সারাদেশ
  দ্বীন প্রচারে হযরত নূহ ও মূসা (আ:) এর অবদান
  01-11-2016

 

মাওলানা মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক আদ্দাঈ

 

পৃথিবীর সকল নবী রাসূলগণের দাওয়াতের প্রধান বিষয় বস্তু ছিল তাওহীদ। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আমি প্রত্যেকটি জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি যাতে করে তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতি শক্তি সমূহকে বর্জন করো।”

(সূরা নাহলঃ ৩৬)

া হযরত নূহ (আঃ) এর দাওয়াত ঃ

 হযরত নূহ (আঃ) ছিলেন হযরত শীস (আঃ) এর বংশধর। তিনি দীর্ঘ ৯৫০ বছর দাওয়াতী কাজ করেন। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সীমাহীন চেষ্টা সাধনা করে কওমের লোকদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেছিলেন। প্রতিদিন তিনি পাহাড়ে আরোহন করে উচ্চস্বরে স্বীয় কওমের উদ্দেশ্যে বলতেন, “হে আমার সম্প্রদায় আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং আমি তার প্রেরিত নবী। তোমরা আমার কথা মেনে চললে তিনি তোমাদের সকল গুনাহ মাফ করে রহমত , করুণা এবং অনাবিল শান্তি বর্ষণ করবেন।”

কিন্তু তাঁর এ দাওয়াতের ফলে মাত্র চল্লিশ জন পুরুষ ও চল্লিশ জন নারী দ্বীনে দীক্ষিত হয়েছিলেন। অন্যান্য সকলেই তাকে পাগল বলে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতো এবং তার  উপরে অমানুষিক নির্যাতন চালাতো। পায়ে শিকল বেঁধে মাটিতে টানতো। এমন জুলুম নির্যাতন সহ্য করেও তিনি দ্বীনের কাজ থেকে পিছপা হননি। মহান আল্লাহর বাণী,

“আমি নূহকে তার জাতির নিকট পাঠাই। সে তাদের বললো, হে আমার জাতির লোকেরা, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন মা’বুদ নেই। আমি তোমাদের ওপর এক কঠিন দিনের আযাবের আশঙ্কা করছি। (সূরা আল-আরাফঃ ৫৯)

সূরা হূদের (২৭-২৯) নং আয়াতে বলা হয়েছে ,“ নূহের জাতির কাফির নেতারা বললো , আমরাতো তোমাকে আমাদের মতো মানুষ ছাড়া আর কিছু দেখছিনা। আমরতো দেখছি আমাদের মধ্যে যারা প্রকৃত পক্ষে অথর্ব ও অধম তারা ছাড়া আর কেহ তোমার অনুসরণও করে না। আমরাতো আমাদের ওপর তোমার কোন শ্রেষ্ঠত্ব দেখছিনা। বরং আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদী  মনে করি।

তিনি (নূহ)  বললেন, হে আমার জাতি! ভেবে  দেখ,আমি যদি আমার পালন কর্তার পক্ষ থেকে স্পষ্ঠ সাক্ষ্য-প্রমানের ওপর থাকি, আর তিনি যদি তার নিকট হতে আমাকে রহমত দান করে থাকেন, তার পরেও তা তোমাদের চোখে না পড়ে। তাহলে আমার কাছে এমন কী উপায় আছে যার সাহায্যে তোমরা মানতে না চাইলেও  আমি জোর করে তোমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারি?

আর হে আমার জাতি! আমি তো এ জন্য তোমাদের কাছে কোন অর্থ চাই না, আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহর নিকট। আমি কিন্তু ঈমানদারদের তাড়িয়ে দিতে পারিনা,তারা অবশ্যই তাদের পালন কর্তার সাক্ষাত লাভ করবে বরং তোমাদেরকেই আমি অজ্ঞ সম্প্রদায় দেখছি।”

