বিশেষ প্রতিবেদন সুশাসন ও জবাবদিহিতার চরম অভাব মানুষ হত্যা ও পরিবহনের নৈরাজ্য, কেরে নিচ্ছে নাগরিক অধিকার ॥ মানবাধিকার খবর প্রতিবেদন ॥ মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, সমস্যা সমাধানে সরকারের মনে হয় এই একটিই উপায় আছে। তা হচ্ছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’। যখন দেশে সুশাসন ও জবাবদিহির চরম অভাব হয়, তখনই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ জাতি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। পরিবেশ আন্দোলনকর্মী উত্তম হত্যার বিচার, সড়কপথে পরিবহন নৈরাজ্য ও মানুষ হত্যা বন্ধের দাবিতে এক প্রতিবাদ সভায় কথাগুলো বলেন সুলতানা কামাল। রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সামনে ২ জুন সকালে এ সভার আয়োজন করে ২৪টি নাগরিক সংগঠন। গত ২১ মে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডে বাসের ধাক্কার পর ট্রাকচাপায় নিহত হন পরিবেশ আন্দোলনকর্মী উত্তমকুমার দেবনাথ। সমাবেশে বাপার সহসভাপতি সুলতানা কামাল বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৬ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এ দেশের মানুষ যেখানেই যাচ্ছে, মরিয়া হয়ে ছুটে যাচ্ছে। অন্যকে মাড়িয়ে কেন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা? এর কারণ পুরো সমাজে অনাচার ঢুকে পড়েছে, যার খেসারত দিচ্ছি আমরা সবাই মিলে।’ সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই, সংবেদনশীলতা ভোঁতা হয়ে গেছে। যাঁরা দেশ পরিচালনা করছেন, এ বিষয়গুলো নিয়ে তাঁদের ভাবতে হবে। আমরা সচেতনতা সৃষ্টির জন্য দাঁড়িয়েছি। সমাবেশে বাপার আরেক সহসভাপতি রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগীদের কান্না নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছায় না। আমরা তাঁদের দেশ পরিচালনার অর্থ জোগান দিচ্ছি, তাঁরা আমাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ দেশের মানুষকে সোচ্চার হতে হবে।’ সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, বাপার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন, যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ প্রমুখ। বক্তারা বলেন, সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এ কাজে সরকারকে সহায়তা করতে প্রস্তুত তাঁরা। সমাবেশে উত্তমের পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ ও ১৬টি দাবি জানিয়েছে ২৪টি সংগঠন।
রাজধানীর সহ গণপরিবহনে নজিরবিহীন নৈরাজ্য অব্যাহত রয়েছে। নগরীর পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগও নেই। ভাড়া আদায়ে স্বেচ্ছাচারিতা, সিটিং, গেটলক, স্পেশাল সার্ভিসের নামে প্রতারণা, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন গাড়ির ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে গণপরিবহন এখন যাত্রীদুর্ভোগের নিত্য বাহন হয়ে উঠেছে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থের সিন্ডিকেটের কারণে পদে পদে লাঞ্ছনা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাজধানীতে ছোট গাড়ির বিস্তার, সিটি সার্ভিসে ট্রাফিক নৈরাজ্য, চালকদের আইন না মানার প্রবণতা, অতিরিক্ত যাত্রী তুলতে বাসের প্রতিযোগিতা সহ বিভিন্ন কারণেই রাজধানীর গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। উপরন্তু যানবাহনের তুলনায় নগরীতে রাস্তার পরিমাণও কম, মাত্র ৮৮ কিলোমিটার। এর মধ্যেই চলছে রিকশা ও হিউম্যান হলার বাদেই প্রায় সাড়ে ৫ লাখ যানবাহন। বিদ্যমান রাস্তার ও এক-তৃতীয়াংশ বেদখল হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী যান চলাচলের জন্য কোনো শহরের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ রাস্তা থাকা উচিত। রাজধানীতে সড়ক রয়েছে আয়তনের প্রায় ৮ শতাংশ। ফলে যানজট নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। তার পরও প্রতিদিন নগরীতে ব্যক্তিগত গাড়ি নামছে ৬০টির বেশি। অন্যদিকে দিনে দেড় শর বেশি মোটরবাইক নামছে রাজপথে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রাজধানীর গণপরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধ করা যাবে না। এদিকে নগর পরিবহনে সিটিং, ডাইরেক্ট, গেটলক ও স্পেশাল সার্ভিসের নামে নজিরবিহীন নৈরাজ্য