প্রবন্ধ
  প্রধানমন্ত্রী ও রোহিঙ্গানীতি এবং দেশের সংখ্যালঘু ইস্যু
  01-11-2017

রোহিঙ্গা কারা? বার্মার এই জনগোষ্ঠীর কোনও দেশ নেই। তারা সেখানকার বৃহৎ জনগোষ্ঠী, তারা আক্রান্ত ও অপমানিত। নিজের দেশ থেকে তারা পালাতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা অভিমুখে। ’শান্তির দেশ’ বার্মাতে নির্বিচারে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। বার্মা সরকারের কার্যত প্রধান সু কি, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত। মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে তিনি সারা বিশ্বের সামনে থেকেছেন। সবার মর্যাদা পেয়েছেন। পারিবারিক ঐতিহ্যেও তিনি সম্মানিত। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নে তিনি কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ নেননি। রাখাইন বার্মার একটি রাজ্য।

এখানেই বেশি রোহিঙ্গাদের বসবাস। একসময় স্বাধীন-স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল। এই রাজ্য বা প্রদেশকে আরাকানও বলা হয়। বার্মার সরকারের দাবি রোহিঙ্গারা রাখাইনের কোনও ঐতিহ্যবাহী নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠী নয়। তারা বহিরাগত এবং ব্রিটিশ আমলে রাখাইনে বসতি গড়ে তুলেছে। অনেক ইতিহাসবিদ এটাকেই জোর প্রচার করেন। কিন্তু ঘটনা পুরো উল্টো। আরাকানে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এই এলাকায় প্রথম ইসলাম ধর্মের আর্বির্ভাব ঘটে অষ্টম-নবম শতাব্দীতে। তখন এখানে শাসন কাজ চালাতেন চন্দ্রবংশীয় হিন্দু রাজারা। রাজধানী ছিল উজালি। বাংলা সাহিত্যে যা বৈশালী নামে পরিচিত।

রোহিঙ্গা কারা এবং এই শব্দের উৎপত্তি কিভাবে? এই নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কিন্তু মোটামুটি একটি সাধারণ বিষয় তার মধ্য থেকে প্রকাশ পেয়েছে তা হলো, আরবীয় মুসলমনেরা সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এই এলাকার তীরে ভিড়লে ’রহম’ ’রহম’ শব্দ উচ্চারণ করে স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করতেন। ’রহম’ শব্দের অর্থ ’দয়া করা’। স্থানীয় মানুষেরা মনে করতেন এরা ‘রহম’ জাতির লোক।

রহম শব্দটি বিকৃত হয়ে রোয়াং এবং রোয়াং থেকে রোহাংগ, রোসাঙ্গ ও রোহিঙ্গা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এরা প্রকৃত অর্থে ধর্মে মুসলমান।

সাম্প্রতিককালে এই রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চরমে উঠেছে। কিন্তু সমস্যা বহু বছরের পুরনো। বৌদ্ধ রাজা বাইন-নুঙ্গের (১৫৫০-১৫৮৯) মুসলমানদের হালাল মাংস খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, কোরবানি করতে বাধা দেয়, জোর করে ধর্মান্তর ঘটায়। ১৯৯২ সালে সামরিক সরকার প্রধান নে উইন সামরিক বাহিনী থেকে মুসলমানদের বের করে দেয়। বামিয়ানে বুদ্ধমুর্তি ধ্বংসের সময় নির্বিচারে মুসলমান হত্যা হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে বার্মার জান্তা সরকারের আমল থেকে আক্রমণ আরও তীব্র হয়। কেমন হিংস্র আক্রমণ তার সামান্য একটা বর্ণনা দেই। রেঙ্গুন থেকে একটি বাস ফিরে যাচ্ছিল রাখাইনে। মাঝপথে বৌদ্ধরা সেটা থামায়। ৯জন মুসলমানকে বাস থেকে নামায়। তার মধ্যে তিনজন ধর্ম প্রচারের কাজে যাচ্ছিলেন। সবাইকে টুকরো টুকরো করে কেটে মৃতদেহের উপর মদ ও থুথ ছেটানো হয়। সারা বিশ্ব তখন এই ছবি দেখেছে।

বার্মায় বৌদ্ধদের রাখাইন বলা হয়। শান্তির বাণী তারা প্রচার করে। মানুষ তো বটেই, পশু হত্যাও ধর্মত তাদের নিষেধ। তারা কেন এত চিন্তার অগম্য।

