ইসলাম
  বাইয়াতের ইসলামী দৃষ্টিকোণ
  01-11-2017

মাওলানা মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দীক আদ্দাঈ

আল্লাহর তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজের জান ও মালকে হকপন্থী আমীর বা নেতার নিকট আনুগত্যের শপথের মাধ্যমে আল্লাহর পথে সপে দেয়ার শপথ, ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতির নাম বাইয়াত। সত্যিকার মুসলিম রূপে আত্ম পরিচয় পেশ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

হাদীসের আলোকে বাইয়াতের প্রকার:

রাসূলে করিম (সঃ) এর নবুওয়াতে জিন্দেগির ২৩ বছর পর্যালোচনা করলে অন্তত পাঁচ ধরনের বাইয়াতের প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন:

১. ঈমানী বাইয়াত
২.বিষয় ভিত্তিক বাইয়াত
৩.আমলের বাইয়াত
৪.আনুগত্যের বাইয়াত
৫. জিহাদের বাইয়াত

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাইয়াতের প্রয়োজনীয়তা:

মুসলিম সমাজ আজ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন । একতার অভাব সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে । সর্বত্র মতবিরোধ আর গোলযোগে ভরপুর । মানবতার ভয়ঙ্কর আর্তনাদ ভারী করছে আকাশ-বাতাস । বিশ্ব জুড়ে মানবতাবাদীদের মানবতা বিরোধী আখ্যা দিয়ে চলছে মুসলিম নির্মুলের পায়তারা। আমরা ভুলতে বসেছি বংশগত মুসলমান আর প্রকৃত মুসলমান এক নয়। ইচ্ছা-অনিচ্ছা জানা-অজানা অবস্থায় আমাদের জীবনের সাথে মিশে গিয়েছে শিরক আর বিদয়াত। এমত অবস্থায় নিজেদের ঈমানকে পরিপুষ্ট এবং বাস্তব জীবন থেকে কর্ম বৈষম্য দূরীভূত করতে এক জন হকপন্থী নেতার নিকট জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মেনে চলার অঙ্গীকার করা ধ্বংসের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে ঈমানের দাবি ।

আজ সমস্বরে গোটা মুসলিম মিল্লাতের পড়ে নেওয়া একান্ত প্রয়োজন "বলো, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ, সব কিছু বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তা’য়ালার জন্য।" (সূরা-আনয়াম: ১৬২)

বাইয়াত কার নিকট হতে হবে :

কুরআন-সুন্নাহের কোন বক্তব্যই একাকী বাইয়াতকে সমর্থন করে না। বরং বাইয়াত সংক্রান্ত সকল হাদীস এবং আয়াতে কারীমা কোন নেতা বা আমীরের নিকট বাইয়াত করাকে ইঙ্গিত করে। যেমন বাইয়াতে রিদওয়ানের ব্যাপারে মহান আল্লøাহর বাণী " হে রাসূল (সঃ) যে সব লোক আপনার নিকট বাইয়াত হচ্ছিল তারা আসলে আল্লøাহর নিকটই বাইয়াত হচ্ছিল। তাদের হাতের ওপর আল্লাহর কুদরতের হাত ছিলো। (সূরা আল ফাতহ: ১০)

এ আয়াতে কারীমায় নবী (সঃ) এর নিকট বাইয়াত করার কথাই বলা হয়েছে । যেহেতু নবী করিম (সঃ) আমাদের মাঝে নেই সেহেতু তাঁর আদর্শের ধারক-বাহক কোন আমীরের নিকট বাইয়াত হওয়াটাই যুক্তিবহ।

নবী করিম (সঃ) ইমাম মাহদীর হাতে বাইয়াত হওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, "তোমরা যখন তাদেরকে দেখতে পাবে তখন তাদের নেতার হাতে বাইয়াত করবে।" (কিতাবুল ফিতান " ইবনে মাজাহ)

সুতরাং বাইয়াত যে হকপন্থী আমীর বা নেতার নিকট করতে হবে তা সুস্পষ্ট ।

বাইয়াত শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী :

১. বাইয়াত অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহের আলোকে হতে হবে । বাইয়াতের রীতি -পদ্ধতি বিষয়বস্তু নবী করিম (সঃ) এর দেখানো পথে হওয়া বাঞ্চনীয়।
২. নবী করিম (সঃ) এর আদর্শের ধারক- বাহক কোন আমীর বা নেতার নিকট হতে হবে।
৩. বাইয়াতের ওয়াদাকৃত বিষয় বস্তুর সাথে কাজের মিল থাকতে হবে। অর্থাৎ বাইয়াত কৃত বিষয়ের ওপর অটুট থাকা অপরিহার্য ।

হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লøাহ্ ( স:) এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেছি শ্রবণ ও আনুগত্যের ব্যাপারে এবং এটা স্বাভাবিক অবস্থা, কঠিন অবস্থা, আগ্রহ ও অনাগ্রহ সর্বাবস্থার জন্য প্রযোজ্য ।

আমরা আরো বাইয়াত গ্রহণ করেছি যে, যে কোন ব্যাপারে আমীরের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হবো না এবং সর্বাবস্থায় সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবো এ ব্যাপারে কোন তিরস্কার কারীর তিরস্কারকে পরোয়া করবো না। (নাসায়ী )

এই হাদীসের আলোকে বাইয়াতের দাবি আমাদের নিকট দৃশ্যমান হয়।

"বাইয়াত বিহীন মৃত্যু জাহেলিয়াতের নামান্তর"- হাদীসটির ব্যাখ্যা :

হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা:) রাসূলে করিম (সঃ) থেকে বর্ণনা করেন "যে ব্যক্তি বাইয়াতের রজ্জু গলদেশে ঝুলানো অবস্থা ছাড়া মারা যাবে তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু।" (মুসলিম ) অধিকাংশ ওলামায়ে কিরামদের মতে, হাদীসটি মূলত ঈমানী বাইয়াতের সাথে সম্পৃক্ত, যে বাইয়াতের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি ঈমানদারের কাতারে গণ্য হয়। সকল আমল কবুলিয়াতের প্রধান শর্ত হলো ঈমান। আর ঈমানী বাইয়াত আল্লাহ তায়ালাকে রব (প্রভু, প্রতিপালক, বিধানদাতা, সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক) এবং নবী (সঃ) কে তাঁর মনোনীত রাসূল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) এর আনুগত্যের মধ্যে প্রবেশ করলো না নিঃসন্দেহে সে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করলে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বা ইসলাম বিমুখ বেঈমানের মৃত্যু হিসেবে পরিগণিত হবে।

লেখক ঃ ধর্মীয় গবেষক, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত
আলোচক ও সহকারী সম্পাদক, মানবাধিকার খবর