প্রবন্ধ
  আমাদের ঘুম ভাঙবে কবে!
  10-12-2017

ইলিয়াস সাগর

ছোটবেলা নানুর মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি হলো- অনেকদিন আগের কথা। এক দেশে ছিল এক গোয়ালা। গোয়ালার ছিল বিভিন্ন প্রজাতির কয়েকশ’ গরু। আর এই গরুগুলোকে কেন্দ্র করে গোয়ালা স্বপ্নের জাল বুনত। কারণ, গোয়ালার পৈতৃক নিবাস ছিল অজো পাড়াগাঁয়ের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেখানকার মানুষগুলো ছিল অত্যন্ত দরিদ্র এবং অশিক্ষিত। আর যেখানে অশিক্ষা বাসা বাঁধে সেখানে কুসংস্কার দাপিয়ে বেড়ায়। কুসংস্কারের কালো থাবায় আচ্ছন্ন সমাজ বা গোষ্ঠীর মানুষগুলোর শিক্ষা ও চেতনা ক্রমেই লোপ পায়। শিক্ষাহীন জাতি কখনোই ভাগ্যের উন্নয়ন করতে পারে না। ফলে তারা ক্রমেই ধাবিত হয় দারিদ্র থেকে দারিদ্র সীমার আরও নীচে। ক্ষুধা নিবারণের জন্য দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের যোগাড় করাটাই তাদের পক্ষে অত্যন্ত দূরূহ হয়ে দাঁড়ায়। দরিদ্রতার যাতাকলে নিষ্পেষিত অভূক্ত মানুষগুলো পুষ্টিহীনতার ফলে রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জরাগ্রস্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এই জরাজীর্ণ মানুষগুলোকে বোঝা থেকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করাই ছিল গোয়ালার বাবার লক্ষ্য। তাই বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত প্রজাতির গরু কিনে এনে গড়ে তুলেছিলেন এই ফার্ম। গোয়ালার বাবা স্বপ্ন দেখতেন এই ফার্মটি অনেক বড় হবে এবং সেই সাথে হবে এলাকার দুস্থ অসহায় মানুষের কর্মসংস্থান। পুষ্টিহীনতার ফলে একটি মানুষও রোগে ভুগবে না। কর্মচাঞ্চল্যে মুখর নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে সচেষ্ট হবে। স্বপ্নপূরণের আগেই গোয়ালার বাবা তিন দিনের জ্বরে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। বাবার মৃত্যুর পর সুযোগ্য পুত্র হিসেবে গোয়ালার ফার্মটির হাল ধরে। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে কিছু দিনের মধ্যে ফার্মের পরিধির প্রসার ঘটে। গরুর সংখ্যাও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সেই সাথে যুক্ত হয় কিছু তোষামোদকারী ও চাটুকারের দল। তোষামোদকারীরা মধুর মাছির মতো গোয়ালার চারপাশে সারাক্ষণই ঘ্যাঁন ঘ্যাঁন করত।

গোয়ালারকে চাটুকারদের চটকদার মিষ্টি কথার ফাঁদে ফেলতে খুব একটা সময় লাগল না। গোয়ালা চাটুকারদের শুভাকাঙ্খি ভেবে ফার্ম রক্ষণাবেক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোতে তাদের নিয়োগ দিল। চাটুকাররা নিয়োগ পেয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে দেখল, গোয়ালা যদি প্রতিদিন ফার্মে এসে তদারকি করে তবে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই তারা একদিন গোয়ালাকে বলল- ‘প্রতিদিন কষ্ট করে আপনার ফার্মে আসার দরকার কি? আমরা তো রয়েছি। আপনি মালিক মহাশয়। আপনি বসে বসে আয়েশ করবেন, ঘুমোবেন আর আমাদের হুকুম দেবেন। আপনার বাবা ছিলেন আমাদের জ্যাঠামশাই। মানুষের কল্যাণ করাই ছিল তার কাজ। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যদি আপনি এতটা পরিশ্রম করতে পারেন তবে আমরা পারব না কেন?”

