সারাদেশ
  দাওয়াতে দ্বীনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
  01-09-2016

 

মাওলানা মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক আদ্দাঈ

দাওয়াত আরবি শব্দ। অর্থ ডাকা বা আহবান করা। কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে ঐ লক্ষ্যের দিকে আহবান করাকে দাওয়াত বলে। আর দাওয়াতে দ্বীন হলো ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন পরিত্রাণের আশায় আল্লাহর পথে আহবান করা।

আবু হামেদ আল গাযালির ভাষায়,

“ইসলামী দাওয়াত একটি কর্মসূচীর নাম। যাতে অন্তর্ভুক্ত থাকে সে সমস্ত জ্ঞান - বিজ্ঞান যার প্রতি সকল মানুষ মুখাপেক্ষী। যা তাদের জীবনের উদ্দেশ্য বলে দেবে এবং সঠিক পথ সুস্পষ্ট করে দেবে।”

ইবনে তাইমিয়া বলেন,

“আল্লাহর দিকে দাওয়াতের অর্থ হলো তাঁর প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর রাসূলগণ কর্তৃক আনীত বিষয় সমূহের ওপর ঈমান আনার আহবান। এভাবে যে, রাসূলগণ যা বলেছেন সেগুলোকে সত্য হিসেবে মেনে নেয়া এবং তাঁরা যা আদেশ করেছেন তা পালন করা।”

ড. রউফ শালাবী দাওয়াতের তিনটি সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যথাঃ

১. দাওয়াত হলো সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন। যে আন্দোলন মানব সমাজকে কুফর থেকে ঈমানে, অন্ধকার থেকে আলোয় এবং জীবনের সংকীর্ণতা থেকে পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনের প্রশস্ততায় নিয়ে যায়।

২. কোন সমাজে প্রচলিত ধ্যান - ধারণার পরিবর্তে সঠিক তাওহীদী ধ্যান - ধারণা গ্রহণ করার লক্ষ্যে ব্যাপক জনমত তৈরীর সমন্বিত প্রচেষ্টার নাম ইসলামী দাওয়াত।

৩. কোন সমাজে প্রচলিত জীবনাচার পরিবর্তন করে ইসলামী জীবনাচার গ্রহণ করার জন্য জনমত গঠনের প্রচেষ্টা হলো ইসলামী দাওয়াত। যে জীবনাচার আল্লাহর প্রতি ঈমানের উপর এবং যে জীবনাচারের নিয়ম-নীতিগুলো মহানবী (সঃ) প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত।

ড. ইসমাঈল হাজী ইব্রাহীমের ভাষ্য মতে,

‘ঞযব ঃবৎস ফধধিয রং মবহবৎধষষু ঁহফবৎংঃড়ড়ফ নু ধষষ ষবাবষং ড়ভ ংড়পরবঃু ঃড় সবধহ ধ সড়াবসবহঃ ঁহফবৎঃধশবহ ঃড় রহারঃব ধহফ পধষষ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষবং ঃড় ৎবষরমরড়হ’.

সুতরাং জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসূলে করিম ( সঃ) প্রদর্শিত বিধি- বিধান মেনে চলার আহবান জানানো হলো দাওয়াত।

 

♦ দাওয়াতে দ্বীনের লক্ষ্য ঃ

ইসলামী দাওয়াতের পরিকল্পনায় সাধারণ, সর্বব্যাপী এবং সুদূর প্রসারী সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। যেমন -

১. বন্দেগীর অনুভূতি জাগ্রত করাঃ আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ পূর্বক ইবাদত বন্দেগীর অনুভূতি মানুষের মাঝে জাগ্রত করা দাওয়াতের অন্যতম লক্ষ্য। মহান আল্লাহর বাণী, “আমি জ্বিন ও মানবজাতিকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।”

( সূরা আল যারিয়াত-৫৬)