চলছে। মোটরযান আইন, সরকার নির্ধারিত ভাড়া সবকিছু উপেক্ষা করে যথেচ্ছ হয়রানিতে লিপ্ত পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। ফলে যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে মালিকদের নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়া। সেটাও কিলোমিটার হিসাবে নয়, পরিবহন মালিকদের ইচ্ছামতো চাপিয়ে দেওয়া। অল্প দূরত্বের যাত্রীকে গুনতে হচ্ছে পুরো পথের ভাড়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অল্প দূরত্বের যাত্রীদের বাসেও তোলা হচ্ছে না। বিশেষ করে সিটি সড়কের মধ্যবর্তী এলাকার যাত্রীদের ভোগান্তিকে সঙ্গী করে গন্তব্যে যাতায়াত করতে হয়। রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে মতিঝিলে অফিস করেন সরকারি বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য কর্মজীবি মানুষ। তাদের প্রতিদিন সকালে অফিসে যেতে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। সকালে মিরপুর-পল্লবী থেকে যেসব বাস ছেড়ে আসে তার প্রায় সবই “সিটিং”, “গেটলক” হিসেবে দরজা বন্ধ করে মাঝপথের হাজার হাজার যাত্রীর সামনে দিয়ে গন্তব্যের দিকে চলে যায়। তারা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তালতলা, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়ার যাত্রীরা এ সময় বাসে উঠতে পারেন না। এজন্য তাদের সকাল ৯টার অফিস ধরতে ৭টার আগেই রাস্তায় নামতে হয়। ভাড়া ডাইরেক্ট, সার্ভিস লোকাল রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসগুলোর মালিক সমিতি সিটিং, ডাইরেক্ট, লোকাল সিটিং, গেটলক, স্পেশাল ইত্যাদি বাহারি নামে যাত্রীপীড়নের সব পন্থা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে। অনেক বাসে একটাই ভাড়া, যাত্রী যেখানেই নামুক না কেন। ভাড়া ডাইরেক্ট হলেও যাত্রী কম পেলে তারা যে কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকাল বাসের মতোই যাত্রী তুলতে দ্বিধা করে না। টঙ্গী-সদরঘাট রুটে চলাচলকারী সুপ্রভাত পরিবহন একসময় ছিল এই রুটের সবচেয়ে খারাপ বাস সার্ভিস। এটি এখন ‘সুপ্রভাত স্পেশাল সার্ভিস’ নাম দিয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করছে। তাদের ১৫ টাকার নিচে কোনো ভাড়া নেই। যাত্রী তোলে হাত দেখালেই। পরিবহন কর্মীরা ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে প্রায়ই দুর্ব্যবহার করেন। সম্পতি ‘আকাশ সুপ্রভাত স্পেশাল সার্ভিস’ নামে উত্তরা দিয়াবাড়ী থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত নতুন সার্ভিস চালু করেছেন তাদেরই সহযোগীরা। জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার দিয়ে টঙ্গী থেকে মিরপুরে চলাচলকারী বাসগুলোও গলা কাটা ভাড়া আদায় করে। শুধু ফ্লাইওভার পার হতেই ২০ টাকা আদায় করে এই রুটে চলাচলকারী সব পরিবহন। লোকাল বাসের খোঁজ নেই যানবাহন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর কার্যকর তদারকির অভাবে বর্তমানে মিরপুর-মতিঝিল বা মিরপুর-গুলিস্তান রোডে কোনো লোকাল বাস নেই। সব সার্ভিসই ডাইরেক্ট, সিটিং। কিন্তু অফ পিকআওয়ারে এসব বাস চলে লোকালের মতো, ভাড়া দিতে হয় ডাইরেক্ট বাসের। একই অবস্থা মিরপুর থেকে নগরীর অন্য রুট গুলোয় চলাচলকারী বাস সার্ভিসের ক্ষেত্রেও। মিরপুর থেকে চলাচলকারী চয়েজ, সিল্কসিটি, বিকল্প, বিহঙ্গ, শিখর, ইটিসি, ইউনাইটেড, দিশারী, নিউভিশন, সুপার সিটিং, শিকড়সহ বিভিন্ন কোম্পানির মিনিবাস সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলছে। এ ছাড়া বিমানবন্দর সড়কে চলাচলকারী গাজীপুর পরিবহন, প্রভাতী, আজমেরী, সুপ্রভাত স্পেশালসহ আরও কয়েকটি পরিবহন একই কায়দায় সিটিংয়ের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যখন বিভিন্ন কারণে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমে যায় তখন যাত্রীদের দুর্ভোগ পুঁজি করে লোকাল মিনিবাসগুলোও ‘সিটিং সার্ভিস’ ঘোষণা করে। এমনকি দ্বিগুণ-তিন গুণ ভাড়া আদায় করতেও দ্বিধা করে না। অভিযোগ শোনার কেউ নেই : অনিয়ম দূর করা দায়িত্ব যাদের, তাদের নাকের ডগায় এভাবে অনিয়ম ঘটছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএতে যাত্রীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থাই নেই। তারা মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার উদ্যোগ নিলেও পুলিশি সহযোগিতার অভাবে তা কার্যকর হয় না। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে বেপরোয়া। পুলিশও প্রায় সব ক্ষেত্রেই নির্বিকার থাকে। যাত্রী তুলতে এবং আগে যেতে পরস্পরের সঙ্গে বাসের রেষারেষিতে প্রায়ই জীবনহানির মতো ঘটনা ঘটে। মাঝে মাঝেই দুই বাসের মাঝে পড়ে পথচারীর মৃত্যু ঘটছে সড়কে।সম্প্রতি রাজধানীর ফার্মগেটে দুই বাসের মাঝে পড়ে বাঁ হাত হারিয়েছেন রাজীব হোসেন (২২) নামে এক যুবক। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নগর পরিবহনের নৈরাজ্য রোধে যাত্রীদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটিতে (মেট্রো আরটিসি) যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। পরিবহন মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে নগর পরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছে না। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, মহাসড়কে লেন যত বাড়ানো হবে কিংবা সড়ক যত বাড়বে গাড়ির সংখ্যা তত বাড়তে থাকবে। ঢাকায় প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক গাড়ি নামছে। এসব ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রাজধানীর ভোগান্তি কমানো যাবে না। তিনি বলেন, সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে চালকদের ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ছোট গাড়ি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণকরতে হবে। সড়ক ও ফুটপাথ দখল কঠোরভাবে ঠেকাতে হবে। বন্ধ করতে হবে রাস্তায় অবাধে গাড়ি রাখার প্রবণতা। বাঁচানো গেল না দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীবকে রাজধানীর কাওরান বাজারে দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারানো পর অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো গেলোনা কলেজছাত্র রাজীব হোসেনকে।১৬ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মারা যান তিনি। ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পান্থকুঞ্জ পার্কের সামনে বিআরটিসি বাসের সঙ্গে স্বজন পরিবহনের বাস টক্কর দিতে গেলে বাস দু’টির চিপায় পড়ে ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রাজীবের। সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের এ ছাত্রকে তাৎক্ষণিক নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও পরদিন ঢামেকে নিয়ে আসা হয়। সেখানে সরকারের তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছিল। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামের রাজীব তৃতীয় শ্রেণিতে থাকাকালে মাকে এবং অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালে বাবাকে হারান। এরপর মতিঝিলে খালা জাহানারা বেগমের বাসায় থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। মহাখালীর তিতুমীর কলেজে স্নাতকে ভর্তি হওয়ার পর যাত্রাবাড়ীতে মেসে ভাড়ায় থেকে পড়াশোনা করছিলেন রাজীব। এর পাশাপাশি তিনি একটি কম্পিউটারের দোকানেও কাজ করছিলেন। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট দুই ভাইয়ের খরচও চালাতে হতো রাজীবকে। রাজীবের হাত বিছিন্ন করে ফেলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ৪ এপ্রিল বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ (৩৫) ও স্বজন বাসের চালক খোরশেদকে (৫০) গ্রেফতার করা হয়। ৫ এপ্রিল দু’জনকে আদালতে তোলা হলে তাদের দুই দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়। ৮ এপ্রিল দু’জনকে পাঠানো হয় কারাগারে। রাজীবের মামলা এখনো ঝুলে আছে হাইকোর্টে কে দিবে রাজীবের ১ কোটি টাকা ক্ষতি পূরণ বিআরটিসি না স্বজন পরিবহন আদো রাজীবের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে কি ? রাজীবের পর চলে গেলেন রোজিনাও রাজীবের পর চলে গেলেন রাজধানীর বনানীতে বাসের চাপায় পা হারানো রোজিনা আক্তারও। ২৯ এপ্রিল সকাল ৭টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রজিনা(২১)। