আন্তর্জাতিক
  কলকাতার ঐতিহ্যের দুর্গা পূজো
  01-10-2017



॥ অমর সাহা, কলকাতা ॥

এই উপমহাদেশে কলকাতার দুর্গাপূজোর একটা আলাদা নাম আছে, মাত্রা আছে। দুর্গাপূজো বলতে এখনো প্রথম উঠে আসে কলকাতার নাম। শারদীয় এই দুর্গাপূজো বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সেরা পূজো। বসন্তকালেও এই পূজো হয়। কিন্তু বাঙালিদের কাছে এখনও সেরা পূজো বা উৎসব হল এই শারদীয় দুর্গোৎসব। যেখানে বাঙালির বাস সেখানেই দেবী দুর্গা পূজিত হন। যেমন পূজিত হন বাংলাদেশে। শুধু বাংলাদেশ কেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও বাঙালি হিন্দুরা ঘটা করে আয়োজন করেন এই দুর্গোৎসবের। আর ভারতের কথাতো বলার অপেক্ষা রাখেনা। পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরা হল বাঙালিদের সেরা ভুমি। এছাড়া দিল্লি , মুম্বাই, আসাম, মেঘালয়, বিহার, ঝাড়খন্ড, উত্তর প্রদেশ, ওডিশা, ছত্রিশগড়, মধ্য প্রদেশ সর্বত্রই অনুষ্ঠিত হয় এই দুর্গোৎসব। আর একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার সেরা উৎসবও এই শারদীয় দুর্গোৎসব। যেমনটা মহারাষ্ট্রের সেরা উৎসব গনেশ পুজো, উত্তর প্রদেশে রামনবমী, জন্মাস্টমী, দেওয়ালি। ওডিশার রথযাত্রা, আহমেদাবাদে রামনবমী, তামিলনাড়–র পোঙ্গল উৎসব, কেরলের ওনাম উৎসব, গুজরাটে নবরাত্রি উৎসব, হিমাচল প্রদেশ ও দিল্লির দশেরা উৎসব ইত্যাদি। তাই বলতে দ্বিধা নেই, এখনো পশ্চিমবঙ্গের সেরা উৎসব হিসাবে ইতিহাসের পাতায় রয়েছে এই দুর্গোৎসব। এবারও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি।

বাঙালিদের এই সেরা পূজাকে ঘিরে সেজে উঠেছে কলকাতা সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গ। আলোকমালায় ¯œাত হয়েছে কলকাতা শহর সহ গোটা রাজ্য। অলিতে গলিতে তৈরি হয়েছে চমক দেওয়া নানা পূজা মন্ডপ আর ছড়িয়ে পড়ছে আলোর রোশনাই। লাখো লাখো টাকা খরচ হয় এই উৎসবকে ঘিরে। এই উৎসবে কলকাতা ফিরে পায় এক নতুন জীবন। শরতের আগমনী বার্তা দিতে চারদিকে ফোটে কাশফুল। ঢাকের শব্দে মুখরিত হয় কলকাতা সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গ। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠের কন্ঠ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