২. শান্তি -শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাঃ দ্বিধা- বিভক্ত মতভেদ যুক্ত সম্প্রদায়ের ভুল ধারণার অপনোদন করে তাদের মাঝে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা দাওয়াতের একটি বিশেষ লক্ষ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আল্লাহ যেমনভাবে তোমার ওপর অনুগ্রহ করেছেন তেমনভাবে অন্যদের প্রতি অনুগ্রহ  করো। পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশৃঙ্খলাকারীদের পছন্দ করেন না।”

( সূরা আল ক্বসাস-৭৭)

৩. আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠাঃ আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দেয়া দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দাওয়াতের মূল লক্ষ্য। কেননা, কোন সমাজে বা ভূমিতে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হলে দাওয়াতে দ্বীনের অন্যান্য লক্ষ্যগুলো স্বাভাবিক ভাবেই পূর্ণ হতে সহায়ক হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করো এবং এ বিষয়ে মতপার্থক্য করো না।”

( সূরা আস-শুরা-১৩)

অন্যত্র দাওয়াতী লক্ষ্যের এ রূপরেখা আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না বিশৃঙ্খলা - বিপর্যয় সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয় এবং সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়।’ (সূরা আনফাল-৩৯)

৪. অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনায়নঃ মানুষকে গুমরাহীর পথ থেকে হিদায়াতের পথে এবং সকল অন্ধকার ও অজ্ঞতার কালিমা দূর করে আলোর পথে নিয়ে আসা দাওয়াতে দ্বীনের একটি বিশেষ লক্ষ্য। পবিত্র কুরআনুল কারীমে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,“মানুষকে তাদের প্রতিপালকের আদেশক্রমে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে এসে মহাপরাক্রমশালী ও মহা প্রশংসিত আল্লাহর পথে পরিচালনার জন্য এ কিতাব আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা ইবরাহীম-০১)

ইবনে জারীর তাবারী “তারীখুর রাসূল ওয়াল মুল্খ” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, পারস্য ( ইরান) জয়ের প্রাক্কালে বিপক্ষ সেনাপতি রুস্তম মুসলিম বীরসেনা রাযী ইবনে আমিরকে প্রশ্ন করেছিলো, তোমরা কেন যুদ্ধ করতে এসেছ? হযরত রাযী বলেছিলেন,“দাওয়াতের জন্য। মানুষের মধ্যে যারা ইচ্ছা করে তাদের আমরা মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর আনুগত্যে নিবেদিত করি। দুনিয়ার বৈষয়িক সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে আখিরাতের প্রশস্ততায় উন্নীত করি এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর অত্যাচার - শোষণ থেকে মুক্ত করে ইসলামের ইনসাফের সুশীতল ছায়ায় নিয়ে আসার জন্য দাওয়াত প্রদান করি।”

৫.ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারঃ ইসলামী দাওয়াতের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসার। এটি নবী- রাসূল গণেরও অন্যতম দায়িত্ব ছিলো। আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন,“অথচ রাসূলগণের কর্তব্য হলো কেবল সুস্পষ্ট ভাবে বাণী পৌঁছে দেয়া।”

( সূরা নাহল-৩৫)

“হে রাসূল আপনি প্রচার করুন যা আপনার রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে।”

(সূরা আল মায়েদা-৬৭)

৬. তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত ও খেলাফাত সম্পর্কে জ্ঞান দানঃ দাওয়াতের অন্যতম লক্ষ্য হলো মানবজাতিকে এসব বিষয়ে জ্ঞান দান করা।

তাওহীদঃ তাওহীদ শব্দের অর্থ একত্ববাদ। আল্লাহ তায়ালা এক ও অবিনশ্বর সত্তা। তাঁর জন্ম, মৃত্যু, সীমা, আকার,লয়,ক্ষয় - কোন কিছুই নেই। তিনি অংশীদারহীন, তিনি আদি, তিনি অনন্ত। সৃষ্টির লালন - পালন, জীবিকা দান, আইন প্রণয়ন প্রভৃতি সকল কিছুতে তাঁর একচ্ছত্র অধিকার। ঝঁঢ়ৎবসধপু নবষড়হম ঃড় অষষধয. কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, “বলো, আল্লাহ এক ও একক। তিনি স্বয়ং সম্পূর্ণ। তিনি জন্ম দেননা, তাকে জন্ম দেয়া হয় নি এবং তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।”

