পর্যটন
  ঘুরে আসুন লালমাই
  01-10-2017



মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। ভ্রমন করে না অথবা করতে চায় না এমন মানুষ এই দুনিয়ায় পাওয়া বড় মুশকিল। একঘেয়ে জীবন যাত্রায় মানুষ যখন হাঁপিয়ে ওঠেন, তখন তার অন্তত কিছু সময়ের জন্য একটু আরাম, একটু বিরাম, একটু শান্তির খোঁজে বেরিয়ে পরেন সৃষ্টিকর্তার অপারময় সৃষ্টির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখার জন্য কাছে বা দূরে কোথাও। একজন পর্যটক হিসেবে আপনি ঘুরে আসতে পারেন সারা বিশ্ব। ঢাকার বাইরে ঘুরে আসতে চান? তবে স্বল্প মূল্যে পরিবার নিয়েঘুরে আসতে পারেন দেশের দর্শনীয় স্থান। আমাদের সুজলা-সুফলা নদী মার্তৃক এই দেশের মধ্যেই রয়েছে পাহাড়, পর্বত সমুদ্র, জঙ্গল, স্থাপত্য, পুরাকীর্তি ইত্যাদি। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য রয়েছে বিনোদনের নানান ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত সম্ভার। আর আপনি যদি একজন পর্যটক হিসেবে ভ্রমণ করতে চান, তবে তার আদি গোড়াপত্তন ওইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা দরকার।

ভ্রমণ পিপাসুদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন- আলমগীর কবির কর্ম ব্যস্ততার চাপে ইচ্ছে করলেই দূরে কোথাও ঘুরতে বের হওয়া যায় না। ছুটির জন্য আবেদন, ভ্রমণসঙ্গীদের সাথে ছুটি মেলানোসহ নানা ঝামেলার কারণে শেষ পর্যন্ত আক্ষেপ ছাড়া কিছুই করার থাকে না। এরকম পরিস্থিতিতে পরিকল্পনাটা যদি ভিন্নভাবে সাজানো যায় ভ্রমণ তৃপ্তির অভিজ্ঞতা নিতে পারেন খুব সহজেই। রাজধানী ঢাকা থেকে যারা ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছেন, ছুটি মেলাতে পারছেন না, তাদের জন্য লালমাই হতে পারে পলিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ। আলাদাভাবে কোনো ছুটির প্রয়োজন নেই। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেই গিয়ে দেখে আবার তৃপ্তি নিয়ে ফিরে আসতে পারবেন।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে সড়কপথে চলতে গিয়ে কুমিল্লøা পৌঁছার অনেক আগেই চোখ আটকে যাবে একটি পাহাড়ে। উত্তর দক্ষিণে এঁকে-বেঁকে চলে গেছে পাহাড়টি। এর নাম লালমাই পাহাড়। পাহাড়টি ডানে রেখে আরেকটু এগিয়ে গেলে হাতের ডানে ময়নামতি সেনানিবাস। লালমাই পাহাড় অঞ্চল এবং ময়নামতি এলাকার অনেকটা জায়গা জুড়েই প্রাচীন বাংলার মানুষের গড়া নানা সাংস্কৃতিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ময়নামতি অঞ্চলে পাথরযুগের মানুষেরও সন্ধান পাওয়ার কথা লেখা হয়েছে। লালমাই ছাড়াও এ এলাকাটি ময়নামতি ও হিলটিয়া নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের উল্লেখ্য যোগ্য বিহারগুলো হচ্ছে- শালবন বিহার, ভাসু বিহার, সোমপুর বিহার, সীতাকোট বিহার ও দেবীকোট বিহার। মধ্যযুগে বৌদ্ধ রাজত্বের রাজধানী ছিল এই ময়নামতি। ঐতিহাসিকদের মতে, রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী রাণী ময়নামতির নামানুসারে লালমাই অনুচ্চ পাহাড়ী এলাকার নাম রাখা হয় ময়নামতি। কুমিল্ল­া জেলার অধিকাংশ প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি এখানে অবস্থিত। শালবন বিহার, আনন্দবিহার প্রভৃতি দেশের বৃহত্তম ধ্বংসাবশেষ ময়নামতিতে অবস্থিত। এসব বৌদ্ধবিহারে প্রাচীন বৌদ্ধসভ্যতার বহু নিদর্শনাদি পাওয়া গেছে। ১৯৫৫ সালে এখানে যখন খনন কাজ শুরু হয় তখন এসব নির্দেশনের সন্ধান পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ধর্ম ছাড়াও এখানে জৈন ও হিন্দ দেবদেবীর মূর্তিও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এখানকার আবিষ্কৃত প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য একটি জাদুঘরও স্থাপিত হয়েছে। বর্তমানে ময়নামতিতে একটি সেনানিবাস রয়েছে, যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের একটি যুদ্ধঘাটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

