আন্তর্জাতিক
  আমাদের ৭১ ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী
  03-11-2018


শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ১৯১৭ সালে ১৯ নভেম্বর ভারতের বিখ্যাত নেহেরু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বাবা প-িত জওহর লাল নেহেরু, মা কমলা দেবী। ভারত বর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পথিক কংগ্রেস নেতা মতিলাল নেহেরুর নাতনি, সেই সুবাদেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। পড়াশোনা শেষ করেন অক্সফোর্ডে ফিরে এসে, ১৯৩৪-৩৫ সালে যোগ দেয় শান্তিনিকেতনে। ১৯৪২ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে। এরপর থেকে রাজনীতিতে তার উত্থান ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাবা জওহরলাল নেহেরুর অতিমাত্রিক কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের চিফ অব ষ্টাফ হিসেবে কাজ করেন। বাবার মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধীকে বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রস্তাব দেওয়া হয় তিনি এ প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকার করে ক্যাবিনেট মিনিস্টারের পদ বেছে নেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন অধিকার করেন। মেধা সম্পন্ন গুনী রাজনীতিক নেত্রী মোট ১৫ বছর ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দেহরক্ষীর হাতে নির্মমভাবে হত্যা হয় ইন্দিরা গান্ধী।
আমরা যে স্বাধীন বাংলায় বাস করছি আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে তার যে ভূমিকা ছিল হয়তো এই প্রজন্মের অনেকেই জানেনা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বোচ্চ সাহায্যকারী ও পরম বন্ধু হিসেবে বাঙ্গালী জাতী ১৯৭১ -এ তাকে কাছে পেয়েছে।
বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলিয়ে গড়ে তোলা পাকিস্তান নিয়ে বিভিন্ন রকমের সমস্যা ছিলো। পশ্চিম পাকিস্তান ছিলো বর্তমান পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান ছিলো বর্তমান বাংলাদেশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান ছিলো, ভাষা, সংস্কৃতি জীবনমান, নানারকম পার্থক্য। তখন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিয়ত পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে বৈষ্যম্যের শিকার হতে হয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে অপমান, অবহেলা, অসম্মান, ঘৃণা, বঞ্চনা পেতে হতো। অথচ সমাজ, উন্নয়ন, রাজনীতি, অর্থনীতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নে পূর্ব পাকিস্তান অনেক বেশি অবদান রাখা সত্ত্বেও সবকিছুর অধিকার লাভ করত পশ্চিম পাকিস্তানীরা। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ধীরে ধীরে গড়ে তুলে আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। যার ফলে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
আমাদের স্বাধীনতা অর্জন বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে এসেছে। দেশের স্বার্থে আমাদের সাহায্য নিতে হয়েছে মিত্র দেশগুলোর, এদের মধ্যে দেশ ভারত ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। তখন ভারত উন্নয়নশীল দেশ হলেও অর্থনীতি খুব যে বেশী ছিল তা নয়, তার পরও ইন্দিরা গান্ধী আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ৭ হাজার কোটি রূপীর বেশী খরচ করেছেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এ দেশ থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রতিবেশী ভারতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পাড়ি জমিয়েছে। তখন কোটি কোটি মানুষের প্রবেশকে তিনি বাধাগ্রস্ত করেননি বরং বাঙালী শরনার্থীদের থাকা-খাওয়া সব ধরনের ব্যবস্থা করে এক মানবতার দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
ইন্দিরা গান্ধী যখন বাংলাদেশকে সাহায্য করছিল তার উপর বড় বড় সব রাষ্ট্রের খুব চাপ ছিল কিন্তু তিনি কারো কথায় কর্ণপাত না করে অনেক ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সংগ্রামে এক হয়েছিলেন। তখন পাকিস্তানকে সাহায্য করে আমেরিকা। সে সময় ভারতের রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থায় যেমন মজুদ ছিল কিছু আমেরিকা পন্থী তেমনি ছিল কিছু রাক্ষিয়া পন্থী। তিনি যে সিদ্ধান্তই নিতেন সেটাইতেই কোনো না কোনো সমস্যার উদ্ভব হয়েছে কেউ না কেউ বাধা হয়েছে। চীন ছিল পাকিস্তান পন্থী। তাই পাশের দেশ চীন থেকে কোনো হুমকি আসতে পারা এবং অনেক বিরোধীতা চারিদিক থেকে অস্থিরতা সব ছাপিয়ে অনেক ঝুঁকি নিয়ে আমাদের পাশে দাড়িয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
মুজিবনগর সরকার গঠনের পর এদেশের কার্যক্রম চালানো অনেক কষ্টকর হয়ে দাড়িয়েছিল প্রতিটি মানুষ আতঙ্কিত অবস্থায়, বঙ্গবন্ধু জেলে ঠিক সে সময় এ সরকারকে অস্থায়ীভাবে ভারতে অবস্থান করার ব্যবস্থা করে দেন ইন্দিরা গান্ধী এ সরকারের কাজ শুরু হয় কলকাতায় প্রধান দফতর হিসেবে। কলকাতা থেকেই বিশ্বের কাছে নিজেদের চাওয়া-পাওয়া ও পাকিস্তানের গণহত্যা, নিপিড়ণ সব ধরনের অত্যাচারের খবর তুলে ধরেছে। তারপর সব দেশ থেকে জোরদার সমর্থন গড়ে উঠে আমাদের দেশের পক্ষে। ১৮ এপ্রিল -এ ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর আমেরিকা আর লন্ডনের সঙ্গে ইতিবাচক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও আর বেশি বাধা আসেনি। তিনি বাংলাদেশকে রেডিও স্টেশন স্থাপন আর পরিচালনার ব্যবস্থা করে দেন। যার কারণে নিজের দেশ ও বিদেশের কাছে বাংলাদেশ সব তুলে ধরতে পেরেছে। যুদ্ধের সময় এই রেডিও মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক সাহায্য দিয়েছে, জনগণও খবরাখবর পেয়েছে।
দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর অনুমোদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপর তিন দিনের একটি বিশেষ সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন বাংলাদেশ আয়োজন করা হয়। সম্মেলনে অংশ নেয় ২৪টি দেশের প্রায় ১৫০ জন দূত। ২০ সেপ্টেম্বর এ সম্মেলনের মাধ্যমেও পুরো বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে সকলকে অনুরোধ করেন। ১৯৭১ সালের ১৩ মে বেলগ্রেডের রাজধানী বুদাপেস্টে বিশ্ব শান্তি কংগ্রেসের একটি সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের কথা বলেন সম্মেলনে ৮০টি দেশের ৭০০ জন প্রতিনিধি অংশ নেয়। তাদের কাছেও শুধু বাংলাদেশের জন্য সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি। বিবিসি, নিইউয়র্ক টাইমস্, লন্ডন টাইমস্ ইত্যাদি -তে তার দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণরক্ষা ও মুক্তির দাবিতে একটি চিঠি পাঠান। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্যের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বলে স্বীকৃতি দেন, খুব সচেতন ভাবে পূর্ব বাংলা শব্দটি ফেলে বাংলাদেশ শব্দটির প্রবেশ করান তিনি।
আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে দীর্ঘ ৯ মাস সকল বাধা অতিক্রম করে আমাদের জাতিকে সর্বোচ্চ সহযোগীতায় যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছে “শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী” আমরা তাকে কৃতজ্ঞতা ও বিন¤্র শ্রদ্ধা জানাই, আমাদের বাঙ্গালীর ইতিহাসে চিরদিন তার নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত প্রজ্বলীত হয়ে থাকবে।