প্রতিটি মন্দিরে আলাদা মাত্রা এনে দেয়, মনে করিয়ে দেয় দেবী দুর্গা এসেছেন এই মর্ত্যভূমিতে। তোমাদের দ্বারে। বরণ করে নাও। কলকাতার পূজোর একটি আলাদা মাত্রাই আজও সেরা পূজোর তালিকায় বসিয়েছে কলকাতাকে। আজও চলছে এখানে সেই সাবেকি পূজো আর আধুনিক থিমের পূজোর লড়াই। কে কাকে টেক্কা দেবে তার লড়াই। তবে এবারও এগিয়ে থিমের পূজো। এবারও পিছিয়ে নেই কলকাতা। কলকাতার পূজো দেখতে এবারও হাজির দেশবিদেশের ভক্ত আর পর্যটকরা। এসেছে বাংলাদেশ থেকে হাজারো ভক্ত ও পর্যটক। সীমান্তে এখন বিদেশী পর্যটকদের ভিড়ে হিমসিম খেয়েছে শুল্ক ও অভিবাসন দপ্তরের কর্মকর্তারা। বেনাপোল-হরিদাসপুর, গেদে-দর্শনা, আগরতলা, ভোমরা, সব সীমান্তেই মানুষের ঢল নেমেছিল। ছুটে এসেছিল বাংলাদেশের প্রচুর মানুষজন। সেই সঙ্গে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও মানুষ ছুটছেন বাংলাদেশে। কারণ, কলকাতার পর এখন নাম বাংলাদেশের। তাইতো শিকড়ের খোঁজে দুর্গোৎসববে সঙ্গী করে অনেকেই পাড়ি জমায় বাংলাদেশেও। এই চিত্র আজ পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশ সীমান্তের সর্বত্র। কলকাতায় এবারের দুর্গাপুজোয়ও সেই লড়াই অব্যাহত ছিল। সাবেকি বনাম আধুনিকতার লড়াই। তবে এগিয়ে আধুনিকতা বা থিমের লড়াই বা ভাবনা। একইধারার এতটুকু খামতি নেই। কোথাও সাবেকিয়ানায় সেই দোচালা বা চৌচালায় মন্ডপ আবার কোথায়ও আধুনিকতার নানা থিম নিয়ে তৈরি মন্ডপ। প্রতিমা নির্মাণেও একইধারা বর্তমান। কোথায় সেই যুগযুগ ধরে চলে আসা দুর্গার সেই পুরনো মুখ। আবার কোথাও আধুনিকতার প্রলেপে নতুন থিম নিয়ে তৈরি হয়েছে দেবী দুর্গার প্রতিমা। কলকাতার অহিরিটোলা যুবকবৃন্দ এবার তাদের পূজোর থিম করেছে মোবাইল ফোনের নেতিবাচক দিকগুলোকে তুলে এনে। তুলে ধরেছে মোবাইল ফোন কিভাবে মানুষের জীবনের ছন্দপতন ঘটাচ্ছে। পুরীর রথকে থিম করেছে জগৎপুর যুবকবৃন্দ। মানসবাগ সার্বজনীনের এবারের থিম বৃষ্টি

কলকাতার বিবেকানন্দ সংঘ থিম করেছে জলের অপচয় রোধকে। রাশিচক্রকে থিম করেছে আদি লেক পল্লি। বেহালার বুড়ো শিবতলার থিম লাঠি। বড়িশার তরুণ তীর্থের থিম আধাঁর শীতলাতলার কিশোর সংঘের থিম রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দের কবিতা। কুমোরটুলির সার্বজনীনের থিম শিল্পসৃস্টির আঁতুরঘর। বাঁশের বিস্ময়কে থিম করেছে সল্টলেকের এইচ ব্লক দুর্গোৎসব কমিটি। বেহালার নেতাজি স্পোটিং ক্লাবের থিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কাঁকুরগাছি যুবকবৃন্দের থিম মোবাইল ফোন নয়, পোস্টকার্ড, রেডিও, গ্রামোফোন আর টাইপরাইটার যুগকে। কালিঘাট মিলন সংঘ থিম করেছে ’অসষ্ণিুতা নয় , শান্তি চাই’কে। চোরবাগান থিম করেছে সার্কাস প্যান্ডেলকে নিয়ে। দমদম পার্ক তরুণ সংঘ’র থিম গুজরাটের এক বিলুপ্ত গ্রামকে। দমদমপার্ক সার্বজনীনের থিম জাতক কাহিনী। উল্টোডাঙ্গার বিধান সংঘ’র থিম স্মৃতি চিহ্ন। বেহালার জয়শ্রী ক্লাবের থিম স্বর্গ। বেলেঘাটার সরকার বাজার বিবেকানন্দ সংঘের থিম বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা আর পুরুলিয়ার ছৌনৃত্য। নারী শক্তিকে থিম করেছে উল্টোডাঙ্গা যুববৃন্দ। লেকটাউন প্রগতি পল্লির থিম ত্রিশূল, গদা আর চক্র। নিমতলা সার্বজনীনের পুজোয় এবার ফুটে উঠেছে ছাপাখানার ইতিকথা। দুর্গার কেল্লা দেখা যাবে বিশালাক্ষীতলা সার্বজনীনের পুজো মন্ডপে।

