বিশেষ প্রতিবেদন
  ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালিত
  11-01-2018

॥ মানবাধিকার খবর প্রতিবেদন ॥
১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন স্পিকার শিরীন শারমীন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সিপ্পো, সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রিনি হোলেন স্টেইন প্রমূখ। সেমিনারের মাধ্যমে সমতা, ন্যায় বিচার এবং মানুষের মর্যদা নিশ্চিত করার প্রত্যয়কে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান করেছেন। সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান করেছে। মানবাধিকার মানুষ জন্মসূত্রে অর্জন করে। আমাদের দেশের সংবিধান মানুষের সে অধিকারের গ্যারান্টি দিয়েছে। মানবাধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। শুধু দেশের মানুষেরই না সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য রুখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মানবাধিকার নিশ্চিত করতে বিপদে যে কোন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। রোহিঙ্গাদের প্রথমিক চাহিদা পূরনে কাজ করে চলছে বাংলাদেশ জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উত্থাপিত পাঁচ দফা প্রস্থাবেই সুরক্ষিত হবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার। আরও বলেন নারীদের শিক্ষা এবং কাজের পরিবেশ তৈরী করতে হবে। নারীরা শিক্ষিত হয়ে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললেই অর্জিত হবে সমতা এবং অবসান ঘটবে লিঙ্গ বৈষম্যের। দরিদ্রতাকে হার মানিয়ে এগিয়ে চলছে দেশ। এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্ব দরবারে প্রতিফলিত হয়েছে। সমতা, ন্যায় বিচার এবং মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে দেশ এসডিজি  অর্জনেও একই রকম সাফল্য দেখাবে। গওহর রিজভী বলেন, সমতা নিশ্চিত করে দলীত হরিজন সংখ্যালঘু সব সম্প্রদায়ের অধিকার নিশ্চিত করতে ইতিবাচক উদ্যোগ এবং মূল্যবোধ থাকতে হবে। সংবিধান সেভগার্ড হিসেবে অধিকার দিয়েছে মানুষকে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক যে কোন প্লাটফর্ম থেকেই মানবাধিকার লঙ্গনকারীদের রুখতে হবে। সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রিনি হোলেন স্টেইন বলেন, মানবাধিকার নাগরিকদের অধিকার, সমতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়। রোহিঙ্গা উস্যুতে মানবাধিকার চ্যালেঞ্জের মুখে পরেছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এত বড় জনগোষ্ঠীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। এই ইস্যু মীমাংসা করতে বিশ্ব জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিন সাপোর্ট প্রয়োজন বাংলাদেশের। মিয়া সিপ্পো বলেছেন, মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহন করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার মানবাধিকার অর্জন করে।  কোন ব্যাক্তি, সংগঠন বা রাষ্ট্র তার এই অধিকার কেড়ে নিতে পারেনা। মানবাধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন ঠেকানোর জন্য সংগঠন বা ইউনিয়ান জরুরি নয় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ব্যাক্তির উদ্যোগ ও মানবিকতা।
অপরদিকে গুমের শিকার ২৯টি পরিবারের সদস্যরা জাতীয় প্রেসক্লাবে সমবেত হয়ে সরকারের কাছে তাঁদের দাবির কথা জানিয়ে বলেন-বাবা-মায়ের চোখের সামনে থেকে সন্তানকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো, সন্তানের সামনে থেকে বাবাকে, বোনের সামনে থেকে ভাইকে...। তুলে নেওয়ার সময় কেউ পরিচয় দিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য,  কেউ এসেছিল সাদাপোশাকে। এখন এসে সরকার বলছে তারা কিছু জানে না। তাহলে কে জানে? আমরা এর জবাব চাই। হয়, আমাদের প্রিয়জনদের ফিরিয়ে দিন, নয় জবাব দিন। আর প্রতীক্ষা করতে পারছি না। পরের বছরও একই দাবিতে একইভাবে আমরা আর সমবেত হতে চাই না।’