এহেন কথায় সরল গোয়ালা ভীষণ খুশী হয়ে গেল। এরপর থেকে সে বাড়িতে বসে আয়েশ করত আর ঘুমাত। মাসেও একবার ফার্মে যেত না। এই সুযোগে যে যার মতো পারল লুটেপুটে খাওয়া শুরু করে দিল। কিছুদিনের মধ্যে ফার্মটি ধ্বংসের মোহনায় এসে দাঁড়ল। গরুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ল। আর অসুস্থ গরুর দুধ কেউই কিনতে চাইল না। তাই গরুগুলোর চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়ে গোয়ালা সুদী কারবারীদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিল। তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। একে একে সবকটি গরু মারা গেল। নিঃস্ব গোয়ালা চাটুকারদের কাছে সাহায্য চাইল। কিন্তু কেউই তাকে সাহায্য করল না। সবাই তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। অবশেষে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পাগলপ্রায় গোয়ালা অচিন দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যাওয়ার সময় শুধু বিড়বিড় করে বলল- ‘সেই ঘুম তো ভাঙল, কিন্তু সময় থাকতে ভাঙল না।’

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি-

প্রত্যেক জাতির জীবনেই বিশেষ কিছু গৌরবময় দিন থাকে যা অত্যুজ্জল হয়ে থাকে মানুষের মনের মনিকোঠায় এবং মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে সেসব দিবস উদযাপন করে। বাংলাদেশে বিজয় দিবস এমনি একটি মর্যাদাপূর্ণ ও গৌরবময় দিবস। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালী জাতির বিজয় সাধিত হয়েছে আর সেই সাথে বিশ্বের মানচিত্রে অঙ্কিত হয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মানচিত্র। আমরা অর্জন করেছি সবুজের মাঝে রক্তিম লাল সূর্য খচিত একটি গৌরবময় স্বাধীন দেশের পতাকা। এই বিজয় আমরা একদিনে অর্জন করিনি। বিজয় অর্জন করতে আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। দীর্ঘ নয় মাসের কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী সকলের তাজা প্রাণ আর অসংখ্য মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। অর্জন করেছি স্বাধীনতা। কিন্তু এর বীজ বাঙালীর মনে বপিত হয়েছিল আরোও অনেক আগে। ৫২`র ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতার ফলশ্রুতিতে সংঘটিত হয় পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে জাতিকে মুক্ত করার সংগ্রাম; মুক্তির সংগ্রাম।

৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহসিক ভাষণ- `এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম!` বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণের বাণীতে কোটি কোটি বাঙালীর তিমিত রক্ত টগবগ করে ওঠে। মুক্তি নেশায় শিহরণ জাগে প্রতিটি মানুষের প্রাণস্পন্দনে। এ ভাষণ কেবল ভাষণই ছিলনা, এটি ছিল বাঙালীর বিজয় অর্জনের চালিকা শক্তি; স্বধীনতার মূলমন্ত্র। এ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই বাংলার মানুষ দীর্ঘ সংগ্রামের পর বিজয় অর্জন করে। বাঙালীর স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া সরকার ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করার জন্য জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর নেতৃত্বে সাবেক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সাবেক ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, যুবক, কৃষক-শ্রমিক প্রভৃতি গোষ্ঠির সমন্বয়ে গঠিত হয় মুক্তি বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা নামে মাত্র ট্রেনিং নিয়ে অদম্য সাহসিকতার সাথে মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান নিয়াজী ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পন করে। এভাবেই অর্জিত হয় আমাদের গৌরবময় বিজয়।

