প্রবন্ধ
  মানবাধিকার সংস্কৃতির স্বরূপ
  06-12-2016

মানুষের জন্মগত অধিকারই মানবাধিকার। অর্থাৎ যে যে পরি¯িদতিতে জন্মগ্রহণ করুক না কেন তাতে মানুষ হিসেবে তার মর্যাদার কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। সে দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করতে পারে। এই কারণে তাকে শ্রেণি বৈষ্যম্যের পাল্লায় ওঠানো যাবে না। সে যে কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবারে জন্মগ্রহণ করতে পারে, তার জন্য কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক পরি¯িদতি তাকে নৃসংসতম পরি¯িদতিতে ঠেলে দেবে না। মানবাধিকার সংস্কৃতির মৌলিক শর্তই হলো মানুষ হিসেবে অধিকার লঙ্ঘনের কোনো বিপর্যয় মানুষের বেঁচে থাকাকে কলঙ্কিত করবে না। আজকের বিশ্ব এই সত্যকে মেনে চলছে না। মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের অন্যায় আচরণের সাংস্কৃতিক দূষণে বিপর্যস্ত হচ্ছে সংস্কৃতির পরিশীলিত জায়গা।
পৃথিবী জুড়ে একথা প্রতিষ্ঠিত যে মানবাধিকার সর্বজনীন। অধিকারের অগ্রগতি যেমন অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করে, এগিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি অধিকার লংঘন অন্য অধিকারকে ক্ষতির পাল্লায় উঠিয়ে দেয়। অধিকারের হেরফের ঘটিয়ে মানুষের মাথা হেট করা উচিত নয়। মানুষকে হেয় বা তাচ্ছিল্য করা যাবে না। এটাই হবে মানবিক সংস্কৃতির মেটালিক শর্ত। এই শর্ত মেনে চললে মানবাধিকারের সংস্কৃতির পূর্ণ মাত্রায় মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। এই প্রসঙ্গে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যে কথাটি বলেছেন তা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন “যে দেশের মানুষের যত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।”
এই পংক্তির দুর্ভিক্ষ শব্দটি নানা মাত্রা ধারণ করে আছে। অন্যকথায় এখানে দুর্ভিক্ষ মানবাধিকার সংস্কৃতির পিছটানের শব্দ। এই দুর্ভিক্ষ হচ্ছে মানবিক চৈতনাবোধের অভাব, রাষ্ট্রের সুশাসনের অভাব, পরমত সহিষ্ণুতার অভাব ইত্যাদি এমন আরও অনেক কিছু। মত প্রকাশের স্বাধীনতা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাকে দীপ্ত করে। দীপ্ত করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেতনাকেও। এর পাশাপাশি নাগরিক জীবনকে যদি মূল্যবোধ বিপর্যয়ের বড় ঘটনা গ্রাস করে তবে তা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের শামিল হয়। এই দুঃসময়ে নির্যাতনের শিকার হয় শিশুরা। নারী নির্যাতনে ভরে যায় দেশের আনাচ-কানাচ। নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা গ্রাস করে সমাজকে। দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়। লাগামহীন দুর্নীতি নষ্ট করে উন্নয়নের মূল ¯্রােত। ক্ষতিগ্রস্ত হয় জনজীবন। এটাও এক ধরনের দুর্ভিক্ষ। ক্ষুদ্র চেতনার আকাল।
এই আকাল দূর করার জন্য ১৯৪৮ সালে গৃহীত হয়েছিল মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষনাপত্র। এই ঘোষণাপত্রে অধিকারসমূহের দুটি ভাগ রয়েছে। একটি হলো নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার। অপরটি হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার। প্রথমটিতে বাইশটি অনুচ্ছেদ আছে।
অনুচ্ছেদ ১৮ -তে উল্লিখিত আছে ‘নিজস্ব বিশ্বাস ও ধর্যের স্বাধীনতার অধিকার’। অনুচ্ছেদ ১৯-এ আছে ‘মতামত দেওয়া ও তথ্য পাওয়ার স্বাধীনতা’। অনুচ্ছেদ ২০ -তে আছে ‘শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ ও সংগঠন করার অধিকার’। পরের ধারার ২৫ অনুচ্ছেদে আছে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাত্রার অধিকার।’ ২৬ অনুচ্ছেদ ‘শিক্ষার অধিকার।’ ২৭ অনুচ্ছেদ ‘সাংস্কৃতিক জীবনে অবাধে অংশগ্রহণের অধিকার।’
অনেক ধারার মধ্যে মাত্র কয়েকটি ধারার উল্লেখ করা হলো। শেষ ধারাটিতে সাংস্কৃতিক জীবনে অবাধে অংশগ্রহণের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সাংস্কৃতিক জীবন মানুষের পূর্ণ জীবনমানের অধিকার। এই সাংস্কৃতিক চেতনা জীবন প্রবাহের সামগ্রিক বোধ থেকে উৎসারিত হয়। যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের সাংস্কৃতিক শিক্ষাকে বিকশিত করে। মতামত দেওয়া ও তথ্য পাওয়ার অধিকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেতনাকে সমৃদ্ধ করে।
মানবিক অধিকারে মানুষের সুনাগরিকের প্রত্যয় দৃঢ় হয়। মানুষ অপশক্তির হাতে পীড়িত হয় না। অন্যায় আচরণের শিকার হয় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি মানুষকে গ্রাস করে না।
তাই মানবাধিকার সংস্কৃতির চর্চা গণমানুষের নৈতিক আচরণের অন্যতম দিক। এর বাইরে মানুষ হিসেবে মানুষের সর্বাদাকে সমুন্নত রাখা কঠিন।


সেলিনা হোসেন