গত কয়েক বছরের মতো এবারও নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা একত্র হয়েছিলেন। ‘মায়ের ডাক, সন্তানদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দাও’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের বৃদ্ধ মা হাজেরা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমার একটাই চাওয়া, মৃত্যুর আগে একবার ছেলেটাকে দেখে যেতে চাই।’ শোকবিহ্বল পরিবেশে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। সবার হাতে ছিল প্রিয়জনের ছবি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ছোট্ট মেয়ে আদিবা ইসলাম কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমি তো বড় হয়ে যাচ্ছি, আমার বাবা ফিরে আসছে না কেন?’ আদিবার আশা, তার বাবা ফিরবেনই। চার বছর আগে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগ থেকে নিখোঁজ হন তার বাবা পারভেজ  হোসেন।
আলোচনায় লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন পড়ে  শোনান ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ সাজেদুল ইসলামের দুই বোন মারুফা ইসলাম ও আফরোজা ইসলাম। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘আজ আমাদের গুম পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচিত হতে হচ্ছে। এর মধ্যে গুম হওয়া মুন্নার বাবা ও পারভেজের বাবা মারা  গেছেন। এর থেকে পরিত্রাণ চাই। আমাদের স্বজনেরা কোথায়, কী অবস্থায় রয়েছে, তা জানতে চাই। গুমের তালিকায় আমরা আর নতুন নাম দেখতে চাই না।’
২০১৩ সালে মিরপুর পল্লøবী থেকে গুম হওয়া বিএনপিকর্মী সেলিম রেজা পিন্টুর বোন বলেন, ‘আমরা পুলিশের কাছে কোনো তথ্য পাই না। সিআইডির কাজেরও কোনো অগ্রগতি নাই।’
অনুষ্ঠানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লøাহ চৌধুরী গুমের জন্য সরকারকে দায়ী করে বলেন, ‘ফরহাদ মজহারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে আলোচনায় আমি বুঝতে পেরেছি, পুলিশ ও র‌্যাব সক্রিয় ছিল বলে উনি ফিরে আসতে পেরেছেন। এতে  বোঝা যায়, তাঁর নিখোঁজ হওয়ার পেছনে অন্য  কোনো শক্তি কাজ করেছিল। তাই পুলিশ ও র‌্যাবকে সক্রিয় করার জন্য জোর অনুরোধ জানাচ্ছি।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমি গুমের পরিস্থিতির শিকার। এই কঠিন সময়টি সম্পর্কে আমি জানি। গুম অস্বীকার করার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এসব গুম রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতেই করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক সি আর আবরার বলেন, একটা ভয়ের আবহ ও পরিস্থিতির মধ্য নিখোঁজের স্বজনেরা এখানে এসেছেন। যারা গুমের পেছনে জড়িত, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক। গুম পরিবারগুলোর যে অভিযোগ রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার জবাব  দেওয়া।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘গত চার বছর আমরা নানাভাবে গুমের বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছি। আমরা এখন আর আবেদন জানাতে চাই না। এই পরিস্থিতিতে আমরা মার্চ মাসের মধ্যে গণশুনানি করতে চাই। ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চাই।’
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের পরিচালক নাসিরউদ্দিন এলান বলেন, ২০১৭ সালের আগে দেখা যেত প্রশাসন পরিচয় দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন উধাও হয়ে যাচ্ছে। নিখোঁজ হলো, না মারা গেল, নাকি গুম, তা  বোঝাও যাচ্ছে না। আমরা জানতে চাই কী হচ্ছে?’