`স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন` এর সত্যতা বাঙালী জাতি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছে। যে চেতনা ও সাহস নিয়ে বাঙালী মুক্তিযুদ্ধ করেছে, বাংলাদেশের সাহিত্যে সেই মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ ও পর্যাপ্ত প্রতিফলন এবং প্রতিভাস পড়েনি। বরং জাতীয় জীবনের অনেক স্তরেই আজ মিথ্যার কালিমা লেপ্টে আছে। এর ফলে আমাদের সব গৌরবই যেন অনেকাংশে ঢেকে যেতে বসেছে। মানবিক মূল্যবোধ প্রায় নিঃশেষিত ও বিপন্ন। বিবেক ও মনুষ্যত্ব আজ লাঞ্ছিত ও অপমানিত। এমতাবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমের মূল্যে অর্জিত বিজয় আজ কতটুকু অটুট ও অক্ষত আছে ? নয় মাস ব্যাপী অবরুদ্ধ বাংলাদেশে কী অমানবিক নির্যাতন চলেছিল তার কোন স্মৃতি আমাদের আছে বলে মনে হয় না এবং নতুন প্রজন্মকেও আমরা হস্তান্তর করিনি সেই অভিজ্ঞতা ঘটনা পঞ্জি। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তথা বাঙালীর ত্যাগ তিতিক্ষা ও বীরত্বের সঠিক ইতিহাস ধোয়াচ্ছন্ন।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ প্রতিফলন ঘটেনি। এজন্যই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ভুলুন্ঠিত হতে চলেছে। সাধারণ মানুষ আজ তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল ও মূল্যস্ফীতির ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যায়, অবিচার, অনাচার ও অসত্য আজ সমাজে দেদীপ্যমান। বিজয় অর্জনের এতোটা বছর পরে এসে আমরা বিজয়ের স্বা’দ কতটা গ্রহন করতে পারছি ? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গণাদের আজও কী আমরা দিতে পেরেছি তাদের প্রাপ্য অধিকার ? আজও ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ! দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে বিচারপতিদের শপথ গ্রহনকে কেন্দ্র করে চলে পেশী শক্তির মহরা ! ব্যক্তিস্বার্থকে তরান্বিত করতে হরতালের নামে চলছে জালাও পোড়াও সংস্কৃতি ! ধ্বংস হচ্ছে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ। অপরাজনীতির নির্মম থাবায় অকালে ঝরে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় তাজা প্রাণ ! দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে লাশের মিছিল ! প্রতিদিন সকালে পত্রিকা খুললে এখনো দেখি পত্রিকার সিংহ ভাগ দখল করে আছে খুন ধর্ষণ আর রাহাজানির সংবাদ ! মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ ছিল পরাধীনতার বলয় থেকে জাতিকে মুক্ত করে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা আজও কী পেয়েছি মৌলিক অধিকার ? এখনো দু’মুঠো ভাতের জন্য আমাদের মা বোনদের প্রতিনিয়ত করতে হচ্ছে হাড়ভাঙা পরিশ্রম। দিনের পর দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও পাচ্ছে না তাদের ন্যায্য মজুরি। প্রাপ্য বেতন ভাতা আদায়ের দাবীতে মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে গিয়ে আমাদের মা বোনেরা অহরহ পুলিশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
বিগত দিনে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। “ক্রস ফায়ার” শব্দটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড অনেকাংশে বেড়ে যায়। তৎকালীন সময়ের প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগ এসব কর্মকান্ডের প্রবল বিরোধীতা করলেও বিএনপি-নিজামী সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী একটি বিবৃতির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ। তা হলো- “উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।” “আইন শৃঙ্খলা আগের চেয়ে অনেক উন্নত ও কোথায় বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটছেনা।” মহাজোট সরকারের এক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও এ দুইটি বিবৃতির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। রানা প্লাজা ধ্বসকে কেন্দ্র করে আওয়ামী সরকারের এক মন্ত্রী মিডিয়ায় বিবৃতি দিতে এসে বলেছিলেন- “রানা প্লাজার কাঠামো একটু দুর্বল ছিল। বিরোধীদল মিছিল নিয়ে এসে রানা প্লাজাকে ধরে ঝাকাঝাকি করেছিল তাই রানা প্লাজা ধ্বসে পড়েছে।” বিশ্বের স্বাধীন সর্বভৌম কোন দেশের কোন মন্ত্রী কোনও কালে কখনও এমন উক্তি করেছে কিনা আমার জানা নেই। অপরদিকে এলিট ফোর্স হিসেবে স্বীকৃত র‌্যাব এর ভুল টার্গেটে বলী হচ্ছে বাপ্পীরা। এলিট ফোর্স র‌্যাব এর কিছু বিপথগামী সদস্যকে ভাড়াটে খুনির ভুমিকায় অবতীর্ন হতে আমরা দেখেছি। উদাহরণ স্বরূপ নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার এর কথা বলা যেতে পারে। পুলিশের ডিডেক্টিভ ব্র্যাঞ্চ এর কিছু অসাধু সদস্যকে আমরা অপহরণ এর মত নোংরা কর্মে লিপ্ত হতে দেখেছি। বিজয়ের ছিচল্লিশ বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে এসেও পুলিশি হেফাজতের নামে নিরিহ মানুষকে জিম্মি করে কতিপয় বিপদগামী পুলিশ সদস্য কর্তৃক চলছে ঘুষ বাণিজ্য। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ধাবা থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নিজ দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার লক্ষে ব্রিটেন ও ভারতের মত দেশ যখন ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করছে। ঠিক তখনই আমাদের মত উন্নয়ণশীল দেশে এম.পি. মন্ত্রীদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সেই সাথে চলছে এম.পি. ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের জন্য বিলাস বহুল গাড়ি আমদানীর মহড়া। অপর দিকে এনজিও’র খোলসে কতিপয় সুদী কারবারীদের সুদের বোঝা পরিশোধ করতে গিয়ে সল্প আয়ের মানুষগুলো শেষ সম্বর ভিটে মাটি বিক্রি করে ভাসমান জনতায় পরিণত হচ্ছে। কেউ কেউ সুদের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।

