানরী পাড়ায় তার নিজ গ্রামের বাড়িতে উঠে। পরবর্তীতে মানবাধিকার খবরের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশস্থ ভারতীয় দূতাবাস, জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, প্রশাসন, র‌্যাব ও পুলিশের বিশেষ ভূমিকায় বৈশাখীকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এবং একই বছরের ডিসেম্বর মাসে মানবাধিকার খবরের পক্ষ থেকে বৈশাখীকে সব ধরণের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তার মায়ের হাতে তুলে দেয়া হয়।
সর্ব শেষ উদ্ধার :
মানবাধিকার খবরের প্রচেষ্ঠায় সর্ব শেষ ভারত থেকে উদ্ধার করা হয় ১১ বছরের বাংলাদেশী কিশোর মো. ছামিরুল। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে ৬ বছর আগে ২০১৩ সালে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল কিশোর ছামিরুল। অনেকদিন আগে থেকে আজমীর শরীফ দেখবার স্বপ্ন ছিল কিশোর ছামিরুলের। তাই, ভারতে পালিয়ে সোজা চলে যায় আজমীর শরীফ। সেখানে কাটিয়ে দেয় কয়েক বছর। ওখানে এক দোকানে দর্জির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে সে। আজমীর শরীফ দেখবার শখ মিটে গেলে স্বদেশের ফিরে আসবার উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ অভিমুখে রওনা দেয়। পশ্চিমবঙ্গে কোলকাতায় পৌঁছে ট্রেন থেকে নামার পর রেল স্টেশনেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ছামিরুল। পরে তাকে পশ্চিমবঙ্গের একটি এনজিও’র হেফাজতে পঠিয়ে দেয় পুলিশ।
এদিকে শোকে কাতর নিখোঁজ হওয়া সন্তানের বাবা-মা’র অনুরোধে মানবাধিকার খবরের সম্পাদক ও প্রকাশক রোটা. মো. রিয়াজ উদ্দিন ছামিরুলকে উদ্ধার কাজে এগিয়ে আসেন। একাধিকবার ভারতে গিয়ে ছামিরুলকে উদ্ধারে বিভিন্ন পর্যায়ে অনুসন্ধান ও প্রচেষ্ঠা চালিয়ে সফল হন তিনি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ধার করে এনে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ছামিরুলকে তুলে দেন পিতা-মাতার হাতে।
উদ্ধার কাজে সহায়তায় দিয়েছেন যারা :
মানবাধিকার খবরের সম্পাদক ও প্রকাশক রোটা. মো. রিয়াজ উদ্দিন জানান, পাচার হয়ে যাওয়া নারী-শিশু উদ্ধার কাজে দু’দেশে যাদের সহযোগীতা-সহায়তা পেয়েছেন তারা হচ্ছেন, দিল্লিীর হাই হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, কাউন্সিলর মোশারফ হোসেন, কলকাতাস্থ উপ-হাইকমিশনার তৌফিক হাসান, কাউন্সিলর ও হেড অব চ্যাঞ্চেলর মিয়া মো. মাইনুল কবির, ফাষ্ট সেক্রেটারী (প্রেস) মো. মোফাক্কারুল ইকবাল, কাউন্সিলর বি এম জামাল হোসেনসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান ও কাজী রিয়াজুল হক, জাতীয় মহিলা আইনজিবী সমিতি, যশোর রাইট, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও প্রধান বিচারপতি গিরিশ চন্দ্র গুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নপরাজিৎ মূখার্জি, রাজ্য সভার সংসদ সদস্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য, লোকসভার সংসদ সদস্য ও চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান শ্রীমতি প্রতিমা ম-ল, আলিপুর ভবানী ভবনে দক্ষিন ২৪ পরগনায় জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শ্রীমতি শান্তি দাস, জেলা ইন্টেলিজেন্ট ব্রাঞ্চের নিবেদিতা তালুকদার এডিশন সেক্রেটারি ফরেনার্স গভ পশ্চিমবঙ্গ হোম ডিপার্টমেন্ট গৌরাঙ্গ সরকার। জেলা শিশুরক্ষা সমিতির কর্মকর্তা অনিন্দ ঘোষ, কলকাতার সল্টলেকে বিকাশ ভবনে অবস্থিত শিশু রক্ষা প্রোগ্রাম ম্যানেজার সুচরিতা, প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি অমর সাহা, মানবাধিকার খবর পত্রিকার কলকাতা প্রতিনিধি দিশা বিশ্বাস, ভারত প্রতিনিধি মনোয়ার ইমাম, বারাসাত প্রতিনিধি প্রদীপ রায় চৌধুরী, মানবাধিকার খবরের কলকাতাস্থ আইন উপদষ্টা রাজীব মুখার্জি, নিলোৎপল মৈত্র এবং রিয়া সেন প্রমুখ।