( সূরা আল ইখলাস)

রিসালাত : আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হিদায়াতের নির্দেশনা নিয়ে নবী- রাসূলগণ ধরা পৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁরা আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের এ দায়িত্বের নাম রিসালাত। আল্লাহ তায়ালা বলেন,“প্রত্যেক জাতির জন্য একজন রাসূল ছিলেন।” ( সূরা ইউনুস-৪৭)

আখিরাত: মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে বলা হয় আখিরাত। কুরআনুল কারীমের অসংখ্য স্থানে মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে অবিশ্বাসীদেরকে। নবুওয়াতের প্রারম্ভে মহান আল্লাহ নবী ( সঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,“ হে কম্বল আচ্ছাদিত ব্যক্তি। উঠো, মানুষকে সতর্ক করো এবং তোমার রবের বড়ত্ব ঘোষণা করো।” (সূরা আল মুদ্দাসসির:১-৩)

খিলাফত: আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীকে আবাদ করার জন্য অন্যান্য সৃষ্টির তুলনায় মানবজাতিকে বিশেষ জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেক দান করেছেন। একই সাথে দুনিয়ার জীবনে তাঁর বিধান বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর এসব নির্দেশের প্রতিনিধিত্ব করাই হলো খিলাফত। খিলাফতের দায়িত্ব যারা পালন করে তাদেরকে খলিফা বলে। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমে মানুষকে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি নামে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন, “ আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা বা প্রতিনিধি পাঠাতে চাই।” (সূরা আল বাকারা-৩০)

৭. মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা: ধনী- গরিব, সাদা- কালোর ব্যবধান দূরীভূত করে গোটা মুসলিম জাতিকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা দাওয়াতে দ্বীনের অন্যতম লক্ষ্য। কেননা, আল্লাহ তায়ালা ঐক্যবদ্ধ হওয়াকে ফরয করে দিয়েছেন। তাঁর ঘোষণা,“তোমরা পরস্পর সংঘবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে (দ্বীন) আকড়ে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হবেনা।” (সূরা আলে ইমরান-১০৩)

হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেছেন, “ঐক্যবদ্ধতা ছাড়া ইসলাম হয় না আর নেতৃত্ব ব্যতীত ঐক্যবদ্ধতা হয় না আর আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্ব হয় না।” (আসার)

 

♦ দাওয়াতে দ্বীনের উদ্দেশ্য:

দাওয়াতে দ্বীনের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ অর্জন। দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার জন্য সবথেকে বড় শর্ত হলো তাঁর রহমত ও সন্তোষ অর্জন। পবিত্র কুরআনের বাণী,“ যে ব্যক্তি দান করার, ভালো কাজ করার ও মানুষের মাঝে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আদেশ দেয়, সে ব্যক্তির আদেশে কল্যাণ রয়েছে। যে ব্যক্তি এসব কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য করবে, আমি অবশ্যই তাকে মহাপুরস্কার দান করবো।’

(সূরা আন নিসা-১১৪)

“মানুষের মাঝে এমন লোকও আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজেকে বিক্রি করে। আল্লাহ তাঁর ইবাদতকারীদের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল।’

(সূরা আল বাকারা- ২০৭)

সুতরাং দাওয়াতে দ্বীনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সকল মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব গ্রহনের আহবান পূর্বক বাস্তব জীবন থেকে ফাসেকী (পাপাচার) ও মুনাফেকী (কর্ম বৈষম্য) দূর করে সৎ ও খোদাভীতি সম্পন্ন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজ থেকে সকল প্রকার জাহেলী মতাদর্শ বা ব্যবস্থা নির্মুল করে আল্লাহর সন্তোষ অর্জন করা।

লেখক: আলেমে দ্বীন, কবি,

কলামিস্ট ও সহকারী সম্পাদক,

মানবাধিকার খবর।