আন্তর্জাতিক
  ভারত-বাংলাদেশে সন্তানহীন দম্পতিদের সংখ্যা বাড়ছে উন্নত হচ্ছে সন্তানলাভের চিকিৎসা
  15-02-2018

॥ অমর সাহা, কলকাতা ॥
এখন ভারত সহ পাশ্ববর্তী বাংলাদেশেও বাড়ছে সন্তানহীন দম্পতির সংখ্যা। সন্তানহীন দম্পতিরাও একটি সন্তানলাভের আশায়  ছুটছেন দেশ বিদেশের অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে। সে কলকাতা হোক বা বিদেশের মাটিতে। কলকাতায় এই সন্তানহীন দম্পতিদের কোলে একটি সন্তান দেওয়ার জন্য প্রথম মাঠে নেমেছিলেন ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়।  তারপর বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার সহ আরও বেশ ক’জন চিকিৎসক। তাঁরা সন্তানহীন দম্পতির কখনো চেস্টটিউব বা নলজাত শিশু উপহার দিয়েছেন, আবার সুচিকিৎিসায় সফলতা এনে সন্তান দিয়েছেন। তবুও এখনো এই সন্তানহীন দম্পতিদের নিয়ে গ্রাম গাঁয়ে কুসংস্কারের শেষ নেই। কোনও দম্পতির সন্তান না হলে ওই দম্পতি বা বিশেষ করে নারীকে বাজা নারী হিসেবে চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে হেয় করা হত। এখনো এই চিত্র শহরে তেমনটা না থাকলেও গ্রামে বর্তমান। কোনও  নারীর সন্তান না হলে তাকে বাজা বলে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। কোনও অনুষ্ঠানে যোগদিতে আপত্তি তোলা হয় এই যুক্তিতে যে  এই দম্পতি বা নারীর ছোঁয়া  অমঙ্গল হবে। আর মূলত দোষ গিয়ে লাগে মেয়েদের ওপর। বলা হয় বউয়ের কারণে সন্তান হলোনা তার পুত্রের। ফলে অনেক সময় এই পুত্রকে বিয়ে দিয়েও যখন সন্তানের মুখ দেখতে পায়না তখনও এরা থেমে থাকেননা কুসংস্কার  ছোঁয়া থেকে। এমনও দেখা গেছে অনেকসময় তিনবার বিয়ে দিয়েও সন্তানের মুখ দেখতে পায়নি বাবামায়েরা।  
কিন্তু সত্যি কি তাই ? সবক্ষেত্রে কি দায়ী নারীরা ? পুরুষরা কি সন্তান না হওয়ার জন্য দায়ী নন? অথবা পুরুষ বা নারীর কে কতটা দায়ী বা এই সমস্যার সমাধানের জন্য কোনও চিকিৎসা নেই? ইত্যাদি প্রশ্নের খোঁজে আমরা হাজির হয়েছিলাম কলকাতার এ সংক্রান্ত প্রখ্যাত চিকিৎসক সুদর্শন ঘোষ দস্তিদারের কাছে। ঘোষ দস্তিদার এই সন্তানহীন দম্পতিদের কোলে নতুন একটি শিশু উপহার দেওয়ার জন্য সেই আশির দশক থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন। সফলতাও পেয়েছেন। এখন তার প্রচুর রোগী। এই রোগী আসছে শুধু ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে নয় ; আসছে পাশ্ববর্তী বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান থেকেও।
ডা: ঘোষ দস্তিদার বললেন, এখন সন্তানহীন দম্পতিদের জন্য আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করেছেন তারা। আগের তুলনায় সফলতা বেড়েছে। তিনি বললেন, এতদিন সন্তান না হওয়ার জন্য আমাদের সমাজ শুধু নারীদেরই দোষ দিয়ে আসছিল। পুরুষরাও যে বাজা হতে পারেন এই ধারণাটা একসময় কোন পরিবারের ছিলনা। এখন দেখা যাচ্ছে সন্তান না হওয়ার জন্য পুরুষ ও মহিলা সমানভাবে দায়ী। দস্তিদার বলেছেন, এখন এই সন্তানহীন দম্পতিদের ৪০ শতাংশ নারী এবং ৪০ শতাংশ পুরুষ। আর যৌথভাবে দায়ী ২০ শতাংশ দম্পতি অর্থ্যাৎ স্বামী এবং স্ত্রী। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে কেবল নারীরাই বাজা হন এই ভুল ধারণা ক্রমে ভাঙছে। মানুষও বুঝতে পারছে পুরুষও সমানদায়ী। ফলে এই সন্তান না হওয়ার জন্য কেবল নারীদের দোষারোপ করার পালা এখন আমাদের দেশের শহরাঞ্চলে কমে  এলেও গ্রামগাঁেয় সেই ছোঁয়া এখনো লেগে আছে। আর সেই কারণে সন্তানহীন দম্পতিরা এখন অনেকটা গোপনেই সন্তানলাভের চিকিৎসা নিচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।