আসলে ধর্মের আধিপত্য ও সম্প্রদায়গত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতার কাছে ’ধর্ম মানুষের জন্য’ একথা নিতান্তই আপ্তবাক্য। এই ছবি সবাই দেখেছেন, একদল রোহিঙ্গাকে তরবারি উচিয়ে তেড়ে নিয়ে যাচ্ছে ’শান্তিবাদী’ রাখাইনেরা আর বাংলাদেশ সীমান্তে বন্দুক তাদের দিকে তাক করে আছে। সমুদ্রে ভাসছে অসহায় মানুষদের নৌকা। তা ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জল, খাবার কিছু নেই। মা নিজের জিভ সন্তানের মুখে দিয়ে চুষতে বলছেন-তৃষ্ণা মেটাবার জন্য। একটু বয়স হওয়া মেয়েরা বাধ্য হয়ে বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন নানা দেশের পতিতালয়ে। এমন অত্যাচারও করা হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের নামে।

কোথাও কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলা হলেই রোহিঙ্গাদের দিকে নজর পড়ছে। অভিযোগ উঠেছে পুলিশ ফাঁড়ি, সেনা ছাউনি আক্রমণের। অভিযোগ হয়তো অস্বীকার করার নয়, তবে আন্তর্জাতিক চক্র যে এতে মদত দিচ্ছে, সময় সুযোগমত তাতে ঘৃত ঢেলে দিচ্ছে, একথা কি অস্বীকার করা যাবে? যখন কোন সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হয়, সন্ত্রাসী হওয়া ছাড়া আর কি উপায় থাকে তাদের।

অত্যাচারিতদের পক্ষে আত্মরক্ষা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসী হওয়া কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এজন্য সরকার সন্ত্রাসী অভিযোগ তুলে আক্রমণ করবে, নির্যাতনের নৃশংসতা বাড়িয়ে দেবে, তারা দেশের নাগরিক নয় ইত্যাদি অভিযোগ তুলে বিশ^বাসীকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করবে এটাও স্বাভাবিক। তাই ইদানিং তাদের নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। প্রাণের ভয়ে নদী-নালা সাঁতরিয়ে, নৌকা করে দুর্গম বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে হাজারে হাজারে অসহায় রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকছে।

বাংলাদেশ সরকারের ওপর এই অনাকাঙ্কিত বোঝা সেই ’৭৮ সাল থেকে। এবারের মতো এত বড় আকারে শরণার্থী আগে আসেনি। সরকারও আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে তেমন জোরালো উদ্যোগ নেয়নি। যারা এসেছিল তাদের অনেকেই দেশের মূল স্রোতের সাথে মিশে গেছে।

যারা শরণার্থী ক্যাম্পে ছিল তারা একসময় বিহারীদের মতো থেকে যাবে এমনটিই অনুমান করা যাচ্ছিল। মাঝে মধ্যে বি জি বি এবং বার্মার সীমান্তরক্ষীদের মাঝে ফ্লাগ বৈঠক হয়েছে, এই যা। রোহিঙ্গারা ব্যবহৃত হয়েছে ড্রাগ ব্যবসায়ী ও পাচারকারীদের অপকর্মে।

এবার একসাথে এত বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী আসায় সরকারের কিছটা টনক নড়েছে। এত বড় বোঝা বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়।

তথাপি অত্যাচারের নির্মমতায় মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার সহানুভূতি দেখিয়েছে। সেটা যত বাধ্য হয়েই হোক আপাতত মানবতাই তো বড় বিষয়। তবে কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে যত শীঘ্র সম্ভব বিষয়টির সমাধান হওয়া উচিত। এজন্য সরকার আক্রমণ নির্যাতনের তীব্রতা ও শরণার্থী অনুপ্রবেশের চিত্র বি বাসীর কাছে তুলে ধরেছেন।

ইতিমধ্যে তার প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জাতিসংঘ সহ প্রধান প্রধান অনেক দেশ এগিয়ে এসেছে। বার্মা সরকারের প্রতি তাদের সহিংসতা বন্ধের আহ্বানও জানানো হয়েছে। শরণার্থীদের জন্য বিভিন দেশ সাহায্য নিয়েও এগিয়ে এসেছে।

এমনি সময় জাতিসংঘের বাৎসরিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ সপ্তাহে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক পৌছেছেন। বিশ্ব বাসীর কাছে রোহিঙ্গা সমস্যা তুলে ধরা এবার তাঁর অন্যতম প্রধান বিষয় বলে জানা গেছে।

গতবছর প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে সিরিয়ার শরণার্থীদের পাশে থাকার জন্য বিশ্ব বাসীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে ভেসে আসা শরণার্থী শিশু আজলানের লাশের দৃশ্য দেখে বিশ^বাসীর ন্যায় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মনও ভারাক্রান্ত হয়েছিল। এবার মানবতার দৃষ্টিকোন থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, একাত্তরে তিনি নিজেও শরণার্থী ছিলেন। শরণার্থী হওয়ার যন্ত্রণা তিনি উপলব্ধি করেন। তার এ মমত্ববোধ ও মানবিক আবেগে অবশ্যই আমরা গর্ববোধ করি।