পক্ষান্তরে আমাদের অর্জনও নেহায়েত কম নয়। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মত বিশাল সম্মান আমাদের ঝুলিতে জমা হয়েছে। আমাদের ছেলেরা জ্ঞান বিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য বিশ্বের দরবারে প্রশংসিত হচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মূলধারার রাজনীতিতে আমাদের সন্তানরা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রেখে চলেছে। বিশ্ব ক্রিকেটে শক্তিধর অবদান রাখার ফলে বাংলাদেশে ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট এর আসর। অমর একুশে বিশ্বের বুকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এর স্বীকৃতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। যুদ্ধাপরাধীর বিচারও হয়েছে বাংলার মাটিতে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অবদানের জন্য বিশ্ব আমাদের ঝুলিতে গুজে দিয়েছে বিশেষ স্বীকৃতি। বিজয়ের ৪৬ বছর পর আমাদের আর নতুন করে কোন অঙ্গীকার করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। যে আদর্শ ও চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ বিজয় অর্জন করেছে সেই আদর্শকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই আমরা দেখতে পাবো আমাদের স্বপ্নের সেই সোনার বাংলা। প্রতি বছর বিজয় দিবস আমাদের কর্ণকুহরে যে পরিবর্তন ঘটায় বাস্তব জীবনে তা থেকে আমরা আর বিচ্যুত না হই। আমরা যেন বিজয়ের চেতনাকে মশাল করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য চেষ্টায় মেতে উঠি। আসুন আমরা সেই আশায় বুক বেধে সফলতার জন্যে অপেক্ষা করি। আসুন আমরা বাঙালী জাতির বিজয়ের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে একতাবদ্ধ হই। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান স্বাধীনতার খোলসে মোড়ানো স্বেচ্ছাচারীতার ভূতটাকে দূর করি। কারণ প্রকৃত স্বাধীনতা ছাড়া কোন জাতি গৌরবের আসনে উন্নীত হতে পারেনা। আমরা চাই বাঙালী জাতির মানবিক বিজয়। আর এই বিজয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে সততা ও জবাব দিহিতার প্রয়োজন তা আমরা পাচ্ছি কোথায়! বিগত সব সরকারের আমলেই রাঘব বোয়ালদের আমরা ধরাছোয়ার বাইরে থাকতে দেখেছি। সেই সব রাঘব বোয়ালদের মদদপূষ্ট পুটি টেংরাদের ধরতেই কেবল আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর থাকতে দেখেছি। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে মানবাধিকার খবরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন-এর চেয়ারম্যান ড. কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন- “আমরা এখনও আইনের সু-শাসন দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি।” তবে কি সেই গোয়ালার মতো আমরাও ঘুমিয়ে পড়েছি! যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে আজ বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে- ‘আমাদের ঘুম ভাঙবে কবে?’

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
প্রধান নির্বাহী, বিশ্বসাহিত্য একাডেমি।
ই-মেইল :eliasshagar@gmail.com