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক ব্যারিস্টা রুমিন ফারহানা বলেন, প্রতি মুহূর্তের অপেক্ষা মৃত্যুর চেয়ে অনেক কঠিন। গুমের শিকার পরিবারগুলো  সেই কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
১১ ডিসেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মিডিয়াকে বলেন- আমাদের মানবাধিকার তো অনেক বড় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অধিকার বিষয়ে নিয়ে আমরা কাজ করি, তারপরও গুম বা নিখোজ হওয়ার অনেক অভিযোগ আমাদের কাছে আসে, এ জাতীয় অভিযোগ আসলেও আমাদের কাছে এমন কোন মেশিনারিজ নেই যে আমরা তাদের খুজে বের করতে পারি বা প্রকৃত অপরাধীকে ধরতে পারি, আমরা
এ অভিযোগ গুলো সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিই এবং সরকারকে অনুরোধ করি প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করতে হোক সে সাধারন নাগরিক, কিবা সরকারী লোক বা প্রশাসনের কেউ।
তিনি বলেন- এখন অবশ্য তারা আমাদের জবাব দিচ্ছে, আর আমাদের আইনের সীমাবদ্ধতার কারনে অনেক তদন্তই আমরা সরকারী করতে পারছিনা আমাদের তাদের উপর নির্ভরশীল হতেই হচ্ছে, কারন এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব রাষ্ট্রই সকল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ আর এটা থেকে বের হতে হলে যেটা করতে হবে সেটা হলো আমাদের আইনটা কে রি-ভিসিট করতে হবে, পার্টিকুলার একটি সেকশন, যে সেকশন এ বলা আছে এ জাতীয় ঘটনা ঘটলে রাষ্ট্রকে জানাতে হবে, এ সেকশনটা রি-ভিসিট করতে হবে, আরেকটা কথা আবার বলছি আমরা যে তদন্ত গুলি করি করে রাষ্ট্রকে সেটা আমরা সাভমিট করি। এ ক্ষেত্রে এটা হতে পারে কোন আইন বা ক্ষমতা বলে যদি আমরা আমাদের তদন্ত গুলি সরাসরি আদালতে সাভমিট করতে পারি যেটা গ্রহনযোগ্য হবে সে প্রচেষ্টাই আমরা করে যাচ্ছি আমরা দেখছি রাষ্ট্রের তদন্ত অনেক সময় সত্য বের হয়ে আসেনা।
কাজী রিয়াজুল হক বলেন- আসলে সরকারের অধিনে কিন্তু মানবাধিকার কমিশন নেই, পৃথিবীতে যত মানবাধিকার কমিশন আছে সবাইকে রাষ্ট্র অর্থায়ন করে কিন্তু রাষ্ট্র এ কমিশনকে পরিচালনা করেনা, মূলত জাতিসংঘ দ্বারা প্যারিসে অনুষ্ঠিত সম্মেলন এ সিদ্ধান্ত হয় প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রে একটি করে মানবাধিকার কমিশন থাকবে, যদিও এটা বাধ্যতামূলক নয় তারপরেও ৮০ টির বেশী রাষ্ট্রে এ কমিশন রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
সমপ্রতি আগষ্ট মাসে থেকে অপহরন হয়েছে শিক্ষক থেকে শুরু করে ডাক্তার, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ডিপলোম্যাটরা, সব ক্ষেত্রে এ অপকর্মের জন্য আঙ্গুল কিন্তু আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর দিকে উঠেছে এটাকে উদ্বেক জনক বলবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন-
উদ্বেক জনক বলেছিতো বহুবার এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই লোক গুলোকে খুজে বের করে তাদের পরিবারের নিকট ফেরত দিতে হবে। এ কাজে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে আমরা অনুরোধ করছি। এ নিয়ে একটা প্রক্রিয়া আছে পুলিশ তদন্ত করে তা আদালতে দাখিল করবে। আদালত যদি মনে করেন তদন্তে নিষ্ঠা বা সততার অভাব আছে তাহলে সে ক্ষেত্রে আদালতের অন্য পক্ষ থেকে নারাজী পিটিশন দাখিল করলে আদালত পুনরায় তদন্ত করার করার আদেশ দিতে পারে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন আইনের যে ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে, এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ ভাব-মূতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কাজী রিয়াজুল হক বলেন- ভাল কথা বলেছেন বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূতি অর্থনৈতিক ভাবে ও সামাজিক ভাবে অনেক উজ্জল এই যে গুম, অপহরন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাগুলো হচ্ছে এ গুলো সব উজ্জলতাকে ম্লান করে দিচ্ছে রাষ্ট্রের উচিত দেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে ঠিক রাখা।
আইনের সীমাবদ্বতার কারনে আপনারা কাজ করতে না পারা এটা পরিবর্তনের জন্য কোন জোরালো আবেদন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন- অবশ্যই জোরালো আবেদন করে যাচ্ছি, এই যে আপনাদের মাধ্যমে বলছি এটাও  তো আবেদন। আমরা আবারও একটি মিটিং করে আবেদন পাঠাবো, যেন আইনি প্রতিবন্ধকতা থেকে বের হয়ে আমরা সরাসরি গুম ও অপহরন নির্যাতন এসব বিষয়ে মানবাধিকার কমিশন নিজে তদন্ত করে আদালতে দাখিল করে মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে চাই।
মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশিষ্ট জনের মতামত
সাম্প্রতিক গুম, নিখোঁজ ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সুসংহত থাকলেও মানবাধিকারের  ক্ষেত্রে তা ব্যাহত হচ্ছে। দেশের সব  শ্রেণী- পেশার মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী মানবাধিকার সুরক্ষা এখনও প্রত্যাশার কাছাকাছি নেই। বিশিষ্টজনের অভিমত, গুম ও নিখোঁজের ঘটনার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে জোর দেওয়ার আহ্বান জানান তারা। তবে সরকারের দাবি-  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির আগের তুলনায় উন্নতি হয়েছে। বিনা বিচারে হত্যাকারের সংখ্যা অনেক কমেছে। মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে। এমন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে  পালিত হলো বিশ্ব মানবাধিকার দিবস।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সব মানবাধিকার ও সুশাসনের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে উল্লেøখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, বর্তমান সরকার মানবাধিকার রক্ষায় বদ্ধপরিকর। সর্বস্তরে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন-২০০৯ প্রণয়ন এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এক বাণীতে বলেন, আমরা স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছি। সংবিধান সংশোধন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পথ বন্ধ করেছি। সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার করার মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি।
গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ১৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন। এর মধ্যে চারজনের খোঁজ পাওয়া  গেলেও বাকিদের খোঁজ মেলেনি। এর মধ্যে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক এবং সাবেক রাষ্ট্রদূতও রয়েছেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্যমতে, চলতি বছর ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কমিশনের কাছে গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকারসহ বিভিন্ন ঘটনায় মোট ৪৩৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৪৪টি। গত বছর অভিযোগ ছিল ৬৬৫টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৯২টি।
মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের  দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অনেক ভালো, অনেক উন্নত। তার কারণ হচ্ছে, মানুষের কথা বলার সুযোগ আছে। জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য বর্তমান সরকার অনেক কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অনেক সুদৃঢ়। তিনি আরও বলেন, সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে সরকার।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সার্বিকভাবে বলা যেতে পারে- বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয়। বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতিও খারাপ। তিনি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণেই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এরপর রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক গুম-নিখোঁজের ঘটনায় আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। ধরে নিয়ে মুক্তিপণ চেয়ে টাকা আদায়ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, মানবাধিকারের কতগুলো শর্ত আছে, যেখানে একজন মানুষ সমাজে স্বাধীনভাবে বসবাস করবে। সে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। কিন্তু সমাজের সবাই এ সুবিধা পাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, একের পর এক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক নিখোঁজ হচ্ছে, তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তারা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে- তাদের খুঁজে বের করার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র এ দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না।সুলতানা কামাল আরও বলেন, নারী নির্যাতনের হার উদ্বেগজনক। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। আমরা শঙ্কার মধ্যে  বেঁচে আছি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে উল্লেøখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি করছে, কিন্তু মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে আরও বেশি উন্নতি করতে হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ বা গুম হলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাকে খুঁজে  বের করা। কিন্তু রাষ্ট্রের তৎপরতা সেভাবে দৃশ্যমান নয়। এখানেই আমাদের আশঙ্কা। তিনি বলেন, গুমের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের আদালতে সোপর্দ করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অস্থিরতা চলছে। রোহিঙ্গাদের সমস্যায় আমরা জর্জরিত। আমাদের এই বিশাল বোঝা টানতে হচ্ছে। বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখছে। দেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন,  বেসামরিক লোক নিখোঁজ হচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। একের পর এক লোকজনকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যাচ্ছে, এটা রাষ্ট্রকে খুঁজে  বের করতে হবে। একটি মানবাধিকারবান্ধব সমাজ গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, দেশে ততই মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ চরম মানবাধিকার বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের কর্মসূচি : `সমতা, ন্যায় বিচার ও মানবিক মর্যাদা`- এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে  আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হলো ৬৯তম বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে এ দিবসটি পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছিলো।
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে থেকে শোভাযাত্রা বের হয়েছিল।
অপরদিকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত মানবাধিকার বিষয়ক পত্রিকা মানবাধিকার খবর, বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি সংগঠন শোভাযাত্রা বের করে।  এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দু`দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিলো। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন  চৌধুরী। সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেছিলেন মানবাধিকার কমিশনের  চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।
দু’দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সেমিনারে বিভিন্ন সেশনে কয়েকটি দেশ থেকে প্রতিনিধিগন অংশগ্রহন করে।