পর্যটন
  ত্রিমাত্রিক সবুজ ক্যানভাস পানিহাতা
  01-11-2017

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। ভ্রমন করে না অথবা করতে চায় না এমন মানুষ এই দুনিয়ায় পাওয়া বড় মুশকিল। একঘেয়ে জীবন যাত্রায় মানুষ যখন হাঁপিয়ে ওঠেন, তখন তার অন্তত কিছু সময়ের জন্য একটু আরাম, একটু বিরাম, একটু শান্তির খোঁজে বেরিয়ে পরেন সৃষ্টিকর্তার অপারময় সৃষ্টির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখার জন্য কাছে বা দূরে কোথাও। একজন পর্যটক হিসেবে আপনি ঘুরে আসতে পারেন সারা বিশ্ব। ঢাকার বাইরে ঘুরে আসতে চান? তবে স্বল্প মূল্যে পরিবার নিয়েঘুরে আসতে পারেন দেশের দর্শনীয় স্থান।

আমাদের সুজলা-সুফলা নদী মার্তৃক এই দেশের মধ্যেই রয়েছে পাহাড়, পর্বত সমুদ্র, জঙ্গল, স্থাপত্য, পুরাকীর্তি ইত্যাদি। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য রয়েছে বিনোদনের নানান ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত সম্ভার। আর আপনি যদি একজন পর্যটক হিসেবে ভ্রমণ করতে চান, তবে মাথার ওপর নীল চাঁদোয়া, মেঘে-বৃষ্টিতে ভেজা বাতাস। পায়ের নিচে অন্য এক পৃথিবী। উপভোগ করতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন ত্রিমাত্রিক সবুজ ক্যানভাস হালুয়াঘাটের পানিহাতা।

ভ্রমণ পিপাসুদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন- আলমগীর কবির যারা বৈশ্বিক জলবায়ু সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন, তারা একটি বিষয় নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন থাকেন। সাত’শ কোটি মানুষের উনুন জ্বালানোর ঠেলায় পৃথিবী নাকি ক্রমেই উত্তপ্ত। যার ফলে ঘটছে খরা, সুনামি আর উষ্ণায়ন। এতে দেখা দিয়েছে প্রাণভরে সবুজ উপভোগ করার শঙ্কা। এ শঙ্কার কিছুটা হলেও লাঘব হবে হালুয়াঘাটের পানিহাতা ঘুরে এলে।

প্রশাসনিকভাবে পানিহাতা শেরপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও স্থানীয়দের চলাচল ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট দিয়ে। তাই এর পরিচিতিটা হালুয়াঘাটকে কেন্দ্র করেই। ওখানে গেলে মনে হবে, এ ত্রিমাত্রিক সবুজ ক্যানভাস, তার ওপর উজ্জ্বল রঙের আলপনা এঁকে চলেছে বৃষ্টি অরণ্যের ফুল, অদ্ভুত সব রঙিন পাখিরা, ব্যাঙ, মাকড়সা, আর প্রজাপতির দল।

হালুয়াঘাট থেকে পানিহাতার দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। স্থানীয় উত্তরবাজার থেকে মোটরসাইকেল যেতে লাগে ২০ মিনিট। তবে মূল জায়গায় পৌঁছানোর আগে হাঁটতে হয় বেশ কিছুটা পথ। পাহাড়ি পথ ধরে এগোনোর সময় যে দৃশ্যপট চোখে পড়বে, মনে হবে রোদের খেলার মাঝে এ এক নতুন মায়া জালের বুনন। সারিবদ্ধ গাছ সরু রাস্তা, কোনো ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার আশঙ্কা নেই। তবে মাঝে মধ্যে এলাকাটিতে হাতি আক্রমণ করে। এ বিষয়ে যাওয়ার পথেই স্থায়ীয় বাসিন্দা আর বিজিবির পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেয়া হবে। পানিহাতার মূল আকর্ষণের জায়গাটা হলো খ্রিষ্টান মিশনারি ‘কারিতাস’। এটি তৈরি করা হয়েছে পাহাড়ের ওপর। এটার ভেতরে প্রবেশের সময় সাথে করে বাক্স-পেঁটরা নিয়ে গেলে এখানকার গারো দারোয়ান আপনাকে বা আপনার দলকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেবে না। যেতে হলে বাক্স-পেঁটরা কোথাও রেখে যেতে হবে। অনেকে পিকনিক করতে এসে কারিতাসের মূল এলাকার ভেতরে থাকা ফুলের বাগানের ফুল ছেঁড়া ও তাদের স্থাপনার বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিসাধন করায় এ পদক্ষেপ নিয়েছে তারা।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অংশটা দেখতে চাইলে কারিতাসের এই পাহাড়ে উঠতে হবে। কারিতাসে পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে যিশুর বিভিন্ন রকমের বিশেষ কিছু খুঁটি চোখে পড়বে। চমৎকার কিছু স্থাপনাও আছে। এলাকাটায় গারোদের রাজত্ব। ওপর থেকে চার পাশের দৃশ্যটা দেখতে মনোরম। বেশ কাছেই ভারতে মেঘালয় রাজ্যের একটি সেতু চোখে পড়বে। মনে হবে যেন হাতের নাগালের ভেতরই। সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে ভোগাই নদী। এই নদীই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। শ্রাবণের বৃষ্টিতে মেঘালয়ে পাহাড়ি ঢলের তৈরি হয়। সেই পানি গড়িয়ে পড়ে এই নদীতে। নদী হয়ে ওঠে খরস্রোতা। প্রচণ্ড স্রোতে প্রায়ই ভারতীয় অংশের বড় বড় গাছ ভেঙে নদীতে ভেসে বাংলাদেশের ভেতর এসে পড়ে। স্থানীয় লোকজন এসব গাছ সংগ্রহ করে বিক্রি করে।

