বিনোদন
  চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মনবতার জন্য কাজ করে গেছেন তিনি না ফেরার দেশে বাংলা চলচ্চিত্রের সিংহপুরুষ আমজাদ হোসেন
  20-01-2019

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা ৫৭ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। এ তথ্য দেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন।
গত ১৮ নভেম্বর রোববার সকাল ৯টার দিকে আমজাদ হোসেনের স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার তাঁকে (আমজাদ হোসেন) বিছানার নিচে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। কখন তিনি অচেতন হয়েছেন, তা আঁচ করতে পারেননি সুরাইয়া আক্তার। এরপর সকাল ১০টার দিকে তাঁকে ইমপালস্ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারপর হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। চিকিৎসকরা জানান, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয় আমজাদ হোসেনের। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ২৭ নভেম্বর রাত আড়াইটার দিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে ব্যাংকক নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর হার্টবিট, ব্লাডপ্রেশার এবং কিডনি ইনফেকশনের জন্য ডায়ালাইসিস চলছিল বলে জানান তাঁর ছেলে সোহেল আরমান। আমজাদ হোসেন অভিনেতা, পরিচালক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। ১৯৬১ সালে ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্র শুরু করেন তিনি। পরে চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনা করেন। তার নির্মিত চলচ্চিত্র ও উপন্যাস কয়েক প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সঙ্গী। আপন সৃষ্টিকর্ম তাকে স্মরণীয় করে রাখবে। `আমজাদ হোসেন` নামটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে চিরদিনের জন্য লেখা থাকবে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মনবতার জন্য কাজ করে গেছেন তিনি। তার শুন্যেতা কখনই পূরণ হবার নয়।
আমজাদ হোসেনের পরিচালনায় জনপ্রিয়তা পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়নমনি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘ভাত দে’, ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘কাল সকালে’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’ ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ ইত্যাদি। সাহিত্য রচনার জন্য তিনি ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে দুবার অগ্রণী শিশু সাহিত্য পুরস্কার ও ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার লাভ করেন।
বরেণ্য এই চলচ্চিত্রব্যক্তিত্বর প্রতি তারকাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি-

সোহেল রানা

আমজাদ ভাইয়ের প্রস্থান বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করবে। চলচ্চিত্র শিল্পে তার যে অসামান্য অবদান তা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। ব্যক্তি হিসেবেও অসাধারণ মনের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার কোনো ছবিতে আমার অভিনয় না করা হলেও প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা হতো। সহাস্য প্রকাশভঙ্গি দেখা হলেই বুকে জড়িয়ে ধরতেন। এই সরলতা মাখা মানুষের মুখখানি আর দেখতে পারব না, মেনে নিতে কষ্ট হয়।

আলমগীর

প্রতিটি মৃত্যু কষ্টের, কিন্তু মেনে নিতে হয়। মাস খানেক আগে যখন শুনলাম তিনি হঠাৎ অসুস্থ। তখন থেকে মনের ভেতর অজানা আশঙ্ক্ষা ভর করেছিল। তার মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। তার পরিচালনায় আমি `ভাত দে` চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলাম। ছবিটি এখনও মানুষের পছন্দের ছবির তালিকায় আছে। কর্মজীবনে যেমন সফল ছিলেন, ব্যক্তি হিসেবেও অসাধারণ ছিলেন আমজাদ হোসেন।

কবরী

আমজাদ হোসেন শুধু একজন চলচ্চিত্রকারের পরিচয়ে আবদ্ধ থাকেননি, ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তার মৃত্যুতে আমি গভীর শোকাহত। স্বাধীনতার আগে তার পরিচালনায় `পিতাপুত্র` ছবিতে কাজ করেছিলাম। এর পর তার লেখা পড়েছি। তার লেখা নিয়ে নির্মিত নাটক ও চলচ্চিত্র দেখেছি। সৃষ্টিকর্মের ভেতর দিয়ে তিনি নিজেকে বারবার ভেঙে গড়েছেন। তার এই গুণটি আমাকে আশ্চর্য করত। আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে তার মতো মেধাবী নির্মাতার অভাব আছে, যিনি মেধা ও মননে ছিলেন অনেক বেশি পরিণত ও পরিশীলিত। চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি যখন দুঃসময় পার করছিল, তখনও তিনি দৃঢ়চিত্তে অশুভ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মনবতার জন্য কাজ করে গেছেন তিনি।

ফারুক

আমজাদ ভাইকে নিয়ে কী বলব! তার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা ছাড়া তার সবই জানতাম আমি। আমরা দু`জন এক আত্মা, এক মন, এক প্রাণ। হয়তো তার সঙ্গে আমার অনেক কিছুর অমিল হতেও পারে। কিন্তু মানুষকে শ্রদ্ধা করা, ভালোবাসা, সম্মান প্রদর্শন- এই বিষয়গুলোতে আমাদের প্রচ- মিল ছিল। আমাদের আরও বহুদূর পথচলার কথা ছিল। কিন্তু সেই পথচলা নিজেরাই ধ্বংস করে দিয়েছি। আমজাদ ভাই অনেক বড় মনের একজন মানুষ ছিলেন, বড় মাপের নির্মাতাও তিনি। সর্বোপরি ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। আমাদের দেশে তার মতো চলচ্চিত্র পরিচালকের আদৌ জন্ম হবে কি-না সন্দেহ আছে। তাই তাকে হারিয়ে আজ আমরা শূন্য হয়ে পড়েছি। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। আমজাদ ভাইয়ের মৃত্যু যেন আমাকে অতল বিষন্নম্নতায় ঠেলে দিয়েছে। তার সঙ্গে হাজারো স্মৃতি কখনোই ভুলতে পারব না। আমার চোখে তিনি ছিলেন একজন ম্যাজিশিয়ান। প্রতিটি সৃষ্টকর্মে তিনি তা প্রমাণ করেছেন।

ইলিয়াস কাঞ্চন

চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে আমজাদ ভাইয়ের অবদান নতুন করে কিছু বলার নেই। শুধু একজন পরিচালক নন, সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমের প্রতি ছিল তার দুর্নিবার আর্কষণ। তিনি নেই যেমন সত্য, তেমনি এমন একজন মেধাবী পরিচালকের শূন্যস্থানও কোনোদিন পূরণ হওয়া সম্ভব নয়।

সুচন্দা

একজন আমজাদ হোসেন। গুণী মানুষটি আমাদের মাঝে নেই, ভাবতে পারছি না। খরবটি শোনার পর থেকেই যেন সব কিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে। নির্মাতা, লেখক, অভিনেতা সব পরিচয়ে তিনি ছিলেন অনবদ্য। তার মতো মানুষের মৃত্যুতে চলচ্চিত্রে সত্যিকারের একজন অভিভাবককে হারাল। সৃষ্টিকর্তার কাছে তার জন্য অনেক অনেক দোয়া করছি।

চম্পা

`গোলাপী এখন ট্রেনে` ছবি দিয়ে আমার বড় বোন ববিতা বেশ সাড়া ফেলেছিলেন। তখনই ভেবেছি, এ রকম একজন নির্মাতার ছবিতে অভিনয় করেতে পারতাম! আমার সেই আশা পূরণ হয়েছে `গোলাপী এখন ঢাকায়` ছবির মাধ্যমে। এটা আমার অভিনয়জীবনে অন্যতম একটি অর্জন। আমি আমজাদ হোসেনের মতো নির্মাতার ছবিতে কাজের সুযোগ লাভ করেছি। তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। প্রিয় এই নির্মাতা আজ আমাদের মাঝে নেই, এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে।