সারাদেশ
  নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা:) এর অবদান
  01-07-2016

 মাওলানা মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক আদ্দাঈ   

পূর্ব প্রকাশের পর...

 

অর্থনৈতিক অধিকার ও অবস্থান:

অর্থনৈতিক দিক আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যেটা আসে সেটা হল উত্তরাধিকার আইন। ইসলাম পূর্ব যুগে নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির মালিক থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু ইসলাম তাকে দিয়েছে পূর্ণ অধিকার। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে পিতা মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে। সে পরিত্যক্ত সম্পত্তি পরিমানে অল্পই হোক অথবা বেশিই হোক। এ অংশ নির্ধারিত। আর সে নির্ধারিত অংশ হল দু’জন মহিলার অংশের সমান। বাহ্যিক দৃষ্টিতে উত্তরাধিকার প্রশ্নে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা রক্ষা করা হয় নি। পুরুষের তুলনায় নারীর আর্থিক সুবিধা খর্ব করা হয়েছে। ইসলামের গোটা পারিবারিক পরিকল্পনার দিকে দৃষ্টি দিলে এই বৈষম্যের কারণ বোধগম্য হবে। ইসলাম নারীকে পুরুষের তুলনায় উত্তরাধিকারের অংশ অর্ধেক দিলেও দুই উপায়ে তা পুষিয়ে দিয়েছে।

প্রথমত: স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত মোহরানার উপর সম্পূর্ণভাবে স্ত্রীরই অধিকার থাকবে। পিতা বা অন্য কোন অভিভাবক বা স্বামী তা আত্মসাৎ করতে পারবে না। মোহরানা থেকে নারীকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে কঠোর ভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তবে স্ত্রী স্বেচ্ছায় দান করলে স্বামী বা পিতা সেটা ভোগ করতে পারে।

দ্বিতীয়ত: বিবাহের সময় নারীকে প্রদত্ত অলংকার, উপহার ইত্যাদির মালিক সেই-ই। তাছাড়া স্বামীর সম্পদও একজন স্ত্রী তার সন্তান সন্ততি নিয়ে নিজের মত করে ভোগ করেন। তদুপরি ইসলাম নারীর ভরণ পোষণের দায়িত্ব বিবাহের পূর্বে পুরুষ অভিভাবকের উপর এবং বিবাহের পর স্বামীর উপর ন্যস্ত করেছে। এই অবস্থায় নারী পুরুষের মধ্যে সমান হারে উত্তরাধিকার বণ্টন যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ-সম্পদের পরই আসে শ্রমের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পদ। ইসলামী শরীয়তে সীমার মধ্যে থেকে অর্থনৈতিক ব্যাপারে শ্রম সাধনা করার অনুমতি রয়েছে নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই। অতএব একজন নারী ঠিক একজন নরের অনুরূপ সম্পদ অর্জনও করতে পারে এবং তার অধিকারীও হতে পারে। প্রয়োজনের তাগিদে সে যে কোন পেশা-ই অবলম্বন করতে পারে। আবার সে তার সম্পত্তি সম্পূর্ণ নিজের আয়ত্বে রাখতে পারে এবং নিজের ইচ্ছানুযায়ী খরচ করতে পারে। সমাজে নারীর দাসত্বের প্রধান কারণই হচ্ছে তার আর্থিক দূর্গতি। ইসলাম ব্যতীত সকল আইন কানুন নারীকে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে দূর্বল করে রেখেছে। এমনকি ইউরোপে উনবিংশ শতাব্দিতেও নারীর  বৈধ অধিকার স্বীকৃত ছিল না। কোন বিবাহিত রমনী স্বামীর অনুমতি ব্যতীত সম্পত্তির মালিক হতে পারত না। সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে চুক্তি বা ক্রয় বিক্রয় করতে পারত না। অথচ ইসলামই দিয়েছে তার একমাত্র অর্থনৈতিক মুক্তির চূড়ান্ত অধিকার। যা অন্য কোন ধর্ম দেয়নি।

নারীর বিবাহের অধিকার:

বিবাহের ব্যাপারে ইসলাম মেয়েদের দিয়েছে পূর্ণ অধিকার। মেয়ে বয়োপ্রাপ্ত হলে পিতা মাতা তার বিয়ের ব্যবস্থা করবে ঠিকই, কিন্তু সেটা মেয়ের সম্মতি সাপেক্ষে। এক্ষেত্রে অবশ্যই মেয়ের সম্মতি একান্ত প্রয়োজন। ইসলামী বিধান এই যে, নারী বিধবা হোক বা কুমারী হোক তার সম্মতি ব্যতীত তাকে বিয়ে দিতে পারে না।

খানসা বিনতে খাজাম আনসারিয়ার বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তার পিতা তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দিলে তিনি মহানবীর (স:) নিকট নালিশ করেন। মহানবী (স:) এ বিয়ে বাতিল করে দেন। একজন কুমারী মহানবীর দরবারে এসে নিবেদন করল, “আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিয়েছেন এতে আমি সন্তুষ্ট নই”। মহানবী তাকে বললেন, “তোমার ইচ্ছা হলে বিয়ে বহাল রাখতে পার অথবা বাতিল করেও দিতে পার।” এ থেকে বোঝা যায় মহানবী (সা.) শুধু নারী সম্পর্কে পুরুষের নয় বরং নারীরও মনেবৃত্তির পরিবর্তন করে দিয়েছেন এবং তাকে তার পূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্যের অধিকার দিয়েছেন।

অভিন্ন আইনের অধিকার:

প্রাচীন ধর্মগুলো নারীকে নগণ্য ও কম মর্যাদা এবং পুরুষকে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী মনে করে তাদের মর্যাদানুযায়ী পৃথক আইন রচনা করেছিলেন। কিন্তু ইসলামে নারী পুরুষের মর্যাদা সমান এবং তাদের জন্য অভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কুরআনে এরশাদ হয়েছে- পুরুষ যেমন কাজ করবে তেমনি ফল পাবে এবং নারী যেমন কাজ করবে ঠিক তেমনি তার ফল লাভ করবে। আরও এরশাদ হয়েছে- ‘নারী যদি এমন অপরাধ করে যা সাধারণ আইনে দন্ডনীয় তবে সে পুরুষের সমান শাস্তিই পাবে। বিচারের ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নি। যদি কোন মহিলা কোন পুরুষকে হত্যা করে তাহলে তার জন্য যা শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে তারজন্যও একই শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। অর্থাৎ যে কোন অপরাধের জন্য নারী পুরুষ একই শাস্তি। ইসলাম জারীকৃত আইনের একটি ধারা হচ্ছে- “স্ত্রীলোকের হত্যাকারী কোন পুরুষ হলে শাস্তি স্বরুপ তাকে হত্যা করা হবে। অর্থাৎ সমস্ত ক্ষেত্রেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমান আইন প্রযোজ্য।

মত প্রকাশ ও পরামর্শের অধিকার:

ইসলামের পূর্ব যুগে নারীর স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ও পরামর্শের কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু ইসলাম সমাজ জীবনের বিভিন্ন ব্যাপারে মেয়েদের অভিমত ও হৃদয়াবেগ প্রকাশের অবাধ অধিকার দিয়েছে। এটা তারা মৌখিকভাবে বা লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে। নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে এই মত প্রকাশের অধিকার তাদের রয়েছে। হযরত হাসান বসরী বলেছেন- ‘নবী (সা.) নারীদের সাথেও পরামর্শ করতেন এবং কোন কোন সময় তাদের অভিমত গ্রহণ করতেন।’ মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে নারীদের মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির একটা শর্ত ছিল যে, এই বছর মুসলমানরা উমরা না করেই ফিরে যাবে। তাই রাসূল করিম (সা.) সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কে হুদায়বিয়াতেই ইহরাম খুলে ফেলা ও সঙ্গে করে নিয়ে আসা পশুগুলোকে জবাই করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সাহাবাগণ যেহেতু এই সন্ধির শর্ত দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন, সে কারণে তারা কেউ এই নির্দেশ পালনে কোন তৎপরতাই দেখালেন না। এরূপ অবস্থা দেখে রাসূল (সা.) হযরত উম্মে সালমা (রা.) এর নিকট দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি সাহাবাদের মনস্তত্ব লক্ষ করে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা সহকারে পরামর্শ দিলেন যে, আপনি এর পর আর কাউকে কিছু না বলে যা কিছু করার নিজেই অগ্রসর হয়ে করে ফেলুন। দেখবেন, সকলেই আপনার দেখাদেখি সব কাজই করবে। রাসূল সা. এই পরামর্শ সানন্দে গ্রহণ করলেন এবং যখনই তিনি করণীয় সব কাজ করলেন সাহাবা কেরামরাও তার অনুসরণ শুরু করে দিলেন। এভাবে হযরত উম্মে সালমার (রা.) যথার্থ ও সুচিন্তিত পরামর্শ উপস্থিত অচলাবস্থা দূর করতে সক্ষম হলো এবং বাস্তবে প্রমান করে দিল যে, মহিলাদেরও যথেষ্ট জ্ঞান-বুদ্ধি আছে এবং তাদের পরামর্শ জাতীয় জীবনে অনেক সমস্যারই সমাধান করতে সক্ষম।

সমাপ্ত