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে রোজিনার বাবা মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ময়মনসিংহের মেয়ে রোজিনা গত ১০ বছর ধরে ঢাকায় সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার বাসায় কাজ করে আসছিলেন। গত ২০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে বনানীর চেয়ারম্যান বাড়িতে রাস্তা পার হওয়ার সময় বিআরটিসির একটি বাসের চাপায় তার পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর পর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন রোজিনা। হাসপাতালে প্রথমবার অস্ত্রোপচারে রোজিনার ডান পা উরু থেকে কেটে ফেলা হয়। কিন্তু সেখানে পচন ধরায় আবারও অস্ত্রোপচার করে বাকি অংশটুকু ফেলে দিতে হয়। এর পর থেকে ক্রমে তার অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। এ ছাড়া গত ১০ এপ্রিল ফার্মগেটে বাসচাপায় পা থেঁতলে যায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী রুনি আক্তারের।
গণপরিবহনে নারীদের হেনস্তা ও যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদী হয়ে উঠছেন নারীরা। ফেসবুকে প্রতিবাদ হচ্ছে।মানববন্ধন হচ্ছে। আবার কেউ কেউ একাই নেমে পড়েছেন রাস্তায়। গতকাল দুপুরে কাঠফাঁটা রোদ মাথায় নিয়ে রাজধানীর শ্যামলীতে সড়কের আইল্যান্ডে পোস্টার হাতে একাই দাঁড়িয়ে ছিলেন এক তরুণী। হাতে লেখা পোস্টারে যৌন নিপীড়নবিরোধী বার্তা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো এই তরুণীর নাম কানিজ ফাতেমা। রাস্তা পারাপারের সময় অনেকই দেখছেন তার এ প্রতিবাদ। এর আগে গত ২ এপ্রিল ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে রাজধানীর উত্তরায় একাই পথে নেমেছিলেন আফসানা কিশোয়ার লোচন নামের এক নারী। কানিজ ফাতেমা পড়াশোনা করছেন সিটি কলেজে। যখনই সুযোগ পান, পোস্টার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন তিনি। গণপরিবহনে নারীদের হেনস্তা ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেন। পোস্টারে তিনি লিখেছেন, এই অসুস্থ সমাজটাকে সুস্থ করার দায়িত্ব আমাদের সবার। এগিয়ে আসুন, যেন নিরাপদ থাকে প্রত্যেকটি ঘরের নারী। দিন শেষে যেন কোনো মেয়েকে হতে না হয় ‘ধর্ষিতা’। বন্ধ হোক গণপরিবহনে যৌন হয়রানি, হেল্প লাইন ৯৯৯। মানুষের সচেতনতা বাড়াতেই রাস্তায় নেমেছেন বলে জানান ফাতেমা। বলেন, কেবল আজকেই প্রতিবাদ করছি তা নয়। যখনই সুযোগ হয় তখনই রাস্তায়, বাসে পোস্টার নিয়ে দাঁড়াই। যাতে মানুষ এসব নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। লোকজনের প্রতিক্রিয়া কেমন জানতে চাইলে কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘অনেকই প্রশংসা করেছেন। কেউ কেউ নিজে দাঁড়াবেন বলে জানিয়েছেন। আবার অনেকে বিদ্রুপের চোখে দেখেছেন। কেউ বা প্রশ্ন করেছেনÑ আমি যৌন নিপীড়নের কী বুঝি। আবার কেউ বলছেন সব পোশাকের দোষ।’ কেন এভাবে একা দাঁড়ানো প্রশ্নে কানিজ ফাতেমা বলেন, গণপরিবহনে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা কোনো সুস্থ সমাজে হতে পারে না। গণপরিবহনে নারী ও কন্যাশিশুর নিরাপত্তাসহ নারীর স্বাধীনভাবে চলাচল নিশ্চিতকরণের দাবি সবার হওয়া উচিত। নাগরিক সমাজকে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাতে আমার এ উদ্যোগ। রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় গত ২১ এপ্রিল তুরাগ পরিবহনে উত্তরা ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত উত্তরা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য ওই ছাত্রী উত্তর বাড্ডা থেকে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। তখন বাসে যাত্রী ছিল ৭-৮ জন। নাটকীয়ভাবে বাস কর্মচারীরা বাস সামনে যাবে বলে যাত্রীদের নামাতে থাকে এবং নতুন কোনো যাত্রী উঠানো বন্ধ রাখে। এসময় ওই ছাত্রীর সন্দেহ হলে তিনি বাস থেকে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাসের হেলপার দরজা বন্ধ করে দেয় এবং কন্ডাক্টর ছাত্রীর হাত ধরে টানতে শুরু করে। কন্ডাক্টর ও হেলপারের সঙ্গে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়েন ওই ছাত্রী। এরপর তিনি অন্য একটি বাসে চড়ে ইউনিভার্সিটিতে চলে আসেন। বাস ড্রাইভার শ্রমিক ও মালিকদের নৈরাজ্য লাগাম টানতে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সরকারের উচচ মহলের কঠিন হস্তক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন। পাশাপাশি যাত্রী ও পথচারীদের সচেতনতার সাথে চলাফেরা করতে উদ্ভুত করতে হবে। তাহলে হয়তো পরিবহনের লাগামহীন নৈরাজ্য থেকে রক্ষা পাবে তাজা প্রাণ।
|