আমরা চাই এবং আশা করি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আবেগ-উচ্ছ্বাস, মমত্ববোধ ও ন্যায়পরাছুতা এরূপ মাপকাঠির নিরিখেই পরিমাপিত হবে। কিন্তু কেন জানি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দু’চোখা দ্বৈত নীতি অবলম্বন করে চলেছেন। বিদ্বেষ ও বিমাতাসূলভ আচরণ দেখাচ্ছেন। বার্মা সরকারের অভিযোগ রোহিঙ্গারা সেদেশের নাগরিক নয়। তারা নাকি বাংলাদেশের নাগরিক।

ধরে নিলাম এই অভিযোগে তাদেরকে দেশছাড়া করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও আদিবাসীরা তো জন্মসূত্রে এদেশের নাগরিক। তারা কেন দেশছাড়া হবেন। শোনা যায় রোহিঙ্গারা মুসলিম বলে তাড়িয়ে দিতে তাদের ওপর বৌদ্ধদের এই অত্যাচার-আক্রমণ। তাহলে ধরে নেওয়া কি অন্যায় হবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও আদিবাসীরা মুসলিম নয় বলে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে?

বিষয়টি সত্য বলে বিশ^াস করতে চাইনা। কিন্তু যখন দেখি প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীদের সমব্যথী হয়ে বিশ্ব বাসীর কাছে আবেদন জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য সমব্যথী হন, আজলানের লাশ দেখে ব্যথিত হন, তখন তারই দেশের সংখ্যালঘু আদিবাসী, পাহাড়ীরা আক্রান্ত হচ্ছে দেখে মনে সে প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া অযৌক্তিক মনে করি না।
যখন দেখি রোহিঙ্গাদের ন্যায় রাজশাহীর চিলিরবন্দর, পাবনার সাথিয়া, গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর, নোয়াখালির বেগমগঞ্জ, চট্টগ্রামের হাটহাজারি, রামু, লংগডু, ব্রাম্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং পাহাড়ীরা একই কায়দার আক্রমণের শিকার, তখন প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। দেশের সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং পাহাড়ীরা দেশত্যাগ করছে, তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা দেশের পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে।

স্বাধীনতার পর ৩৩ শতাংশ সংখ্যালঘু এখন ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। চট্টগ্রামে পাহাড়ী ও আদিবাসীরা ছিল ৯১ শতাংশ। সেখানে বাঙালি অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সে সংখ্যা এখন ৪৯ শতাংশ। আর কয়েক বছরে সেখানে বাঙালিদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বাঙালি অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১ শতাংশে।

প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে রোহিঙ্গা অত্যাচারের সমাধান চাইবেন, ভালো কথা। চাওয়া অবশ্যই যৌক্তিক এবং প্রয়োজন, এতে দ্বিমতের অবকাশ নেই। দেশের জনগণও এ বিষয়ে একমত সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে চরম মানবতা দেখিয়েছে। মানুষ মানুষের জন্য মানবতা দেখাবে এটাই স্বাভাবিক। বার্মা সরকারকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে এক্ষেত্রে সমঝোতার সুযোগ নেই। যদি ব্যাপারটি তাই হয়, তবে বাংলাদেশের যেসব সংখ্যালঘু ভারতে শরণার্থী হয়েছেন তাদেরকে ফিরিয়ে আনার দাবিটিও নিশ্চয় যৌক্তিক। সাথে যদি রোহিঙ্গাদের সেদেশে থাকার নিশ্চয়তার দাবি তোলা হয়, একইভাবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের থাকার নিশ্চয়তা বিধানের দাবি তোলাও নিশ্চয় ন্যায়সঙ্গত।আরো যে কারণে যৌক্তিক এবং ন্যায়সঙ্গত তাহলো, যদি তিনি গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন তবে সকলের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সমান।

তবে একথাও ঠিক, গণতন্ত্রের গায়ে তিনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের আলখেল্লা পরিয়ে রেখেছেন। সুতরাং তাকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা কিংবা নিরপেক্ষ বলি কিভাবে?

তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সমস্যা জাতিসংঘে উত্থাপন করতে পারেন না। আপনি নিজের বিরুদ্ধে নিজে অভিযোগ দায়ের করতে পারেননা। অতএব, রোহিঙ্গা ইস্যুই আপনার মূল ইস্যু। এজন্য দুঃখ ও আক্ষেপ করে বলেই রেখেছেন, বিশে^র সব মুসলমান এক হলে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধান কোন বিষয়ই নয়।

অতএব মুসলমান রোহিঙ্গাদের ইস্যুতেই আপনাকে সোচ্চার হতে হবে। আমি কেবল আপনার একমুখী মানবতা ও আড়াল রাখা কর্তব্য সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিলাম মাত্র।

লেখক: কলামিস্ট ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।