কুরআনুল ক্বরীমের ২৮টি সূরায় নূহ (আ:) প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। হযরত নূহ (আ:)দিবারাত্রি প্রানন্তকর চেষ্টা করেও যখন কওমের লোকদের মধ্যে নগণ্য, গরিব, নিস্ব কয়েকজন ব্যতীত আর কাউকে হেদায়াতের পথে আনতে ব্যর্থ হলেন তখন আল্লাহর নিকট নিবেদন করলেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার সম্প্রদায়কে দিনরাত্রি আহবান করেছি। কিন্তু আমার আহবানে তাদের শুধু পলায়ন প্রবনতাই বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি যখনই তাদেরকে আহবান করি যাতে তুমি ওদের ক্ষমা করো, তখনই ওরা কানে আঙুল দেয়, বস্ত্রাবৃত করে নিজেদের ওপরও জিদ করতে থাকে এবং অতীশয় ঐদ্ধত্য প্রকাশ করে। এরপর তাদেরকে প্রকাশ্যে আহবান করেছি, সোচ্চার প্রচার করেছি এবং গোপনে উপদেশ দিয়েছি।” (সূরা নূহঃ ৫-৭)

নূহ (অ:) এর সম্প্রদায়  তাকে পাগল ও স্পষ্ট পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করে। পাথর মেরে হত্যার হুমকি দেয় এবং তার জীবন নাশের ষড়যন্ত্র করে। এমন চরমাবস্থায় ব্যথিত হয়ে নূহ (আ:) আল্লাহর দরবারে তার অবাধ্য সম্প্রদায়ের ওপর আসমানী গজব নাযিলের পার্থনা করেন। ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তায়ালা শাস্তি স্বরূপ মহাপ্লাবন ঘটান।

কোন কোন গবেষকের মতে, এ সময় পৃথিবীতে ৫-১০ লাখ লোক ছিলো এবং প্লাবিত এলাকার পরিমান ছিলো ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গ মাইল। তাঁর সম্প্রদায় দজলা(নীলনদ) ও ফোরাত( ইউফ্রেটিস) নদীর অববাহিকা থেকে সুদূর আরব পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। আবার কারও কারও মতে এ প্লাবন ছিলো বিশ্ব জুড়ে।

া হযরত মূসা (আঃ)এর দাওয়াতঃ

মিশরের কাফির স¤্রাট ফেরাউন খ্যাত দ্বিতীয় রামিসেস সিদ্ধান্ত দিয়েছিল বনী ইসরাঈলের উপর সীমাহীন নিপীড়ন চালাতে এবং কোন পুত্র সন্তান জন্ম নিলে তাকে হত্যা করতে। কিন্তু ¯্রষ্টার অভিপ্রায়-সেই বনী ইসরাঈলের গৃহে জন্ম নেয়া শিশু সন্তান হযরত মূসা(আঃ) কে তিনি ফেরাউনের গৃহেই প্রতিপালন করেন। অতঃপর এই শিশু পুত্র যখন পরিপূর্ণ বয়সে পদার্পন করে তখন নিদর্শন স্বরুপ দান করলেন লাঠি  সর্প হয়ে যাবার মতো বিস্ময়কর মুজিজা। এমনকি তাকে সহযোগিতা করতে তাঁরই আপন ভ্রাতা হারুন (আঃ)কেও একই দায়িত্বে মনোনয়ন করা হয়। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন,

“তুমি এবং তোমরা ভ্রাতা আমার নিদর্শনসহ ফেরাউনের নিকট যাও, কেননা সে ঐদ্ধত্য প্রকাশ করেছে আর আমার স্মরণে শৈথিল্য প্রদর্শন করো না। অতঃপর তোমরা তার সাথে ন¤্রতার সহিত কথা বলো হয়তো সে চিন্তা ভাবনা করবে অথবা ভীত সন্ত্রস্থ হবে।” (সূরা তোয়াহাঃ ৪২-৪৪)

হযরত মূসা ও হযরত হারুন (আঃ) ফেরাউনেরন কাছে পৌঁছে তার সামনে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করলেন। তারা বললেন আমরা উভয়েই তোমার পালন কর্তার প্রেরিত রাসূল। অতএব আমাদের সাথে বনী ইসরাঈলকে যেতে দাও এবং তাদেরকে নিপীড়ন করোনা। ফেরাউন জিজ্ঞাসা করলো , তবে হে মূসা তোমার পালন কর্তা কে ? হযরত মূসা (আঃ) জবাবে বললেন , আমাদের পালন কর্তা তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্য আকৃতিতে পালন করেছেন এবং পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি ভুল করেন না এবং কোন কিছু ভুলেও যান না।