বাঁশের নানা কারুকার্য দিয়ে মন্ডপ তৈরি করেছে পূর্ব কলকাতা সার্বজনীন। প্রদীপ সংঘ নতুন পল্লীর থিম এবার সভাঁড়ার ঘরে পড়ছে টান, মা-ই দেবে বাঁচার ত্রাণ’। দমদম মল পল্লীর থিম আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। ভবানীপুর স্বাধীন সংঘের থিম মুখ্যমন্ত্রী মমতার কবিতা সবুজ’। অন্ধকার থেকে আলোয় থিম করেছে কালিন্দীর নবদিগন্ত। পৃথিবীর সেরা কয়েকটি চিত্রকলাকে থিম করেছে জোড়াসাঁকো সাতের পল্লি। দুষণমুক্ত পরিবেশ গড়াকে থিম করেছে সন্মিলিত মালপাড়া সার্বজনীন। জিয়নকাঠিকে থিম করেছে পাটুলি সার্বজনীন। প্রাচীন জমিদার বাড়ির আদলে মন্ডপ গড়েছে হাজরার ২২ পল্লি সার্বজনীন। নিউগিনির এক লুপ্তপ্রায় শিল্পকলা কোমা’কে থিম করেছে সল্টলেক এ-ই ব্লক। সাবেকি প্রতিমাকে তুলে এনেছে বড়িশা মৈত্রী সংঘ। খিদিরপুর মিলন সংঘের থিম ’করেন কী কালিদাস ?’।

’অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’কে থিম করেছে নবপল্লি সংঘ। হরিদেবপুরের বিবেকানন্দ স্পোটিং ক্লাবের থিম বিহারের এক আদিবাসী গ্রাম। দক্ষিণ কলতাতার দেশপ্রিয় পার্কের এবারের পুজোর মন্ডপ তৈরি হয়েছে থাইল্যান্ডের হোয়াইট ট্যাম্পলের অনুকরণে। হিন্দুস্থান পার্কের মন্ডপ তৈরি হয়েছে ’মিলে গেছে আধাঁর আলোয়’ ভাবনাকে নিয়ে। সন্তোষপুর লেকপল্লি এবার তৈরি করেছে ঘূর্ণায়মান মন্ডপ। ’চাইনা বন্দিত্ব, চাই মুক্তি’কে থিম করেছে চালতাবাগান সার্বজনীন। কলেজ স্কয়ারের মন্ডপ তৈরি হয়েছে জয়পুরের রাণী সতী মন্দিরের আদলে। শিয়ালদহ অ্যাথলেটিক ক্লাবের মন্ডপ হয়েছে মুম্বাইর ছত্রপতি রেল স্টেশনের ধাঁচে। সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের মন্ডপ তৈরি হয়েছে লন্ডনের ওয়াচ টাওয়ার, বিগবেন এবং লন্ডন ব্রিজের অনুকরণে।

এখানে দেবী দুর্গা পরেছেন ৮ কোটি রুপি মূল্যের ২৮ কেজি ওজনের সোনার শাড়ি। সিংহী পার্কের মন্ডপ তৈরি হয়েছে মহীশূরের নমদ্রলিং গুম্ফার আদলে। একডালিয়া এভার গ্রিন মন্ডপ তৈরি করেছে চেন্নাইয়ের অস্টলক্ষী মন্দিরের ধাঁচে। বোস পুকুর তালবাগানের এবারের পূজোর থিম ’ যা দেবী সর্বভূতেষু’। আর বোসপুকুর শীতলা মন্দির থিম করেছে ,’পুকুরে সোনার জল’। কলকাতায় এবার সার্বজনীন পুজো হচ্ছে ২ হাজার ৬০০আর রাজ্যে ৩০ হাজার। সেই পূুজো দেখার জন্য এবারেও প্রতিদিন লাইন দিয়ে প্রতিমা আর মন্ডপ দর্শন করেছেন লাখো মানুষ।