অধিকারের প্রতিবেদন
  বেশিরভাগ বিরোধ নিষ্পত্তি হচ্ছে
  18-04-2018

॥ আতাউর রহমান সোহেল, গাজীপুর ॥
শ্রীপুরের মুলাইদ গ্রামের আফাজ উদ্দিনের কন্যা নাসরিন আক্তার। গত আট মাস আগে বরামা গ্রামের আবুল হাশেমের ছেলে ফারুক মিয়ার সাথে তার বিয়ে হয়। যৌতুকের দাবী নিয়ে স্বামী-স্বজনদের সাথে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়।
তিনি জানান, সুবিচারের আশায় ইউনিয়ন পরিষদের স্মরণাপন্ন হন। পর পর বেশ কয়েকটি তারিখে শুনানী হয়। ১১ ফেব্রুয়ারী ইউনিয়ন পরিষদের নারী শিশু ও পারিবারিক বিরোধ নিরসন কমিটি এক লাখ ২৫ হাজার টাকা আমাকে দিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী এক মাসের মধ্যে সমুদয় অর্থ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে সংরক্ষন বা জমাদানেরও সিদ্ধান্ত হয়। ইউপি সুত্র জানায়, ইতোমধ্যে ২৫ হাজার টাকা জমা করা হয়েছে।
গাজীপুরের শ্রীপুরে নারী সংক্রান্ত বিরোধের বেশিরভাগ নিষ্পত্তি হয় ইউনিয়য়ন পরিষদ কার্যালয়ে। ইউনিয়ন পরিষদের নারী শিশু ও পারিবারিক বিরোধ নিরসন কমিটি এ কাজটি বাস্তবায়ন করেন।
শ্রীপুর উপজেলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন পরিষদেই নারী শিশু ও পারিবারিক বিরোধ নিরসন কমিটি রয়েছে। তিনজন সংরক্ষিত নারী সদস্যের মধ্যে একজন এ কমিটির সভাপতি মনোনীত হন। তার সাথে আরও কমপক্ষে চারজন সদস্য এ কমিটির সদস্য থাকেন। বরমী ইউনিয়ন পরিষদে এ কমিটির সভাপতি সংরক্ষিত নারী সদস্য রেজিয়া বেগম।
এরকমভাবে নারী নির্যাতনের নানা ঘটনায় নারীরা ইউনিয়ন পরিষদের স্মরণাপন্ন হন। ইউনিয়ন পরিষদের নারী শিশু ও পারিবারিক বিরোধ নিরসন কমিটি নারীদের এসব বিষয় নিয়ে নারীদের পক্ষে কাজ করে থাকে।
বরমী ইউনিয়ন পরিষদে এ কমিটির সভাপতি সংরক্ষিত নারী সদস্য রেজিয়া বেগম বলেন, এ কমিটি মূলত: নারীদের পক্ষে কাজ করে। প্রতি দু’মাস পর পর একটি করে সভা করা হয়। সভায় নারী নির্যাতন শিশু সুরক্ষায় অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়।
ময়মনসিংহের পাগলা থানার হাজী আব্দুল মান্নানের কন্যা রিমা আক্তার। এক বছর আগে শ্রীপুরের বরামা গ্রামের আব্দুল মতিনের ছেলে রুবেল শেখের সাথে বিয়ে হয়। যৌতুকের অভিযোগে রিমা বরমী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। পর পর কয়েকটি শুনানী শেষে তাদের মধ্যে যৌতুকের বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়। সংরক্ষিত নারী সদস্য রেজিয়া বেগম বলেন, শুধু শুনানী নয়, দুই পক্ষের সাথে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে একটি জটিল সমস্যার সমাধান করা হয়েছে।
বরমী ইউনিয়নের পাঠানটেক গ্রামের হাফিজ উদ্দিনের কন্যা রুমা আক্তার। তিনি জানান, তার স্বামী চার মাস আগে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ৯ বছরের সংসার জীবন তার। স্বামী অসুস্থের পর শ^াশুড়ী তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সুবিচারের জন্য টাকা খরচ করার সামর্থও নেই তার। পরে এলাকার লোকজনদের পরামর্শে ইউনিয়ন পরিষদের নারী শিশু কমিটির কাছে আবদেন করেন। সেখানে কয়েক দফা শুনানী ও আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে নারী হিসেবে স্বামী সংসারে তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি এখন তার স্বামীর ঘরে আছেন।
বরমী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল হক বাদল সরকার বলেন, প্রতি মাসে গড়ে কমপক্ষে ১৫টি নারী বিষয়ক সমস্যার অভিযোগ আসে। ইউনিয়ন পরিষদের নারী শিশু ও পারিবারিক বিরোধ নিরসন কমিটি এ নিয়ে কাজ করেন। বাদী বিবাদী পক্ষ নিয়ে পর পর চারটি তারিখে আলোচনা ও শুনানী হয়। বিষয়টি চারটি তারিখের মধ্যেই মীমাংসা করা হয়। চারটি তারিখ সাধারণত চার সপ্তাহে দেয়া হয়। কোনো পক্ষ সময় চেয়ে নিলে শুনানী বা আলোচনার দিনক্ষণ কিছুটা বিলম্ব হয়। তবে মোট আবেদন করা ৮৫ ভাগ প্রার্থীর আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়।
যদি ইউনিয়ন পরিষদের আলোচনায় নিষ্পত্তি না হয় তাহলে আদালতে আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এরকম একটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, শ্রীপুরের সোনাকর গ্রামের আব্দুল মালেকের ছেলে রুবেলের সাথে সাত বছর আগে তার বিয়ে হয়। নেশাগ্রস্ত স্বামী স্ত্রীকে মারপিট ও যৌতুকের দাবীতে মারধোর করে। পর পর চারটি তারিখে আলোচনা ও শুনানী অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কোনো মীমাংসায় পৌঁছাতে পারিনি। অবশেষে বাদীনিকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
চেয়ারম্যান বাদল সরকার বলেন, নারীদের কল্যাণে এ কমিটি ইউনিয়ন পরিষদে অন্যান্য ১৩টি কমিটির মধ্যে একটি।
শ্রীপুর রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি, শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও ডেইলী স্টারের সাংবাদিক প্রভাষক আবু বকর সিদ্দিক আকন্দ সোহেল বলেন, স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ কাঠামো শক্তিশালী এবং বেগবান হলে তৃণমূলের অধিকাংশ নারী নির্যাতনের ঘটনা সেখানেই নিষ্পত্তি করা সম্ভব। এতে আদলতে যেমনি মামলাজট কমবে তেমনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অব্দুল জলিল বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের নারী শিশু ও পারিবারিক বিরোধ নিরসন কমিটি পারিবারিকভাবে বেশিরভাগ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এ কমিটিকে আরো বেশি শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এতে তৃণমূল নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আরও ভূমিকা রাখতে সক্রিয় হবে।