এত কিছু শ্রবন করেও অভিশপ্ত ফেরাউন আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলো না বরং আল্লাহ প্রদত্ত নিদর্শন অবলোকন  সত্ত্বেও তাদেরকে জাদুকর বলে আখ্যায়িত করলো। ফলশ্রুতিতে অবাধ্য ফেরাউন সম্প্রদায়ের উপর নানা প্রকার বিপর্যয় নেমে এলো। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দুর্ভিক্ষ, বন্যা, পঙ্গপাল, ব্যাঙের উপদ্রব, এবং পাত্রের পানি রক্তে পরিনত হওয়া সহ বিভিন্ন দুর্যোগ দিয়ে পরীক্ষা করলেন। কিন্তু এতেও যখন কোন শুভ ফল হলোনা তখন আল্লাহ তাদেরকে নীলনদে মতান্তরে লৌহিত সাগরে ডুবিয়ে মারলেন। এই মর্মে সূরা তোয়া-হা এর ৭৮ নং আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে,

“অতঃপর ফেরাউন তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল এবং সমুদ্র তাদেরকে সম্পূর্ণ রুপে নিমজ্জিত করলো”।

হযরত মূসা (আঃ) এর চাচাতো ভাই কারুন অফুরন্ত ধন সম্পদের অধিকারী ছিলো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর বর্ণনা মতে , কারুনের ধন ভা-ারের চাবি বহন করতে ষাট জন শক্তিশালী  কর্মচারী  লাগত। তাওরাত গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে তার সিন্দুকের চাবী বহন করতে সত্তরটি উষ্ট্রের প্রয়োজন হত। কিন্তু কারুন ছিলো অহংকারী। যে আল্লাহ তাকে এতো বিপুল সম্পদের অধিকারী করেছেন সে আল্লাহর প্রতি তার মোটেও কৃতজ্ঞতা ছিলনা। বনী ইসরাঈলের সাধারণ মানুষ তখন সীমাহীন দরিদ্রতায় বিপর্যস্থ। কারুন এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সে অন্যদেরকে হেয় চোখে দেখতো। আর সম্পদকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের চাবি কাঠি মনে করতো। আল্লাহর নবী হযরত মূসা (আঃ)  তাকে সম্পদের যাকাত প্রদানের আহ্বান জানালে সে অস্বীকৃতি জানায় এবং দ্বীনের শত্রুতায় মেতে উঠে। এমনকি তার সম্মানের উপরও আঘাত হানার চেষ্ঠা করে। ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাকে এবং তার সমুদয় সম্পদ  ভূগর্ভে চিরদিনের জন্য বিলীন করে দেন।

                 

অতঃপর আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা (আঃ)  কে সিরিয়া জয় করে সেখানে দ্বীন প্রচারের নির্দেশ দেন। কিন্তু সিরিয়ায় দ্বীন প্রচারে উজ বিন উনুক নামে এক দাম্ভিক পালোয়ান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আল্লাহর নবী মাত্র দুই জন সহচর নিয়ে বিশাল দেহের অধিকারী এই পালোয়ানের বিরুদ্ধে অভিযানে বের হন। হযরত মুসা (আঃ)কে দেখেই উক্ত পালোয়ান অগ্নিশর্মা হয়ে মস্ত বড় পাথর খ- নিয়ে ছুটে আসে। এ সময় আল্লাহ তায়ালা বিরাট আকৃতির একটা হুদহুদ পাখি পাঠিয়ে দেন। যা উজের মাথার পাথরটিকে ছিন্দ্র করে ফেলে, ফলশ্রুতিতে ঐ পাথরটি তার মাথার উপর দিয়ে ঢুকে গলায় পরিহিত হয়ে যায়। তারপর হযরত মুসা (আঃ) এর লাঠির আঘাতে উজ বিন উনুক প্রাণ ত্যাগ করে। উজের পতনের ফলে সিরিয়ায় ইসলামের বিজয় সূচিত হয় এবং মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে যায় দ্বীনের আহ্বান।

 

লেখক: আলেমেদ্বীন, কবি ,কলামিস্ট ও সহকারী সম্পাদক, মানবাধিকার খবর