শালবন বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুমিল্লা জেলার লালমাই-ময়নামতি প্রতস্থলের অসংখ্য প্রাচীন স্থাপনাগুলোর একটি এই বৌদ্ধ বিহার। এতে সপ্তম-১২ শ’ শতকের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়।

ধারণা করা হয় যে, খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্র্রীভবদেব এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন। শালবন বিহারের ছয়টি নির্মাণ ও পুননির্মাণ পর্বের কথা জানা যায়। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় মন্দিরটি নির্মাণ ও বিহারটির সার্বিক সংস্কার হয় বলে অনুমান করা হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ের নির্মাণকাজ ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয় নবম-দশম শতাব্দীতে।

আকারে এটি চৌকো। শালবন বিহারের প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ। বিহারের চার দিকের দেয়াল পাঁচ মিটার পুরু। কক্ষগুলো বিহারের চারদিকের বেষ্টনী দেয়াল পিঠ করে নির্মিত। বিহারে ঢোকা বা বের হওয়ার মাত্র একটাই পথ ছিল। এ পথ বা দরজাটি উত্তর ব্লকের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের মাঝে ১.৫ মিটার চওড়া দেয়াল রয়েছে। বিহার অঙ্গনের ঠিক মাঝে ছিল কেন্দ্রীয় মন্দির। বিহারে সর্বমোট ১৫৫টি কক্ষ আছে। কক্ষের সামনে ৮.৫ ফুট চওড়া টানা বারান্দা ও তার শেষ প্রান্তে রয়েছে অনুচ্চ দেয়াল। প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে তিনটি করে কুলুঙ্গি রয়েছে। কুলুঙ্গিতে দেবদেবী, তেলের প্রদীপ ইত্যাদি রাখা হতো। এই কক্ষগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন। সেখানে বিদ্যাশিক্ষা ও ধর্মচর্চা করতেন

বিহারের বাইরে প্রবেশ দ্বারের পাশে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি হলঘর রয়েছে। চার দিকে দেয়াল ও সামনে চারটি বিশাল গোলাকার স্তম্ভের ওপর নির্মিত সে হলঘরটি ভিক্ষুদের খাবার ঘর ছিল বলে ধারণা করা হয়। হলঘরের মাপ ১০ মিটার গুণন ২০ মিটার। হলঘরের চার দিকে ইটের চওড়া রাস্তা রয়েছে। প্রতœতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিহারটির ধ্বংসাবশেষ থেকে আটটি তাম্রলিপি, প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা, সিলমোহর, ব্রৌঞ্জ ও মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে। এগুলো বাংলাদেশের প্রাচীন প্রতœতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করছে।

সকালে গিয়ে বিকেলে যখন ঢাকায় ফিরবেন সাথে করে নিয়ে আসাতে পারেন কুমিল্লøার বিখ্যাত রসমালাইও।

যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সহজেই বাসযোগে অথবা ট্রেনযোগে পৌঁছা যাবে কুমিল্লøা। কুমিল্লøা শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে লালমাই অবস্থিত। তবে শুধু বৌদ্ধ সভ্যতার প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে কুমিল্লøা ক্যান্টনম্যান্ট পেরিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে পাঁচ কিলোমিটার সামনে গিয়ে ডানদিকে তিন কিলোমিটার গেলেই চলবে।