রাজনীতি
  সিলেটে মানুষরুপী অমানুষের বর্বরতার শিকার খাদিজা
  01-10-2016

মানবাধিকারের উপর চরম আঘাত

সিলেটে মানুষরুপী অমানুষের বর্বরতার শিকার খাদিজা

বিশেষ প্রতিবেদক:

 

‘বদরুল ২০১০ সাল তাকি আমরার বাড়িত লজিং আছিল। মাস্টর মানুষ। তাঁরে বহুত আদর-যতœ করছি। সে জওয়াব দিছে আমার ভাতিঝিরে কুফাইয়া। দুধ-খলা দিয়া আমরা কালা সাপ পুষছি।’ কথাগুলো বলছিলো খাদিজার চাচা আবদুল কাইয়ুম।

গত ৩ অক্টোবর খাদিজার সঙ্গে তাঁর কুশল বিনিময় হয় এবং তিনি প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি খাদিজার কাছে উত্থাপন করেন। তাঁদের দুজনের প্রেম যেন ভেঙে না যায়, তা নিয়ে তিনি অনুনয়-বিনয় করেন। কিন্তু খাদিজা সেটি মেনে না নিয়ে তাঁকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর খাদিজা পরীক্ষার হলে প্রবেশ করেন।

বদরুল পরীক্ষা শুরু হওয়ার অনেক আগে সকাল ১০টার দিকে তিনি এমসি কলেজে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং খাদিজা কলেজের কোন ফটক দিয়ে প্রবেশ করেন, সেদিকে নজর রাখতে শুরু করছিলেন। খাদিজা পরীক্ষার হলে গেলে বদরুল একটি কোমল পানীয় ও পানির বোতল কিনে অফিস পিয়নের মাধ্যমে খাদিজার কাছে পাঠান। কিন্তু খাদিজা সেসবও নিতে অস্বীকৃতি জানান। পরীক্ষা শেষে খাদিজা হল থেকে বেরিয়ে এলে তিনি রাগের মাথায় সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা ও বুদ্ধিতে চাপাতি দিয়ে খাদিজাকে এলোপাতাড়ি মাথা, হাতসহ শরীরের নানা জায়গায় কোপাতে থাকেন। এরপর দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে জবানবন্দিতে বলছিলেন বদরুল। গত ৫ অক্টোবর বদরুলের জবানবন্দি ১৬৪ ধারায় নথিভুক্ত করেন মহানগর আদালতের অতিরিক্ত বিচারিক হাকিম উম্মে সরাবন তহুরা। বেলা ২টা ৪০ মিনিট থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তাঁর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়।

জবানবন্দি গ্রহণ শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের মামলার তদন্ত-তদারকের দায়িত্বে থাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) জেদান আল মুসা বলেন, ‘বদরুল সবকিছু স্বীকার করে নিয়েছেন। এ জন্য দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে আমরা এ মামলার চার্জশিট আগামী ১৫ দিনের মধ্যে দিতে পারব।’ জবানবন্দি গ্রহণের পর বদরুলকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রকাশ্যে সবার সামনে কোপানো হয় খাদিজাকে। নৃশংসতার শিকার কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসের অবস্থা সংকটাপন্ন। খাদিজা বেগম এখন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। হাসপাতালের মেডিসিন অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের পরামর্শক মির্জা নাজিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘৭২ ঘণ্টা শেষ না হলে কিছুই বলা সম্ভব না। তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন। তবে আমরা এখনো আশাবাদী।’ উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর মতো শারীরিক অবস্থা খাদিজার নেই বলেও তিনি জানান। স্কয়ার হাসপাতাল সূত্র মানবাধিকার খবরকে জানিয়েছে, খাদিজার মাথায় যে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, তাকে ‘ডিকম্প্রেশন ক্রেনিয়েকটমি’ বলা হয়। এই অস্ত্রোপচারের উদ্দেশ্য মস্তিষ্কের ওপর তরলের চাপ কমানো। চাপাতি দিয়ে আঘাত করায় খাদিজার মাথায় প্রচুর রক্ত জমে গিয়েছিল। এই চাপ তাঁর মস্তিষ্ক সহ্য করতে পারেনি। তাই তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। গত ৪ অক্টোবর অস্ত্রোপচার করে চিকিৎসকেরা প্রথমে ওই রক্ত অপসারণ করেন। তবে অস্ত্রোপচারের পর খাদিজার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে কি না, তা এখনই বোঝার কোনো উপায় নেই। খাদিজা এখনো লাইফ সাপোর্টে আছেন। রোগীর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে ৭ অক্টোবর লাইফ সাপোর্ট কিছুক্ষণের জন্য প্রত্যাহার করে চিকিৎসকেরা একটি সিটি স্ক্যান করার চেষ্টা করবেন।

বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা। হামলার ঘটনায় বদরুল আলমকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ দিকে বদরুলকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে নিজেদের কেউ নন বলেও দাবি করেছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন শাহজাদা স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বৃহৎ ছাত্র সংগঠন হওয়ায় অসংখ্য নেতা-কর্মী এ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। কারও ব্যক্তিগত অপকর্মের দায়ভার ছাত্রলীগ কখনো নেবে না।’

সাংগঠনিক নিয়মেই কর্মক্ষেত্রে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে বদরুলের সদস্যপদ বাতিল হয়েছে বলেও জানানো হয় বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, ‘যেহেতু তিনি বর্তমানে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং অন্য একটি পেশায় কর্মরত, তাই গণমাধ্যমের সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি সন্ত্রাসী বদরুল আলমের ব্যক্তিগত অপকর্মের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে জড়াবেন না বা নাম ব্যবহার করবেন না।’

কলেজছাত্রী খাদিজাকে কুপিয়ে আহত করা বদরুল আলমের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ৪ আক্টোবর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা নগরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানোর এই ভিডিও ফুটেজ মুহূর্তেই ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তোলপাড় শুরু হয় সারা দেশে। এই হামলার দৃশ্য দেখে হতবাক দেশের মানুষ। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বদরুল একটি চাপাতি দিয়ে মাটিতে ফেলে নার্গিসকে এলোপাতাড়ি কেপাচ্ছেন। দূর থেকে এই কোপের শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল। এর পরই সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বদরুলের বিচার দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামেন। উত্তাল হয় সিলেটসহ সারা দেশ।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক স্কয়ার হাসপাতালে খাদিজাকে দেখতে গিয়ে গত ৫ অক্টোবর সাংবাদিকদের বলেন, ১৫ দিনের মধ্যে পুলিশকে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে ২ মাসের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে পরামর্শ।

সমাজে মানুষের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি মানুষের মনুষত্য, মানবিকতা, বিবেক। যার দরুন আজ মানবাধিকার নামে ছোট শব্দটির ব্যপ্তি অনেক হলেও বিলুপ্ত প্রায়। একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘন জনিত অসংখ্য ঘটনা সঠিক বিচার না হওয়ায় দেশকে কঠিন সংকটে ফেলেছে যার করুন বর্বরতার শিকার সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজা। বিলুপ্ত মানবাধিকার পুনরুদ্ধারই এই সংকট থেকে উত্তরোনের একমাত্র উপায়।

দেশে নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যেগুলো দৃশ্যমান হয় শুধু সেগুলোই আমরা দেখতে পাই কিন্তু অধিকাংশ নারীরাই কাউকে কোনো অভিযোগ করেন না। এ ধরনের সহিংস ঘটনা সমাজের আানচে কানাচে প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে। খাদিজার সাথে যে পৈশাচিক ঘটনা ঘটে গেল তা  সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার তার প্রতিকারে জনতা উত্তাল হয়েছে।

বিবিএসের জরিপের মতে দেশে বর্তমানে নারীদের শতকরা ৮০ জনই কোনো না-কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন। যদিও সর্বশেষ সরকারি জরিপের ফল বলছে, দেশে গত চার বছরে বিবাহিত নারীদের নির্যাতন কমেছে ৭ শতাংশের মতো। তবে এই বিবাহিত নারীরা আগের মতোই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর হাতে।