সম্পাদকীয়
  মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান হোক
  01-10-2017


মিয়ানমার সরকার তাদের দেশে ৭০০-৮০০ বছর ধরে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সামরিক অভিযান চালিয়ে, গণহত্যা চালিয়ে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করে বাংলাদেশে বিতাড়িত করছে।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে আরো পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। মিয়ানমার সরকার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে বিতাড়িত করছে। প্রক্রিয়াটি চলমান আছে। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা অবর্ণনীয়। বিশ্বজুড়ে জনগণ মিয়ানমার সরকারের ভূমিকার নিন্দায় মুখর।

রোহিঙ্গাদের বিতাড়নকে কেন্দ্র করে সমস্যার প্রকৃতি বোঝার জন্য রোহিঙ্গাদের ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে বহু তথ্য প্রচারমাধ্যমে আসছে। নানা মহলের গবেষণার মাধ্যমেও উন্মোচিত হচ্ছে নানা তথ্য ও ঘটনা। এসবের মধ্যে নানা মতলবে কোনো কোনো মহল থেকে মিথ্যা প্রচার দিয়ে সমস্যাকে জটিলও করে তোলা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জনমত আর বিভিন্ন দেশের সরকারের মত একরকম নয়।

রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ে যেসব তথ্য সামনে এসেছে তাতে বোঝা যায়, সমস্যা অতি পুরনো ও অত্যন্ত জটিল। ৭০০-৮০০ বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন বা আরাকানে বসবাস করা সত্ত্বেও মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করছে না। বৃহৎ শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে সমস্যাটিকে ব্যবহার করে আসছে। কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন যে সুপারিশ ঘোষণা করেছিল, বাংলাদেশ তা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করে আসছে। এখনো সফল হয়নি। বৃহৎ শক্তিগুলোর কূটনীতি সমস্যাকে জটিল করে চলেছে। মিয়ানমার সরকারের বেপরোয়া ভূমিকার সামনে বাংলাদেশ সরকারকে অসহায়ের মতো দেখা যাচ্ছে।

রাশিয়া, চীন ও ভারত মিয়ানমারের পক্ষ অবলম্বন করে সমস্যার সমাধানের কথা বলছে। অনেক সরকার ও কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ মানবিক বিপর্যয় দেখে সেদিক থেকে সমস্যার সমাধানের কথা বলছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে থেকে সমস্যার সমাধানের কথা বলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ বাংলাদেশের ভূমিকার খুব প্রশংসা করছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কথার ওপর আস্থা রাখা যায় না। আর জাতিসংঘে তো শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোরই সংঘ।

রোহিঙ্গা সমস্যাকে বাংলাদেশের জনগণ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বড় সমস্যা হিসেবে দেখছে কিন্তু আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিভিল সোসাইটি সেভাবে উপলব্ধি করছে বলে মনে হয় না। তাদের বক্তব্যেও পারস্পরিক ভিন্নতা ফুটে ওঠে। এনজিও মহল তাদের অবস্থানে থেকে কথা বলছে এবং কাজ করছে। এই বহুত্ববাদী বাস্তবতায় বাংলাদেশের জাতীয় অনৈক্য প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুত্ববাদ দারুণ জাতীয় অনৈক্যের পরিচয়কে প্রকটিত করছে। এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে দুর্যোগের মুহূর্তে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর সামনে নিজেকে ঐক্যহীন ও দুর্বল প্রমাণ করছে। আমরা চাই, বহুত্ববাদ নয়, বহুত্বমূলক সংহতি; আমরা চাই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। বহুত্ব ও বৈচিত্র্যকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে ঐক্য। এনজিও ও সিএসও মহল থেকে প্রচারিত বহুত্ববাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও জনজীবনের জন্য সমূহ বিপদের কারণ হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যের কোনো সম্ভাবনাই এখন দেখা যাচ্ছে না

রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে একটি সূক্ষ্ম চক্রান্ত চলছে । রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত আরো অনেক আগেই বাংলাদেশের বোঝা দরকার ছিল। বুঝে কাজ করা দরকার ছিল। এখন সমস্যা যে পর্যায়ে গেছে এবং বাংলাদেশ সরকারের ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে অবস্থা, তাতে বাংলাদেশ কী করতে পারবে? বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার দুর্দশাগ্রস্ত বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে সম্পূর্ণ মানবিক বিবেচনায়। বাংলাদেশ তাদের মিয়ানমারের নাগরিক মনে করে। বাংলাদেশ চায়, মিয়ানমার তাদের ফেরত নিক এবং নাগরিকত্ব দিয়ে তাদের সচ্ছল-সম্মানজনক জীবনের অধিকারী করুক। কিন্তু মিয়ানমার তাদের মিয়ানমারের লোক মনে করে না।

এমতাবস্থায় অবস্থা ঘনিভূত থেকে আরও ঘনিভূত হচ্ছে। তাই দল-মত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে অবস্থা মোকাবেলা জরুরী। প্রচ্ছদ প্রতিবেদন