বর্ষায় পানি খরস্রোতা থাকায় নদীতে পা ভেজানোর ইচ্ছে পোষণ না করাই ভালো। তবে বৈশাখে পানি কম থাকে। ওই সময়টায় ইচ্ছে করলে গোসলও করা যাবে ভোগাই নদীর স্বচ্ছ পানিতে। স্থানীয় লোকজন নিয়মিতই নদীর পানিতে গোসল করে, খাবারের জন্যও নদীর পানি ব্যবহার করে। গারোদের দেখা যায়, নদী থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করতে। স্থানীয় কয়েকজন ছেলের কাছ থেকে জানা গেল, শামুক-ঝিনুক রান্না করে খায় তারা। আরেকটি বিষয় খুব চমকিত হওয়ার মতো, গারো ছেলেমেয়েরা নিজেদের গারো ভাষার পাশাপাশি খুব ভালো বাংলা বলতে পারে। আর এদের দেখলে মনে হয় মোটামুটি বেশির ভাগই শিক্ষিত। পানিহাতা থেকে হালুয়াঘাট ফিরে যেতে পারেন কড়ইতলা। এটি একটি কয়লার বন্দর। প্রতিদিন ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে অসংখ্য ট্রাকভর্তি কয়লা এসে এই স্থলবন্দরে খালাস হয়। অসংখ্য কর্মী সারা দিন ব্যস্ত থাকে বাংলাদেশী ট্রাকগুলোতে কয়লা তুলতে। এদের একেকজনের চেহারা দেখার মতো! হঠাৎ করে দেখলে অনেককেই মনে হবে ঠিক যেন কয়লা-ভূত। তবে এরা দিনভর পরিশ্রম করে পেট চালায়। উপার্জনও নেহাত কম নয়। এদের কেউ কেউ যে পরিসংখ্যান দিলেন, তাতে অনেকেই মাসে ৩০ হাজার টাকাও রোজগার করেন। অর্থাৎ দিনে এক হাজার টাকা করে। তবে চেহারায় সেটি বোঝার উপায় নেই। এই কড়ইতলার আশপাশেই আছে দেখার মতো কয়েকটি জায়গা। রয়েছে প্রচুর গাছপালা। হাতে সময় নিয়ে এর ভেতরটা ঘুরে আসতে পারেন। স্থানীয় কাউকে গাইড হিসেবে নিলে ভালো করবেন।

যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে যাওয়া যায়। এই বাস যেখানে থামবে সেটিকে নতুন বাসস্ট্যান্ড বলে। ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে শ্যামলী বাংলা, ইমাম ট্রেইলওয়েজ, ছোঁয়া পরিবহন নামের বাসগুলো নিয়মিত এই রুটে চলাচল করে। ভাড়া বাসভেদে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পড়বে। এগুলোর সবই এসিবিহীন। নতুন বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রথমে যেতে হবে উত্তরবাজার। বিদ্যুৎ চালিত অটোতে এই স্থানটিতে যেতে জনপ্রতি খরচ পড়বে ১০ টাকা উত্তরবাজার থেকে দুইভাবে পানিহাতায় যাওয়া যায়। প্রথম উপায় হলো মোটরসাইকেল এবং দ্বিতীয় উপায় হলো অটো ভাড়া করা। মোটরসাইকেলে শুধু যেতে জনপ্রতি সর্বোচ্চ ৮০ টাকা লাগবে। সময় লাগবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট। তবে মোটরসাইকেল ভাড়া করার আগে যতটা সম্ভব দরদাম করতে হবে। নতুন লোক দেখলেই এবং পার্টি মালদার মনে হলে এরা দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। কোনোভাবেই ভাড়া ৮০ টাকার বেশি দিতে যাবেন না।

কোথায় থাকবেন : হালুয়াঘাটে বাস থেকে নেমেই একটু খোঁজ করলে আপনি বেশ কিছু আবাসিক হোটেল পেয়ে যাবেন। রুমের ভাড়া ৫০০-৬০০ টাকা।