ঘোষ দস্তিদার বলেছেন, ১৯৭৮ সালে প্রথম টেস্টটিউব শিশু ভুমিস্ট করার ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তবে তাঁর এই সৃস্টিকে মূল্যায়ন করা হয়নি সেদিন। এরপর ১৯৮১-৮৬ সালের মধ্যে গবেষণা চালিয়ে প্রখ্যাত  চিকিৎসক বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী এবং সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় টেস্টটিউব সন্তান ভূমিস্ট করান।
সেটি ছিল আইভিএফ পদ্ধতিতে। এরপরে ডা: ঘোষ দস্তিদার ১৯৯২-৯৩ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইকসি বা আইসিএসআই  ( ইন্ট্রা-সাইটোপ্লাসমিক স্পার্ম ইনজেকশন)  পদ্ধতিতে শিশু ভুূমিস্ট করান সেখানকার চিকিৎসক পার্লেসো । এরপরে এই ইকসি পদ্ধতিতে ১৯৯৫ সালে মার্চ মাসে কলকাতায় এই পদ্ধতিতে শিশু ভূমিস্ট করান ঘোষ দস্তিদার।
ঘোষ দস্তিদার বলেছেন, ইকসি থেকে এখন সন্তানহীন দম্পতিদের সন্তানলাভের জন্য আরও উন্নত চিকিসা পদ্ধতি টেসা-ইকসি শুরু করা হয়েছে।  এরআগে করা হয়েছে  জিফট                                 ( জাইগোট ইন্ট্রা- ফলোপিয়ান ট্রান্সফার) পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে।  এই পদ্ধতির চিকিৎসা খরচ এক লাখ ১০ হাজার রুপির মত। এই পদ্ধতিতে মুম্বাইয়েও শিশু জন্ম নিয়েছে।
ঘোষ দস্তিদার একথাও বলেছেন, এমনও দেখা গেছে নারীর গর্ভধারণ হচ্ছে কিন্তু থাকছেনা। এক্ষেত্রে তিনি জরায়ুর মুখে ছোট্ট একটি অপারেশন করে সন্তানহীন দম্পতির মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছেন। এই পদ্ধতিতে অবশ্য খরচের পরিমাণ সামান্য। হাজার পনের। ঘোষ দস্তিদার আরও বলেছেন, তাঁর কাছে আসা রোগীদের ২৫ শতাংশই আসছেন বাংলাদেশ থেকে।
তাঁর রয়েছে নিজস্ব চিকিৎসালয়, গবেষণাগার। জিডি ইস্টিটিউট অফ ফার্টিলিটি রিসার্চ। এই রিসার্চ সেন্টার দক্ষিণ কলকাতার এসপি মুখার্জি রোডে অবস্থিত। ঘোষদস্তিদার এ কথাও বলেছেন, আগে যেমন সন্তানহীন দম্পতিদের সন্তানলাভের সফলতা কম ছিল এখন তা বহুগুনে বেড়ে গেছে আধুনিক চিকিসা পদ্ধতির ছোঁয়ায়। বলেছেন, তবে সন্তানহীন দম্পতিদের অল্প বয়সে চিকিৎসকের কাছে আসা উচিৎ। নারীদের বয়স যত কম হবে তত বেশি সাফল্য আসবে। চিকিৎসার খরচও কমবে। বিশেষ করে ৩২/৩৩ বছর পর মেয়েদের শারীরিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে।
তাই তার আগে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে সফলতা আসে বেশি। আবার যেসব নারীদের জরায়ুর মুখের সিস্ট অপারেশন করার প্রয়োজন হয়, সেই সিস্ট অপারেশন করা হলে ওই দম্পতি শিশুর নতুন মুখ দেখতে পারেন। এজন্য খুব একটা বেশি খরচ নয়। তবে থাইরয়েড  এবং ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে। তিনি একথাও বলেছেন, এখন আর এই রোগীদের বিছানায় শুয়ে থাকার প্রয়োজন নেই।